ভারতের স্বাধীনতার ৭৮ বছরে এসে এখন এটি উপলব্ধি করতে হচ্ছে যে, ভারতের মুসলিমদের অস্তিত্ব কতখানি বিপন্ন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৯/১১-এর পর এ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব কতখানি সঙ্কটে তা বলিউডের সুপার স্টার শাহরুখ খান অভিনীত ‘মাই নেইম ইজ খান’ হিন্দি ছবিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতের মরহুম রাষ্ট্রপতি মিসাইলম্যান এ পি জে আবদুল কালামকে বিদেশ সফরে বিমানবন্দরে কড়া নজরদারির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। পরিচয় সঙ্কট (আইডেনটিটি ক্রাইসিস) থেকে অস্তিত্বসঙ্কট (ক্রাইসিস অব একজিসটেন্স) এখন বিপন্ন। বলা ভালো, ক্রমশ ধ্বংসের দিকে। আর চলতি বাংলায় বলা চলে, মেরে ফেলা হচ্ছে। এই মুসলিম সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য কার্যত মেরে ফেলা হচ্ছে। জীবন-জীবিকা নষ্ট করা হচ্ছে।
প্রথমত, মুসলিমদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে ফেলা হচ্ছে। ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বসবাসরত মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী তকমা লাগানো হচ্ছে। বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মুসলিমদের নিজেদের দানের টাকায় গড়া খারিজি কওমি মাদরাসাগুলো সন্ত্রাসী গড়ার ডেরা বলা হচ্ছে। রামকৃষ্ণ মিশন বা খ্রিষ্টান মিশনারির ধাঁচে মুসলিমদের গড়া মিশন স্কুলগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। অভিযোগ, মুসলিমদের মিশন স্কুলগুলো নাকি মৌলবাদী হয়ে উঠছে।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মোগলদের তৈরি করা মোগলসরাইয়ের নাম বদল করে হলো দীনদয়াল, মোগল সম্রাট আকবরের তৈরি করা এলাহাবাদ শহর ও স্টেশন হয়ে গেল প্রয়াগ, দিল্লির অরঙ্গাবাদ মার্গ নামের রাস্তাটি হয়ে গেল এ পি জে আবদুল কালাম রোড। মুসলিম নামাঙ্কিত আসামের করিমগঞ্জ হয়ে গেল শ্রীভূমি। এমনকি কলকাতার নেতাজি সুভাষ বন্দরের নাম বদলে রাখা হলো শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর। সব থেকে বড় কথা হলো, মহারাষ্ট্রের অন্যতম বিখ্যাত শহর ও স্টেশন অরঙ্গাবাদের নাম বদলে করা হলো ছত্রপতি সাম্ভাজিনগর। ছত্রপতি সাম্ভাজি ছিলেন শিবাজীর ছেলে। অরঙ্গাবাদ সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্মৃতিবিজড়িত শহর। এবার নিশানা হলো বিজেপি-আরএসএসের মোগল সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের সমাধি তাজমহল। এই তাজমহল পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের অন্যতম। এই তাজমহল নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তাজমহলের পাথর দেখেছ? দেখেছ কি তার প্রাণ? / অন্তরে তার মমতাজ নারী বাহিরেতে শাহজাহান’। এ প্রেমের সমাধি তাজমহল নাকি শিবমন্দির ছিল। তাই বাবরি মসজিদের মতো একেও ধ্বংস করতে হবে। এটা বিজেপির নিশানা।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতের মুসলিমদের আর্থসামাজিক কাঠামো কত দুর্বল তা স্পষ্ট করে দিয়েছে ২০০৫ সালের নভেম্বরে গঠিত সাচার কমিটির রিপোর্ট। তখন ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতায় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার। যার প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। ইউপিএয়ের চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধীর সাহসী পদক্ষেপে সেদিন বিচারপতি রাজেন্দ্র সিং সাচারের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি সারা ভারতের মুসলিমদের আর্থসামাজিক চিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, মুসলিমদের আর্থসামাজিক অবস্থা এত করুণ যে, তা হিন্দু সমাজের দলিত-আদিবাসী-নমশূদ্রদের থেকে খারাপ। মনমোহন সিং সে সময় ২০ দফা অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করেন। কিন্তু সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে যতখানি রাজনৈতিক ফায়দা তুলেছে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ দল, এর সুপারিশগুলো সেভাবে কি কার্যকর করা হয়েছিল? ২০১১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে নিজের রাজনৈতিক আখের গুছিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি। তার জমানাতে দু-দুবার রাজেন্দ্র সাচার কলকাতায় এসে ঘুরে গেলেন কেন? অথচ মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা দিয়েছিলেন, সাচারকে এনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের বিকাশে রোডম্যাপ করা হবে। মুসলিম-অধ্যুষিত মালদা-মুর্শিদাবাদে আজ কেন এত তীব্র নদীভাঙন? কেন ভাঙন থামাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? বাম জমানায় যেখানে চাকরির হার ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, সেখানে তৃণমূলের আমলে মুসলিমদের চাকরির হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু কেন? আত্মকেন্দ্রিক তৃণমূলের মুসলিম নেতাদের মুখে কুলুপ কেন? আবার ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে বিজেপি সাচার কমিটির কোনো রিপোর্ট কার্যকর করেছে? মোটেই না। বিজেপি ক্ষমতায় এসে কেবল মুসলিমদের বেছে বেছে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে বলির পাঁঠা করেছে। আরএসএসের রাঘববোয়ালরা বিস্ফোরণ ঘটাল। তার দায় চাপানো হলো মুসলিমদের ওপর। কিন্তু হায়দরাবাদের মক্কি মসজিদ বা সমঝোতা এক্সপ্রেসের ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে, আরএসএস বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হয়েও ঘুরপথে বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। অথচ নির্দোষ উমর খালিদ ও সারজিল ইসলাম এখন জেলের ঘানি টানছেন।
জিন্নাহর প্রাপ্ত পাকিস্তান ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ছিল ডমিনেন্ট স্টেট। ১৯৫৬ সালের পরে হয়েছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান। একজন হিন্দু কবি তুলসী রামকে দিয়ে তিনি লিখিয়ে নিতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে চিরবিদায় নেন। তিনি বেঁচে থাকলে ইতিহাস কোথায় দাঁড়াত সেটা ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু আজকের পাকিস্তানে যত শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু থাকুক না কেন, দু-একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া তাদের বিপন্ন হতে হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক নারকীয় ঘটনা ঘটলেও অন্য সম্প্রদায়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধ্বংস করা হয়নি।
তসলিমা নাসরিন ভারতে থেকে যত বাতেল্লাবাজি করুন না কেন, তিনি ভারতে আছেন। এদেশের মুসলিম বা ধর্মীয় মুসলিমরা কতখানি বিপন্ন, তিনি নিজে দেখছেন, কিন্তু এতটুকু কলম চালানোর ক্ষমতা তার নেই। দিল্লির কাছের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে কম করে দুই শতাধিক মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। এই তো সেদিন মধ্যপ্রদেশের সম্ভলের মসজিদটাও গুঁড়িয়ে দিয়েছে আরএসএস-বিজেপি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা তো এখন ইতিহাস। আর বাবরি মসজিদ থেকে রামমন্দির হওয়ার পর তার বিকল্প হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘায় সরকারি খরচে মমতা ব্যানার্জি তৈরি করলেন জগন্নাথ মন্দির। এই সরকারি খরচে তিনি আরো একটি দুর্গা-উদ্যান করবেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে তিনি দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের ধাঁচে আরো একটি মন্দির করবেন বলে গলা ফাটিয়েছেন। কয়েক লাখ ক্লাবকে পুজো-অনুদান এক লাখ ১০ হাজার টাকা করে। মুসলিমদের যে ইমাম ভাতা দেয়া হয় সেটি তো ওয়াকফ বোর্ড থেকে। অর্থাৎ বিজেপির হিন্দুত্ববাদের বিকল্প মমতার পাল্টা হিন্দুত্ববাদ।
আমাদের শিক্ষা নিতে হবে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা থেকে। একদিকে বঙ্গের শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের ডাকা ডাইরেক্ট অ্যাকশন, কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী ও হিন্দু মহাসভার কূটনীতি ও ব্রিটিশ সরকারের ষড়যন্ত্র এ দাঙ্গা সঙ্ঘটিত করেছিল। অথচ মিথ্যাভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের’ জন্য দোষারোপ করা হয়। কিন্তু সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক নেতা মুহাম্মদ ইসমাইল, এএমও গণি, মহম্মদ ইলিয়াস, আবদুল হালিম, সোমনাথ লাহিড়ী ও বঙ্কিম মুখার্জিরা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। গোটা কলকাতায় নামিয়ে দেওয়া হয় ট্রাম শ্রমিকদের । কলকাতার দখল নেন ট্রাম শ্রমিকরা। দাঙ্গা থেমে যায়। ১৯৬৪ সালেও বামপন্থীরা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-তৃণমূলের বাইনারিতে বামপন্থীরা ডাহা ফেল। বামপন্থীদের শ্রেণীসংগ্রাম দুর্বল হয়ে গেছে, যেটা আমাদের কাছে খুব দুর্ভাগ্যজনক।
নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কিভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ছিলেন সরকারি মেশিনারি দ্বারা তাতে ২০০২ সালে মোদিকে মানুষ ‘গুজরাটের কসাই’ বলেছিলেন। আর এখন যোগী আদিত্য নাথ সমগ্র উত্তরপ্রদেশে তাই করছেন। কিভাবে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের বেছে বেছে মেরে আতঙ্ক তৈরি করেছেন। উত্তরপ্রদেশের মুজফফর নগর থেকে বিশাল এলাকায় মুসলিম গণহত্যা ও মব লিঞ্চিং সংঘটিত করেছেন। খোদ উত্তরপ্রদেশে দুই শতাধিক মসজিদ ভাঙা হয়েছে। মুসলিম এলাকায় হিন্দুরা বাজারহাট না করে তার ফতোয়া জারি করা হয়েছে। হিন্দু এলাকাতেও অনুরূপ ফতোয়া। এটিই কি ভারতের সংবিধান?
আসামে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা প্রতিদিন মুসলিমদের হুমকি ও ফতোয়া জারি করছেন। মুসলিমদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আসামের বাঙালি ও মুসলিমদের তিনি বিদেশী ও অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়েছেন। এদের আসাম থেকে বের করে দেয়ার হুমকিও দিচ্ছেন প্রতিদিন। আর কটূক্তি তো আছেই।
মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাগুলো কার্যকর করেছেন। হিন্দুরাষ্ট্র করতে গিয়ে ভারতের সংখ্যালঘুদের সব ধরনের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর বারবার আঘাত হেনেছেন। ওয়াকফ সংশোধনী আইন পাস করিয়ে তা এখন আদানি-আম্বানিদের হাতে তুলে দেয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছেন। মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাটে যা করেছেন, সেটি সমগ্র ভারতে মুসলিম গণহত্যাকে সংঘটিত করছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মনিপুর রাজ্য আদিবাসী জাতি দাঙ্গায় আজও অগ্নিগর্ভ। শিকার সেই সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানরা। ২০২৪ সালের ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়াই বিজেপি হিন্দুরাষ্ট্রটি করতে পারেনি ব্লুপ্রিন্ট করেও। ভারতে মুসলিমরা কেবল ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। মোদি কেবল মুসলিমদের কিভাবে অস্তিত্ব ধ্বংস করা যায়, তার জন্য সব দাওয়াই প্রয়োগ করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো যেন নিষ্ক্রিয়। সাচার কমিটির কোনো সুপারিশ সেভাবে কার্যকর করা হয়নি। কেবল ‘মন কি বাত’-এর গল্প শুনিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশের’ গলাবাজি করেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেন তিনি মিডিয়ার মুখোমুখি হন না? একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তিনি খতম করতে চান। ভারতীয় মুসলিমরা সেই অস্তিত্বসঙ্কটের মুখোমুখি। বলা ভালো অস্তিত্বসঙ্কটে।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি



