তৃপ্তি-অতৃপ্তি, কিছু মত-দ্বিমত, ভিন্নমত, নোট অব ডিসেন্ট- ইত্যাদি থাকলেও জুলাই সনদের একটি ফয়সালা হয়েছে। পরবর্তী ধাপে নির্বাচন। সমান্তরালে হত্যা-গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। সনদ নিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে। তা করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকেও অনেক কথা বলতে হয়েছে। কথা বলতে যে পেরেছে, পাশাপাশি-মুখোমুখি যে বসেছে, এটিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কম কথা নয়। মুখ দেখাদেখি না হওয়া, কারো কথা না শোনা, কথা বলতে না দেয়া অথবা কথা বললেই টুঁটি চেপে ধরা, মামলা দিয়ে জেলবন্দী করা- এসব অপসংস্কৃতির আপাতত একটা অবসান হয়েছে আশা করা যায়।
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খোলাসা না হলেও একটি সনদ বা বোঝাপড়া যে হয়েছে, সেটিই বা কম কী? আভিধানিক ঐকমত্য না হোক, কিছু কিছু বিষয়ে মতের মিল হলেও বাংলাদেশকে আর রাতের ভোট, বিনাভোটে ১৫৪ জনকে বিজয়ী করে দেয়া বা ডামি-আমিতে নির্বাচনী তামাশা আর দেখতে হবে না- এ আশা করা যায়। যে-ই ক্ষমতায় যাক, তাকে চব্বিশের আগের অবস্থা চর্চায় যেতে ভাবতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের অনিশ্চয়তাও অনেকটা কেটে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো উপলব্ধিতে একাট্টা যে, ক্ষমতায়নে নির্বাচনের বিকল্প নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আবারো আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে সব পদক্ষেপ নেবে সরকার। ঐকমত্য সনদেরই অংশ এটি। আমরা এ বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করব না।’ রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। তাদের দীর্ঘ দিনের আলোচনা, চিন্তাভাবনা, মত-দ্বিমতের প্রশংসা করেছেন। পরে কখন কী হবে, না হবে- সেটি আরেক বিষয়। তাদের গত একটি বছরের পরিশ্রম ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস তার। কার্যকর বা বাস্তবায়ন কতটুকু হবে- এমন প্রশ্ন থাকাই স্বাভাবিক। তবে এটি আগামী দিনের রাজনীতির গতি নির্ধারণকারী সনদ। এতে কী আছে, না আছে তা গোপন থাকছে না। যেসব দলিল তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো হারিয়ে যাবে না। জুলাই সনদ ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। যেসব বিতর্ক হয়েছে, সেগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে ভিডিও করে ও বই করে রাখা হবে, যেন এগুলো সম্পদ হিসেবে থাকে, হারিয়ে না যায়। যাতে করে সবাই জানতে পারে, কেমন জাতি গড়ার জন্য এগুলো করা হয়েছে। দলিলের মতো এর কপি সবার কাছে পৌঁছে যেতে থাকবে।
এর আগে, বহুল আকাক্সিক্ষত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পরদিন জরুরি বৈঠক ডেকে সবার সাথে আরেক দফা কথাও বলেছেন প্রধান উপদেষ্টাসহ সব রাজনৈতিক দল ও কমিটির সদস্য। প্রধান উপদেষ্টা ড: ইউনূসই ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি। তার হয়ে এটির দেখভাল করেছেন সহসভাপতি প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ। বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি-রব, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। এর আগে বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনে তার সাথে বৈঠকে বসেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা। বৈঠকটি দরকার ছিল। এ বৈঠকটিও একটি ঘটনা হয়ে থাকবে আগামীর জন্য।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন) সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সাথে ম্যারাথন আলোচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সাথে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সদস্য হিসেবে আছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়েই তৈরি হয় জুলাই জাতীয় সনদ। জুলাই জাতীয় সনদের ভাগ তিনটি। প্রথম ভাগে সনদের পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে সনদ বাস্তবায়নের সাত দফা অঙ্গীকারনামা। এগুলোর বাস্তবায়নের দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের। মানে যারা ক্ষমতায় আসবেন। এর আগে, মোটা দাগের প্রাপ্তি নির্বাচন নিয়ে সঙ্কট-সন্দেহ, সংশয় কেটে যাওয়া। ‘ই’ প্রত্যয় যোগ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন হবেই। নির্বাচনও এ সনদেরই অংশ। সনদ ও নির্বাচন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। নানা বিষয়ে কমিশন হলেও নির্বাচন ছিল অন্যতম বিষয়। নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সাথে আলোচনা করা হয়েছে। নির্বাচন করবে রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারে, বিরোধী দলে বা আশপাশে থেকে দেশ চালাবে তারাই। তাই তাদের মধ্যে ঐকমত্য জরুরি ভেবেই মূলত ঐকমত্য কমিশন গঠন।
এ কমিশন গঠনকালেই বলা হয়েছিল- এর প্রধান করণীয় হচ্ছে ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে, সেটি যখনই হোক, তার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং এ প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা যে, তারা ক্ষমতায় গেলে, সব দলকে রাজি করাতে হবে বা কোনো দল সংসদে না যেতে পারলেও তারও দায়িত্ব হচ্ছে এ সংস্কারের জন্য কাজ করা।’ কতটুকু সংস্কার হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে। সরকার মোটামোটি একটি কাঠামোগত জাতীয় ঐকমত্য করে দিয়েছে। বাকিটা নির্ভর করছে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। সেখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে এসেছে সংস্কার। তারপরও নির্বাচনের ট্রেন ছুটেছে- এটি বড় বিষয়। মানুষ সংস্কার চায়। ফ্যাসিস্টের বিচারও চায়। আর চায় নির্বাচনের মতো নির্বাচন। নির্বাচনের নামে তামাশার জেরেই আজ এত কথা। মানুষ দেশটির জন্মের পর থেকেই নির্বাচনের নামে নানা তামাশা দেখেছে দর্শকের মতো। এখানে ভোট ও নির্বাচনের বহু মডেল। গণতন্ত্রেরও বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েকদলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনেরও এন্তার রকমফের! নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। বিনাভোট, রাতের ভোট। আমি-ডামি ভোট। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট তো আছেই। সূ² কারচুপি, স্থূল কারচুপির ভোটও আছে এ তালিকায়। সেই ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি বিষয় তো আছেই।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে একটি মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ওই মডেল ভোটের জন্য তৎকালীন সরকারের ইমেজে চরম আঘাত হানে। পছন্দের খন্দকার মোশতাককে জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকা এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এরপর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট। এ শোতে আরো নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদ জমানায়। নির্বাচনের এসব সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর ৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। তবে ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়া গত ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাসীনদের কাছে সেটি ছিল তখন সূক্ষ্ম কারচুপির মডেল। এর মধ্যেই গণ্ডগোল পাকে, তখনকার বিএনপি সরকারের মাগুরা ও মীরপুর উপনির্বাচনী মডেলে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দীনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনী নাশকতা। হতে হতে ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ।
এর আগে, ২০১৪ সালে বিনাভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড। ২০২৪ সালে যোগ হয় ডামি-আমি, নৌকা-ঈগল, ট্রাকের শো। অতঃপর ৫ আগস্টের করুণ পরিণতি। এর জের পোহাতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকেও। সরকার যত করেই বলছে, মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষের বিশ্বাসের পারদটা নামতে নামতে অতলে চলে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে আগের কোনো মডেলের সাথে সামনের মডেল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অবাধ-গ্রহণযোগ্য-আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত নির্বাচনের কড়া তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের অবিরাম কত যে চাপ ছিল গত টানা তিন মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে। তারা এসবের কেয়ারই করেনি। মানুষ এ সরকারের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি মডেল চায়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, জীবনের শেষ সময়ে এসে মানুষের মনে রাখার মতো একটি ভালো কাজ তিনি দেখাতে চান। তার আকাক্সক্ষা কবুল হোক।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]