ইসলাম-মুসলমান-সন্ত্রাসবাদ সমার্থক এক বিপজ্জনক অপপ্রচার

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর মুজফফরনগরসহ সমগ্র উত্তরপ্রদেশে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার নামানো হয়। আর এই যোগীর রাজত্বে হরহামেশা চলছে মুসলিম-দলিতদের ওপর মবলিঞ্চিং। এগুলো কি পৈশাচিকতা নয়?

১০ নভেম্বর ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ দিল্লির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ও ব্যস্ততম লালকেল্লা-জুমা মসজিদ এলাকা বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে। গাড়িবোমা বিস্ফোরণে মারা যায় ১৩-১৪টি প্রাণ। এই সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণ কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই সমর্থন করে না। এ ঘটনায় নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। যারা মারা গেলেন তাদের বেশির ভাগই মুসলিম। যারা ঘটনার সাথে যুক্ত, ঘটনা ঘটার ১০ মিনিটের মধ্যেই গোয়েন্দারা জানতে পারে, এ ঘটনার জন্য দায়ী জৈস-ই-মহম্মদ ও আলকায়েদা জঙ্গি। তাও সেটি সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়। ভারত সরকার স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। তবে এই বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর গদি মিডিয়ার ইসলামবিরোধী প্রচার পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। তৈরি হয়েছে ইসলামোফোবিয়া। কত ডাক্তার ধরা পড়ল। আবার তাদের ছেড়েও দেয়া হলো কোনো প্রমাণ না থাকায়। এই বিস্ফোরণে যারা মারা গেলেন তাদের বেশির ভাগ মুসলিম। তাদের কথা বলা হচ্ছে না। এই ঘটনায় যেসব অমুসলিম অভিযুক্ত তাদের বিষয়ে মোটেই চাউর করছে না গদি মিডিয়া। তাদের আড়াল করা হচ্ছে খুব কায়দা করে।

যদিও বলা হচ্ছে, এর উৎস তুরস্ক ও পাকিস্তান। আর হরিয়ানার ফরিদাবাদ আল ফাতিহা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী। কিন্তু দিল্লির লালকেল্লা-জুমা মসজিদ-লালকেল্লা মেট্রো স্টেশন- চাঁদনিচক এলাকার এত বড় হাই সিকিউরিটি জোনে বিস্ফোরণ হলো, সেটি কেন জানতে পারল না গোয়েন্দারা, এটিই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। বিস্ফোরণ হতে হতেই আমাদের দেশের ও কলকাতা গদি মিডিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইসলাম-মুসলমান-সন্ত্রাসবাদ সমার্থক এমন বয়ান ছড়াতে। আর তৈরি হলো ইসলাম-বিরোধিতার প্রচার। গদি মিডিয়া একেবারেই উঠে পড়ে লেগে গেল এই প্রচারণায় যে, সন্ত্রাসবাদী মানেই মুসলিম। গদি মিডিয়া উঠে পড়ে লেগে গেল, ‘ওংষধস রহ ফধহমবৎ, ফধহমবৎ রহ ওংষধস’. সারা দিন একনাগাড়ে প্রচার করতে লাগল, ইসলাম কত বিপজ্জনক। মুসলমান কত নৃশংস। যদিও নাইন-ইলেভেনের পর সিআইএ ও মোসাদ এই তত্ত¡ বেশি প্রচার করেছিল।

১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, দুই জার্মানিসহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর তারা টার্গেট করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিম দুনিয়াকে। ২০০১ সালের নিউ ইর্কের গগনচুম্বী ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের ঘটনায় মুসলিমদের ঘাড়ে একের পর দোষ চাপানো হয়েছিল। কিন্তু পরে জানা গিয়েছিল, সিআইএ-মোসাদের এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র এটি। সিআইএ-মোসাদের কাছে সবচেয়ে বড় দুশমন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও মুসলিম বিশ্ব। কেননা, দুটোই ক্যাডার বেস। দুটোই রেজিমেন্টেড।

ভারতেও আরএসএস-বিজেপি মুসলিমদের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে নেমেছে। ভারতের ১১-১২টি রাজ্য জঙ্গি উপদ্রুত। আর যখন নির্বাচন আসে তখন সে কাশ্মিরকে বেছে নেয়। একটি পুলুয়াম বা একটি পহেলগাম ঘটে। এ ধরনের ঘটনা অনেকবার ঘটে, বারবার ঘটে।

জিনিসপত্রের বাজারদর যখন গগনচুম্বী বা আগুনছোঁয়া, যখন দেশের লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো পানির দামে বিক্রি হয় তখন সীমান্তে বেজে ওঠে রণ-দামামা। কেবল কি ভোটব্যাংকের মেরুকরণ করার জন্য? যখন দেশে বেকারত্বের জ্বালা হু হু করে বাড়ছে, তার সমাধানের কোনো রাস্তা দেখি না, তখনও কিন্তু সীমান্তে বিস্ফোরণের আগুন জ্বলে ওঠে। যখন মানুষ জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে উদ্বেগে তখনও রাজনৈতিক মোটিভেটেড বিস্ফোরণ ঘটে বলে দাবি করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। আর এই বিস্ফোরণের পর ইসলামবিদ্বেষ যেন দারুণভাবে প্রচারিত হয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বানোয়াট গল্প বানানো হয়। তৈরি করা হয় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের গল্প। তারপর সব হিমঘরে ঢুকে পড়ে। একটি বিস্ফোরণে পুরো মুসলিম সমাজকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। গদি মিডিয়ার এ কোন অসভ্যতা ও অপপ্রচার? আমরা যেমন মনে করি আরএসএস-বিজেপিসহ সংঘ পরিবার মানেই সমগ্র হিন্দু সমাজ নয়। আবার আল কায়েদা, জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলাদেশ টিম, লস্কর-ই-তৈয়বা মানেই পুরো মুসলিম সমাজ নয়। এই ভারতের মহামানবের সাধনা ও সংহতির চর্চা বারবার হয়েছে। সংঘ পরিবারের প্রতিবাদ করতে গিয়েই এই মোদির জমানায় প্রাণ গেছে গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, কালবুর্গি ও গৌরিলঙ্কেশদের মতো প্রতিবাদী কলামিস্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। প্রাণ গেছে রোহিত ভেমুলার মতো দলিত-সন্তানকেও। বিভিন্ন রাজ্যে কত বাঙালি ও মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রাণ দিতে হয়েছে তার হিসাব নেই। সন্ত্রাসের আরেক নাম গেরুয়া বা আরএসএস সেটি কেন গদি মিডিয়া বলে না? উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কল্যাণ সিং যাদবের জমানায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, যোগী আদিত্যনাথ ও মোদির জমানায় তা রামমন্দিরে পরিণত।

ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে কারা খুন করেছে? গান্ধীঘাতক নাথুরাম গডসে তো আরএসএসের। তিনি তো একজন ব্রাহ্মণ সন্তান ও সাংবাদিক। তাই বলে গডসের জন্যই কি হিন্দু সমাজ বা ব্রাহ্মণসমাজ দায়ী। স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী অপকর্ম তো নাথুরাম গডসে করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীকে কারা খুন করেছে? তারা তো সব অমুসলিম। স্বাধীন ভারতে নেলি গণহত্যা ১৯৮২ সালে কারা ঘটিয়েছে? কারা ভাগলপুর, সুরাট, আমেদাবাদ, মুম্বাই দাঙ্গা ঘটিয়েছে? তার জন্য বিশেষ এক ধর্ম স¤প্রদায় দায়ী হবে কেন? ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজেপি-আরএসএসসহ সংঘ পরিবারের শীর্ষ নেতাদের সামনে উন্মত্ত করসেবকরা সেদিন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল। সেই মন্দিরের জায়গায় আজ রাষ্ট্রের আনুকূল্যে বাবরির জায়গায় রামমন্দির হয়ে গেছে। কারা গুজরাট গণহত্যা সংঘটিত করেছে তা নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করা জরুরি নয় কি?

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর মুজফফরনগরসহ সমগ্র উত্তরপ্রদেশে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার নামানো হয়। আর এই যোগীর রাজত্বে হরহামেশা চলছে মুসলিম-দলিতদের ওপর মবলিঞ্চিং। এগুলো কি পৈশাচিকতা নয়? মালেগাঁ বিস্ফোরণ, মক্কি মসজিদ ও সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ কারা ঘটিয়েছিল? সেই সংঘ পরিবারের স্বাধ্বী প্রজ্ঞা ও কর্নেল পুরোহিত। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েও ঘুরপথে তারা বেকসুর খালাস পেলেন। বিচারের নামে প্রহসন। ঢালাও হারে বিস্ফোরণ ঘটাও আর দোষ চাপাও মুসলিমদের ঘাড়ে। আর দেদার হারে মুসলিম ও ইসলামবিরোধী প্রচার করতে গদি মিডিয়াকে কাজে লাগাও। গোয়েবলসীয় থিওরি হলো- একটি মিথ্যাকে বারবার বলো, সেটিই সত্যে পরিণত হবে। আর ইসলামোফোবিয়াকে ঢালাও হারে প্রচার করো- এটিই আরএসএস-বিজেপির নীতি। যারা দেশের সংবিধানের ধার ধারে না। যারা ভারতের অসংখ্য মসজিদ ধূলিসাৎ করেছে তারা তো গেরুয়া সন্ত্রাসী। তাদের কোনো নৈতিক অধিকার থাকতে পারে না অন্য সমাজকে সন্ত্রাসী বলার।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কবি, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক