ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বৈষম্যমূলক নীতি

কাশ্মিরের নির্যাতিত মানুষ প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব নীরব রয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থা ‘ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ ২০২০ সালের প্রতিবেদনে ভারতকে একটি ‘উদ্বেগজনক রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মার্কিন সরকারকে ভারতের যেসব কর্মকর্তা মানবাধিকার ও ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে। কয়েকজন কংগ্রেস সদস্যও একই দাবি করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের সাম্প্রদায়িক সীমা লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে ভারত বহু বছর ধরে প্রায়ই উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে যার বেশির ভাগ থাকে ভিত্তিহীন ও অসত্য। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে ভারতের কোনো কোনো মিডিয়া মাত্রাতিরিক্ত মিথ্যাচার করে চলেছে। খোদ ভারতের কোনো কোনো ব্যক্তি ও সংস্থা থেকে সেগুলোর অসারতা প্রমাণও করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রপাগান্ডা যেন থামছে না। অন্যদিকে, কয়েক দিন আগে ভারতে ওয়াকফ আইনের সংশোধনী এনে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ছয় আখ একর ভূ-সম্পত্তি ও ভবন দখলে নেয়ার আইনি ব্যবস্থা হলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন পর এরূপ প্রতিবাদ জানানো হলো। কিন্তু ভারত তা হজম করতে পারেনি। তারা বলেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ যেন নাক না গলায়। উল্টো তারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তার প্রতি মনোযোগ দেয়ার নসিহত করে। ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশ কথা বললে সেটি যদি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হয়, তাহলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারত কথা বললে সেটি অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ হবে না কেন?

সাম্প্রতিককালে বিজেপি-শাসিত ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠী এখন দারুণ হুমকিতে পড়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করলেও ভারতে সাম্প্র্রদায়িক সহিংসতা কখনো একেবারে বন্ধ হয়নি। তবে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে মুসলিমরা উপর্যুপরি সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছেন। সাম্প্র্রতিককালে এর তীব্রতা বেড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের মুসলিমরা এখন কেন এতটা হুমকির মুখে পড়েছে? আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং উত্তর ভারতের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রকাশ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থিত দিল্লি গেটে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিহত ৯০ হাজার শহীদের নাম লিপিবদ্ধ আছে। তার মধ্যে ৬২ হাজারের বেশি নাম হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের। প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে থাকার পর বহু সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল থেকে এটি প্রমাণিত যে, ভারতের কোনো কোনো শ্রেণী ব্রিটিশের সুবিধাভোগী ও দালাল হিসেবেও ভূমিকা পালন করেছে। এতদসত্ত্বেও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভারতের সব সম্প্রদায়ের মানুষ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তবে এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল মুখ্য। এর অবশ্য একটি কারণও ছিল। সেটি ছিল যে, ব্রিটিশরা মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। সেই সাথে তারা মুসলিমদের উপর বেশি নিপীড়ন ও শোষণ চালিয়েছিল। ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম হান্টার তার বিখ্যাত ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলিমস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, ব্রিটিশ শাসনের আগে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় ছিল আর্থিক ও সামাজিকভাবে উন্নত; কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে তাদের অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের পক্ষে বেঁচে থাকাই কঠিন ছিল। ব্রিটিশ উপবিনেশের আগে ভারতবর্ষ মুসলিম শাসকরা রাজত্ব করেছেন প্রায় ৮০০ বছর। পুরো ভারতে মুসলিম শাসকদের স্থাপত্য নিদর্শনগুলো এতটা সমৃদ্ধ যে, পৃথিবীতে এরূপ উদাহরণ বিরল। ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা কমপক্ষে ২০ কোটি। তারা বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। শুধু তাই নয়; ভারত হচ্ছে তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাসের দেশ। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পর এর অবস্থান। বিশ্বের মোট মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় ১১ শতাংশ বাস করে ভারতে। ভারতের জনসংখ্যার কমপক্ষে ১৫ শতাংশ হচ্ছে মুসলিম। কোনো কোনো রাজ্যে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যার হার ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। লাক্ষ্যাদ্বীপে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৯৭ শতাংশ। জম্মু ও কাশ্মিরে প্রায় ৬৯ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ভোটাররা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ফ্যাক্টর। উগ্র হিন্দুদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে বেশি। তাদের এ দাবি পুরোপুরি সঠিক নয় বলেও মত রয়েছে। তবে কিছুটা সত্যতা থাকতেও পারে; কারণ বহু হিন্দু গর্ভজাত কন্যাশিশু হত্যা করে থাকে। কোনো মুসলিম তা করে না। একটি দেশের ১৫ শতাংশ অধিবাসী শুধু ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হওয়ায় তীব্রভাবে বৈষম্যের শিকার, এটি ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে একেবারে বেমানান ও সাংঘর্ষিক। ভারতের সরকারি চাকরিতে মুসলিম আছে মাত্র ১ শতাংশ।

২০০৬ সালে বিখ্যাত সাচার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, ভারতের বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার; এমনকি দলিত সম্প্রদায়ের চেয়েও বেশি। প্রায় ২০ বছর আগে মুসলিমদের প্রতি ভয়াবহ বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হলেও তার প্রতিকার দূরের কথা, মুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা এখন ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। বিজেপি ও আরএসএসের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে মুসলিমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। স্মরণযোগ্য যে, ভারতের ইতিহাসে এবারেই প্রথম, কেন্দ্রীয় সরকারে কোনো মুসলিম মন্ত্রী নেই। অথচ অতীতে দু-তিনবার ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন মুসলিম।

ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির সংবিধানে সংখ্যালঘুদের নাগরিক হিসেবে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিজেপি ও এর সমর্থক উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তা মানতে রাজি নয়। উগ্র হিন্দু নেতা ভি ডি সাভারকার লিখিত ‘হিন্দুত্বভা : হু ইজ হিন্দু’ গ্রন্থটি হচ্ছে তাদের মূলমন্ত্র। তাদের নীতি হচ্ছে এক ধর্ম এক দেশ; ভারত হবে শুধু হিন্দুদের। এ মাটিতে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে। মুসলিমরা হচ্ছে বিদেশী। অন্য ধর্মের লোকদের ভারতে থাকতে হলে তাদের হিন্দু হয়ে থাকতে হবে। তারা দাবি করে যে অখণ্ড ভারত হচ্ছে একমাত্র হিন্দুদের যার পরিসর আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে শুরু করে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত। বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগেও ভারতের রাজনীতিবিদরা হিন্দু ধর্মের নামে ভোট বাড়ানোর চেষ্টা করে গেছেন। এমনি যে কংগ্রেস নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করেও দলটি এর বাইরে নয়। এ প্রসঙ্গে ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নালে কাঞ্চন চন্দ্র লিখেছেন, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি আশির দশকে হুমকিতে পড়ে। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার দল পরাজিত হওয়ার পর তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী নিজের নিরাপত্তা প্রহরীর হাতে নিহত হওয়ার পর তার পুত্র রাজিব গান্ধী ক্ষমতায় আসার আগে তার মায়ের মতো হিন্দুধর্মীয় চেতনা আরো উসকে দেন। কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন লাভের আশায় যে নীতি পরিচর্যা করেছে তার ফলে বিজেপির মতো চরমপন্থী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছে।

প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, মুসলিমদের মসজিদ ভেঙে ফেলা হচ্ছে, তাদের নামাজরত অবস্থায় পেটানো হচ্ছে বা লাথি মারা হচ্ছে। এমনকি, দাড়িওয়ালা মুসলিমদের হেনস্তা করা হচ্ছে। এছাড়া গরুর মাংস রাখার অপরাধে পিটিয়ে হত্যা করার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। বিজেপি সমর্থিত উগ্র হিন্দুরা তলোয়ার, কিরিস ও রামদার মতো দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মসজিদের সামনে ঢোল বাজিয়ে উসকানি দিচ্ছে। বহু স্থানে মসজিদ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। মুসলিম নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তার এসব ঘটনা ঘটছে। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল মুসলিমদের ওপর নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসবের মাত্রা সাম্প্রতিককালে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়া সূত্র থেকে প্রমাণিত হচ্ছে।

সম্প্রতি আল-জাজিরা টেলিভিশন এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে ব্রিটিশ আমলেও ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৪৭ সালের পর থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত দেশটিতে বহুবার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৬৯ সালে গুজরাটে, ১৯৭০ সালে ভিওয়ান্দিতে, ১৯৮৬ সালে নীলিতে, ১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু হতাহত হয়েছে। ১৯৯২ সালে ভারতের উগ্র হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরঙ দল, শিব সেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থকরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে এবং তাতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। মসজিদটি ভাঙার পরে সেখানে বহু অর্থ ব্যয়ে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে যা উদ্বোধন করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর ১৯৯৩ সালে বোম্বেতে, ১৯৯৮ সালে কাশ্মিরে, ২০০২ সালে গুজরাটে, ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে, ২০১২ সালে আসামে, ২০১৩ সালে মুজাফফরনগরে ও ২০২০ সালে দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলিম নিহত হন। মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি সাধারণ ঘটনা। এতে প্রধানত মুসলিমরা তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যখন বিষয়টি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহৃত হয় তখন তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তাতে সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হন। এর প্রভাব পড়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এরূপ সহিংসতায় বারবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, এমনকি সক্রিয় অংশগ্রহণেও হয়েছে। যেমন নেতাদের ঘৃণাত্মক বক্তৃতা বা ঘটনার তদন্ত না করা। বিজেপি সরকারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তার জড়িত থাকার এরূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের পক্ষ থেকে লিন্ডসে মেইজল্যান্ড মন্তব্য করেন, বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিমবিরোধী মানসিকতা চরম আকার ধারণ করেছে যা হিন্দু জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজে লাগানো হচ্ছে। আবার ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি পুনরায় ক্ষমতায় এসে একের পর এক বিভিন্ন বিতর্কিত নীতি ও আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হচ্ছেন যাতে মুসলিমদের অধিকার উপেক্ষা করা হচ্ছে, যেমন তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সীমিত করা হচ্ছে। একইসাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। মোদির আমলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংস ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। এর ফলে ভারতের ভেতরে প্রতিবাদ হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মহল থেকেও নিন্দা প্রকাশিত হচ্ছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ২০২৪ সালে মোদির পুনঃনির্বাচনের পরে ধর্মীয় বিভাজন আরো বাড়বে।

ভারতের সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ ভার্সনে মন্তব্য করেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা যত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকবে, মুসলিমদের অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে এবং তা পরিবর্তন করা তত কঠিন হয়ে যাবে।

অন্যদিকে, ভারতের জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক গাজালা জামিল বলেন, মোদির প্রথম মেয়াদে পাঁচ বছর শাসনকালে মুসলিমদের উপর অব্যাহতভাবে আক্রমণ করা হয়, যার ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ রুদ্ধ হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আপনি যদি একজন মুসলিম হন তাহলে আপনি যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময়ে আক্রান্ত হতে পারেন।

বিভিন্ন উদ্ধৃতি প্রমাণ করে, বিজেপির শাসনামলে ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সহিংসতা অনেক বেড়েছে এবং তার প্রধান নিশানা মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু এ কথা বলা সমীচীন হবে না, ভারতের সব নাগরিক বিজেপিকে পছন্দ করেন, মোটেই তা নয়। যেমন মোদির সরকার মুসলিমদের বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন তৈরি করলে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তা বাস্তবায়ন করবেন না বলে ঘোষণা দেন। এ ছাড়া দুই হাজারের মতো সিভিল সোসাইটির সদস্য ওই আইনের তীব্র সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। ভারত কাশ্মিরে জোর জবরদস্তি করে সেখানকার মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দমিয়ে রেখেছে যার নিন্দা বিভিন্ন দেশ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ভারত জাতিসঙ্ঘের রেজুলেশন অবজ্ঞা করে আসছে। পাকিস্তানের সাথে তো ভারতের প্রধান বিরোধ কাশ্মির নিয়ে এবং এ নিয়ে কয়েকবার যুদ্ধও হয়ে গেছে।

জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন ভারতের নাগরিকত্ব আইনকে ‘মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করেছে। ইরান, কাতার, কুয়েত ২০২২ সালে ভারতের নেতাদের মুসলিম ও ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করেছিল। ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ভারতকে ক্রমবর্ধমান ইসলামবিদ্বেষ ও অবমাননা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কয়েকটি আরব দেশ যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাতকে মোদি ও তার সরকারের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে দেখা গেছে। মোদির দুবাই সফরকালে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে এবং তাকে খুশি করার জন্য শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দুবাইতে ব্যয়বহুল হিন্দু মন্দির নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, আরব দেশগুলোতে প্রায় দেড় কোটি ভারতীয় নাগরিক (অধিকাংশ হিন্দু) প্রবাসী কর্মজীবী রয়েছেন। তার মাধ্যমে ভারত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে। এসব আরব রাষ্ট্র যদি একটু শক্ত ভূমিকা নেয় তাহলে বিজেপি সরকার আর্থিক বিবেচনায় হলেও মুসলিমদের ব্যাপারে উদার নীতি অনুসরণ করত। কিন্তু সৌদি আরবসহ কোনো মুসলিম রাষ্ট্র ভারতের মুসলিমবিদ্বেষী নীতি পরিহারে কার্যকর চাপ দিচ্ছে না। একই কথা ফিলিস্তিনের মুসলিমদের ব্যাপারেও সত্য। সারা বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে, ইসরাইল যেমন ফিলিস্তিনবাসীদের উপর জুলুম চালাচ্ছে, উপমহাদেশে ভারত একইভাবে ভারতীয় ও কাশ্মিরি মুসলিমদের উপর জুলুম করছে।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী সব ক্ষেত্রে নাক গলিয়ে থাকে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় যেন দুনিয়ার ইজারা নিয়েছে। কিন্তু ভারতে উপর্যুপরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সব মার্কিন সরকার চুপ থাকার নীতি অনুসরণ করেছে। ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফরকালে মোদির ধর্মীয় সহিষ্ণুতার (?) প্রশংসা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তো মোদির সাথে কৌশলগত মিত্রতা গড়ে তুলেছিলেন।

কাশ্মিরের নির্যাতিত মানুষ প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব নীরব রয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থা ‘ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ ২০২০ সালের প্রতিবেদনে ভারতকে একটি ‘উদ্বেগজনক রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মার্কিন সরকারকে ভারতের যেসব কর্মকর্তা মানবাধিকার ও ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে। কয়েকজন কংগ্রেস সদস্যও একই দাবি করেছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের সাম্প্রদায়িক সীমা লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব

[email protected]