গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব একটি নতুন সামরিক জোটের উত্থান দেখতে পেল। সৌদি আরবের রিয়াদে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি প্রণিধানযোগ্য সামরিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ খুশিতে আলিঙ্গন করেন। চুক্তিটির প্রেক্ষাপট, সময়কাল ও বিশ্ব পরিস্থিতির বিবেচনায় একটি দৃষ্টি আকর্ষণকারী বিষয় বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এ চুক্তিকে সামরিক জোট ন্যাটোর মতো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (নয়া দিগন্ত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
চুক্তিনামা : এ চুক্তিটি হলো পাকিস্তান ও সৌদি আরব দুই দেশের ‘কৌশলগত যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি’। চুক্তি অনুযায়ী, ‘কোনো একটি দেশ আক্রান্ত হলে সেটিকে দুই দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখা হবে।’ চুক্তি সম্পাদনকালে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার, সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিফ মুনির, প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ ও অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব উপস্থিত ছিলেন, অর্থাৎ পাকিস্তানের নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী সবাই উপস্থিত ছিলেন চুক্তিটি স্বাক্ষরের সময়। চুক্তির উদ্দেশ্য মূলত দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা বৃদ্ধি, শান্তি ও স্বস্তি অর্জন, পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করা এবং যেকোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা। সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য হলো এই প্রতিরক্ষা চুক্তিতে অন্য আরব দেশগুলোর যোগদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। যার মানে হলো- মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটোর আদলে একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা জোট সৃষ্টির সূ² উপাদান এতে রোপিত হয়ে আছে।
অবশ্য পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক সেই ১৯৬৭ সাল থেকেই। তখন থেকে সৌদি সামরিক বাহিনীর আট হাজার দুই শতাধিক সদস্যকে পাকিস্তান প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানের প্রায় দুই হাজার সেনা সদস্য সৌদি বিমান ও সেনাবাহিনীকে কারিগরি, অপারেশনাল ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। (আমার দেশ, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) অন্য দিকে সৌদি আরব পাকিস্তানকে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছে।
নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : এমন সময় পাক-সৌদি চুক্তিটি সম্পন্ন হলো যার ঠিক আট দিন আগে ইসরাইল কাতারের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়েছে। ফিলিস্তিনের হামাস নেতারা কাতারে অবস্থান করছিলেন কাতারের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সাথে হামাসের শান্তি আলোচনার লক্ষ্যে। হামাসের রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য করেই ইসরাইল হামলা করেছে বলে বয়ান দিয়েছে। এর আগে হামাস নেতারা মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের অভ্যন্তরেই ইসরাইল কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছিল, ইসরাইল কোনোভাবেই কাতারে আক্রমণ চালাবে না। কাতারে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে; তথাপি ইসরাইল এ হামলা চালাতে কুণ্ঠিত হয়নি। মার্কিন পূর্বানুমোদন ছাড়া ইসরাইল এ হামলা চালাতে পারে না। এর আগে ইসরাইল আশপাশের সব দেশে হামলা করেছে। ইরাক, ইরান, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, মিসর- এসব দেশেই একে একে দোর্দণ্ড প্রতাপে হামলা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরব মার্কিন ছাতার নিরাপত্তায় আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি অবাধ আগ্রাসনে সৌদিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
কয়েক মাস আগে মধ্যপ্রাচ্যে ও দক্ষিণ এশিয়ায় দু’টি স্বল্প সময়ের হাইভোল্টেজ যুদ্ধ বিশ্ব নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেই নতুন করে রচনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর মার্কিন বাহিনী এবং মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেসের (আইডিএফ) একযোগে হামলাকে ইরান সাহস ও কৌশলের সাথে মোকাবেলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আকারের ভারতীয় বাহিনীকে কৌশলগতভাবে পরাস্ত করেছে। বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা ও সামরিক পুনবির্ন্যাসের এই ক্রস রোডে সৌদি আরব তার দুর্বলতার অসহায়ত্বকে অনুভব করছে। ইসরাইল অত্যন্ত শক্তিধর সামরিক সামর্থ্যরে পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্রেরও অধিকারী। এ অবস্থায় সৌদির একটি পারমাণবিক ছাতার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। এ দিকে সাম্প্রতিককালে পাকিস্তান বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও তেহরিক-ই-পাকিস্তান (টিটিপি) গোষ্ঠী দ্বারা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। একই সাথে বন্যা এবং গত মে মাসের ভারতের সাথে যুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে পাকিস্তান সৌদি আর্থিক প্রণোদনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারত ও ইসরাইল একটি ঐতিহাসিক বিনিয়োগ চুক্তি ‘বাইল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট-বিআইএ’ সম্পন্ন করেছে। বিগত এক দশক ধরে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের ক্রেতা হলো ভারত। ২০২৩ সাল থেকে ভারতীয় কারখানায় ইসরাইলের জন্য ড্রোন, রকেট ও বিস্ফোরক তৈরি করা হচ্ছে। গাজায় ইসরাইলের স্থল বাহিনী ভারত-ইসলাইলি যৌথ কোম্পানির উৎপাদিত ‘এআই’ ভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তা ছাড়া মুসলমানদের সাথে ভারতের সাম্প্রতিক আচরণ ইসরাইলেরই অনুরূপ দেখা যাচ্ছে। ইসরাইল গাজায় যা করছে তার সাথে কাশ্মিরিদের সাথে ভারতীয় সরকারের আচরণে অদ্ভুত রকমের মিল রয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি পাকিস্তান ও সৌদি আরবের যৌথ প্রতিরক্ষার চুক্তিকে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
চুক্তির প্রভাব : এ চুক্তির ফলে পাকিস্তান সৌদি আরব থেকে সামরিক খাতে প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা পেতে পারে। ফলে সৌদি অর্থ ও পাকিস্তানে সামরিক বিশেষজ্ঞভিত্তিক অভিজ্ঞতা দুই দেশকেই দারুণভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে। যার ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতায়। তবে ভারত অবশ্যই একটি বিশাল স্নায়ুবিক চাপে পড়তে যাচ্ছে এ চুক্তিতে। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ তাদের মার্কিন নিরাপত্তা কাঠামোর প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে। এর সুযোগ নিয়ে চীন পুরো এশিয়ায় এ চুক্তিকে চীন-মার্কিন দ্ব›েদ্বর বাফার প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ইরানও এ চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন-ইসরাইলের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। আর এই পাক-সৌদি চুক্তি ইসরাইলের ফেরি করা আব্রাহাম অ্যাকর্ডকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে। তবে চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে একা হয়ে পড়া ভারত ইসরাইলের দিকে আরো ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ইসরাইলের দক্ষিণ এশিয়ার নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়লে কাশ্মিরকেন্দ্রিক সঙ্ঘাতের তীব্রতা বাড়বে। এই অস্থিতিশীলতার বিষবাষ্প বাংলাদেশেও ছড়াতে পারে বলে চিন্তকরা মনে করেন। এ চুক্তির আরো একটি সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে, যাতে আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ভারত আবারো মার্কিন বন্ধুত্বের হাতছানি পেতে পারে।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া : সৌদি-পাকিস্তান সাম্প্রতিক চুক্তির আপাতত বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া বলতে শুধু ভারতই প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ভারতের প্রতিক্রিয়ায় অব্যক্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে! ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘জাতীয় নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর এ চুক্তির কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে ভারত তা তারা খতিয়ে দেখছে। সরকার দেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ (প্রথম আলো, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনবির জয়সাল বলেছেন, সৌদি আরব আমাদের দুই দেশের মধ্যকার পারস্পরিক স্বার্থ এবং স্পর্শকাতরতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখছে বলে আশা করি। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই চুক্তি ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস নেতারা এ চুক্তিকে মোদির আরো একটি ব্যর্থতার সনদ বলে জানিয়েছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখনো প্রকাশ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল আপাত কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করলেও তারা যে অখুশি হবে তা স্পষ্ট। কারণ সৌদি রাজদরবারের ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষক আলি শিহাবি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক ছাতা সৌদি আরবকে ছায়াদান করবে।’ (ডেইলি স্টার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) আর সৌদি পারমাণবিক প্রতিরক্ষার প্রশ্নে ইসরাইল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জড়িয়ে পড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বস্তুত এ চুক্তিতে আমেরিকা ও ইসরাইলের স্পর্শকাতরতা একটি স্বাভাবিক বিষয়। আর পশ্চিমারা অবশ্যই এই ইস্যুতে মার্কিনিদের অনুসরণ করবে অথবা ইসরাইলের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে বলে মনে হয়। আরেক বড় দেশ চীন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে। তবে চীনের এ ইস্যুতে নেতিবাচক মনোভাব থাকবে না বলে মনে করার কারণ রয়েছে। এ চুক্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মার্কিনিদের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অবিশ্বাস ও অনাস্থা তৈরি হলে তা চীনের ভূরাজনীতির সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
পাক-সৌদি চুক্তির ভবিষ্যৎ : চুক্তির ভবিষ্যৎ গণনা করা খুবই কঠিন। এর জন্য আরো সময় পার হতে হবে। এ চুক্তিকে উন্মুক্ত রেখে অন্যান্য দেশেরও এতে যোগ দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। যদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও অন্যান্য মুসলিম দেশ এতে যোগ দেয়, তবে তা মুসলমানদের ন্যাটো হয়ে উঠতে পারে। আর পশ্চিমাদের জন্য এটিই এ চুক্তির সবচেয়ে বিপত্তিকর দিক। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব কোনোভাবে এ চুক্তির বিস্তার হতে দেয়ার কথা নয়। মার্কিনিরা এতে যুক্ত না হওয়ায় প্রথমে গোপনে সম্ভাব্য দেশগুলোকে নিরুৎসাহিত করবে। তাতে কাজ না হলে প্রকাশ্যে শক্তি দিয়ে এ চুক্তি ব্যাপকতা রোধ করতে নামতে পারে। যেমনটি তারা ইরানের শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপই গ্রহণ করেছে। এটি তারা করবে মূলত নিজেদের আধিপত্য, অস্ত্র বাণিজ্য, অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানকে সামনে রেখে। তবে মাঝে ইসরাইলকে ব্যবহার করবে চুক্তি বিরোধিতার ফ্রন্টলাইনে রেখে। আর ইসরাইলও এ চুক্তির বিস্তৃতিকে তার নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে নেয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ব্যাপকভাবে এ চুক্তির আওতাভুক্ত না হওয়ার ট্রাম্পকার্ড হতে পারে এসব দেশে রাজতন্ত্র অবসানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হুমকি। মার্কিনিরা এ কার্ডটিও ছাড়তে পারে পাক-সৌদি চুক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে রাখার জন্য।
সৌদি-পাকিস্তান চুক্তির সফলতা মুসলিম বিশ্বের জনগণের কাছে আশার আলো হয়ে উঠতে পারে। কারণ মুসলিম উম্মাহ বর্তমানে চরমভাবে দেশে দেশে ইসলামোফোবিয়ার শিকারে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সময়ের দাবি হলো- তাদের একটি সম্মিলিত নিরাপত্তা ছাতা।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক