যশোরের যশ খেজুরের রস

যশোরের যশ খেজুরের রস কথাটিই প্রমাণ করে যে, রস ও গুড় উৎপাদন এখানকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।

যশোর যাওয়ার ইচ্ছে অনেক দিনের। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা পড়তে গিয়ে যশোরের কপোতাক্ষ নদের নাম মগজে প্রবেশ করেছিল সেই শৈশবে। কোন জেলা কি জন্য বিখ্যাত তা পড়তে গিয়ে পড়েছিলাম, ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ প্রচলিত আপ্ত বাক্যটি। ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ যশোরের প্রধান ঐতিহ্য ও গর্বের প্রতীক যা ‘যশ’ (গর্ব/খ্যাতি) হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যশোরের মাটি ও জলবায়ু খেজুর গাছ জন্মানোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী, ফলে এখানকার গাছে রস বেশি হয় এবং রসও খুব মিষ্টি হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা গাছিদের দক্ষতা ও শ্রমে এই রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির প্রক্রিয়াটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। যশোরের খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড়, পাটালি, ঝোলা গুড় ইত্যাদির স্বাদ ও গুণগত মান এতটা উন্নত যে, এটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও সমাদৃত। ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ এই কথাটি প্রমাণ করে, খেজুরের রস এ অঞ্চলের মানুষের কাছে কতটা গর্ব ও সম্মানের।

যশোর যাওয়ার সাথে যোগ হয়েছে দুই স্তরের পদ্মা সেতু। যেখানে উপরের ডেকে সড়কপথ (গাড়ি, বাস, ট্রাক) এবং নিচের ডেকে রেললাইন (ট্রেন) রয়েছে, যা ঢাকা-যশোর রেল সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছে।

এক যাত্রায় পদ্মা সেতুর উভয় ডেকসহ আস্বাদন করতে চাই খেজুরের রসও। তাই ঠিক করি ঢাকা টু যশোর যাব বাসে আসব ট্রেনে। ঢাকা-যশোর ডাবল ডেকার গ্রিন লাইন। ১৩ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় গ্রিন লাইন বাস ঢাকার শেষ স্টেশন পোস্তগোলা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ছুটে। ঘড়িতে মিনিটের কাঁটা এক পাক ঘুরতে না ঘুরতে বাস পৌঁছে যায় পদ্মা সেতুতে। বাইরে কুয়াশা। কুয়াশার চাদরের ফাঁক দিয়ে বাম দিকের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রই। যা দেখলাম তা দেখে পদ্মা নদ না বলে প্রমত্ত পদ্মা এখন ‘পদ্মারচর’-এ পরিণত হয়ে পড়েছে। পদ্মার মুমূর্ষু অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে শিবচর ও কাশিয়ানি পাড় হয়ে বাস চলে এসছে নড়াইল। এখানে ২০ মিনিটের বাস বিরতি। ২০ মিনিট পরে আবার ছুটে বাস। দুই পাশে ফসলের জমি, মাঠ-ঘাট, পুকুর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিল-ঝিল ও সুন্দর বাড়িঘর। আমাদের খেজুরা বাস স্টপেজে নামার কথা। বাস যাবে সীমান্তের বেনাপোল স্টেশনে। কাশিয়ানি পৌঁছার আগে জানানো হয়, বাস খেজুরা যাবে না। খেজুরার যাত্রীদের কেশবপুর স্টেশনে নামতে হবে। আমরা যাব যশোরের নিউ টাউন। নিউ টাউন যে বাড়িতে যাব সে বাড়িরে লোকজন খেজুরা স্টেশনে অবস্থান করছেন। কেশবপুর উপস্থিত থাকার কথা তাদের ফোন করে জানিয়ে দিই।

পরদিন ভোরে ওঠে খেজুরের রসের জন্য বের হই। কাছেই গাছির বাড়ি। আগের দিন বলে রাখা হয়েছিল। আগের দিন বলে না রাখলে রস পাওয়া যায় না। পাতার ঘর, ঘরের সামনে চুলায় আগুন জ¦লছে। পাশে ১৫-২০টি খালি ঘটি। বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘটি আসা এখনো শেষ হয়নি। প্রতি ঘটি রসের দাম ৪০০ টাকা। প্রতিদিন তাজা রস বিক্রির পর যা উদ্বৃত্ত থাকে তা দিয়ে গুড় বানানো হয়। কয়েক কেজি গুড় নিতে আগে জানিয়ে রেখেছিলাম। তা আগেই রাখা হয়েছে। শীতের শুরু তার পরেও খেজুরের রস এবং গুড়ের চাহিদা অনেক বেশি। বিশেষ করে একদিকে যে হারে হাইব্রিড ও কৃত্রিম সামগ্রীতে বাজার সয়লাব, অন্যদিকে বাড়ছে খাঁটি জিনিসের চাহিদা। প্রতি কেজি গুড়ের দাম ৫০০ টাকা, তার পরও অগ্রিম অর্ডার দিয়ে না রাখলে পাওয়া যায় না।

যশোরে খেজুরের রস ও গুড়ের উৎপাদন দিন দিন কমছে মূলত গাছি সঙ্কট, খেজুর গাছ কমে যাওয়া এবং গাছ কেটে ফেলার কারণে, যা এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলেছে; যদিও কৃষি বিভাগ গাছ বৃদ্ধি ও রস সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে, তবু এর ব্যাপকতা হ্রাস পাচ্ছে।

নতুন গাছি তৈরি না হওয়ায় এবং পুরনো গাছিরা পেশা ছেড়ে দেয়ায় রস সংগ্রহে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ইটের ভাটা ও অন্যান্য কাজে অবৈধভাবে খেজুর গাছ কেটে ফেলায় গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে, যদিও কিছু নতুন গাছ লাগানো হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়ার অভাবও উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। খেজুরের রসের স্বাস্থ্যঝুঁকি (যেমন- নিপাহ ভাইরাস) নিয়ে সচেতনতা থাকলেও, গুড় উৎপাদন প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় তা থেকে গুড় খাওয়া নিরাপদ; কিন্তু কাঁচা রসের ঝুঁকিও একটি কারণ। রস ও গুড়ের দাম বাড়লেও যশোরে খেজুরের গুড় ও রস উৎপাদন কমায় স্থানীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলছে। যদিও কৃষি বিভাগ নতুন গাছ লাগানো এবং রস সংগ্রহে উদ্যোগ নিয়েছে।

পরদিন সকালে যাই খেজুরা এলাকায়। ‘খেজুরা’ নামকরণের অর্থ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি- ‘যশোরের খেজুরা এলাকা ১৮ শ’ শতকে খেজুর গুড় ও চিনির কারখানার জন্য পরিচিত ছিল। কারণ এখানকার অনুকূল মাটি ও জলবায়ু খেজুর গাছ জন্মানোর জন্য উপযুক্ত ছিল, যা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে দেশীয় পদ্ধতিতে প্রচুর উন্নত মানের গুড় ও চিনি উৎপাদনে সহায়তা করে, যা পরে সাদা চিনির আমদানির কারণে কিছুটা হ্রাস পেলেও এটি এই অঞ্চলের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল। এখনো আছে, যেখানে মি. নিউ হাউসের মতো উদ্যোক্তারাও এখানে কারখানা স্থাপন করেছিলেন।

যশোর ও এর আশপাশের অঞ্চল (যেমন- কুষ্টিয়া, ফরিদপুর) প্রচুর খেজুর গাছ জন্মানোর জন্য উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়া পায়, যা উচ্চ মানের খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদনের জন্য আদর্শ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যশোর অঞ্চলে এত বেশি গুড় উৎপাদিত হতো যে, এটি অবিভক্ত ভারতে বিখ্যাত ছিল; এমনকি ১৯০০-১৯০১ সালে পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত মোট গুড়ের প্রায় পুরোটা (প্রায় ১৭ লাখ মণ) যশোর থেকে আসত। ব্রিটিশ আমলে এ গুড়কে একটি মূল্যবান অর্থকরী ফসল হিসেবে দেখা হতো। এখানকার গুড়ের মান এতটা ভালো ছিল যে, ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউস ১৮৬১ সালে চৌগাছার তাহেরপুরে খেজুর গুড় থেকে চিনি তৈরির কারখানা স্থাপন করেন, যা ছিল পাম সুগারের প্রথম শিল্পায়ন। একসময় যশোর জেলায় ছোট-বড় ৫০০ চিনি কারখানা ছিল (যেমন- কোটচাঁদপুর ও আশপাশের এলাকায়), যা এ অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছিল।

যশোরের যশ খেজুরের রস কথাটিই প্রমাণ করে যে, রস ও গুড় উৎপাদন এখানকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সাদা চিনির আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অন্যান্য কারণে এ শিল্পের কিছুটা ক্ষতি হলেও, যশোর এখনো তার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত এবং এটি হাজারো কৃষক ও গাছির জীবিকা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।’

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক