শরিফ ওসমান হাদি আর নেই। কিন্তু তার অনুপস্থিতি ভর করে আছে চার পাশে। শূন্যতা নয়- একটি প্রশ্ন হয়ে। হাদির মৃত্যু একটি বার্তা। কারো কাছে হুমকি। কারো কাছে শপথ। জুলাই বিপ্লবের আগেও তিনি ছিলেন। জুলাইয়ের ভেতরেও। জুলাইয়ের পরেও। একই কণ্ঠে। একই উচ্চারণে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। তার দোসরদের বিরুদ্ধে। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না- কথাটি সত্য নয়। ক্ষমতা না থাকাতেও তিনি বিপজ্জনক ছিলেন সত্য কথনের জন্য। সত্য কথনই ছিল তার শক্তির উৎস।
চব্বিশের ৫ আগস্টের আগে বর্ষা বিপ্লব যখন উত্তাল, তখন হাদি ছিলেন সম্মুখ সারিতে। ক্যামেরার সামনে। মাইকের সামনে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষের সামনে। তিনি হিংসা ছড়াননি। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নের মতো ধারালো ছিল তার ভাষা। সেই ভাষাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। হাদির মৃত্যুর পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি হাদিকে শহীদ হিসেবে সম্বোধন করেছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অকুতোভয় যোদ্ধা বলেছেন। রাষ্ট্র যখন কাউকে শহীদ বলে, তখন রাষ্ট্রও দায় নেয়। এ দায় শুধু শোকের নয়। এ দায় বিচারের। কিন্তু প্রশ্ন থামে না। হাদিকে কেন হত্যা করা হলো? কারা উসকানি দিলো? কারা পরিবেশ তৈরি করল? এটি সবাই জেনে গেছে।
হাদি নিজে ছিলেন তরুণ। মাত্র ৩৩ বছর। কোনো অতীতের ভার নয়- একেবারে সময়ের সন্তান। জুলাইয়ের সন্তান। তরুণদের প্রতিক্রিয়া কী হবে- এ প্রশ্ন আজ বাতাসে। রাস্তায়। ক্যাম্পাসে। অনলাইনে। এ প্রজন্ম জুলাই দেখেছে। রক্ত দেখেছে। ভয় জয় করতে শিখেছে। হাদির হত্যাকাণ্ড তাদের থামাবে- এটি ভাবা ভুল; বরং ক্ষোভ জমাবে। অবিশ্বাস বাড়াবে। কারণ তরুণরা প্রশ্ন করছে- এটি কি একজনকে হত্যা, না একটি কণ্ঠকে? এটি কি একটি মৃত্যু, না একটি বার্তা?
হাদি তরুণদের নিয়ে কথা বলতেন দূর থেকে নয়। ভেতর থেকে। কারণ তিনি নিজে সেই ভেতরের মানুষ ছিলেন। হাদি বিশ্বাস করতেন, তরুণরা কোনো ‘ভবিষ্যৎ’ নয়- তরুণরা বর্তমান। তিনি বলতেন, ‘আমাদের অপেক্ষা করার সময় নেই। অপেক্ষা মানে অন্যায়ের সাথে আপস।’ এই একটি বাক্যই তার রাজনীতি। তরুণদের তিনি কখনো ভিড় ভাবেননি। ভাবতেন বিবেক। একটি জেগে ওঠা বিবেক। হাদি বলতেন, ‘যে তরুণ প্রশ্ন করে না, সে নিরাপদ হতে পারে; কিন্তু মুক্ত নয়।’ এ কথায় অনেকে অস্বস্তি বোধ করত। ক্ষমতা ভয় পেত।
তিনি তরুণদের শুধু প্রতিবাদ করতে বলেননি। ভাবতে বলেছেন। পড়তে বলেছেন। নিজেদের ভুল ধরতে বলেছেন। ‘ফ্যাসিবাদ শুধু ক্ষমতায় থাকে না’ হাদি বলতেন, ‘ফ্যাসিবাদ ঢুকে পড়ে আমাদের চিন্তার ভেতর।’ এই সতর্কতা ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক। তরুণরা হাদিকে নেতা হিসেবে দেখেনি প্রথমে। দেখেছে নিজের মতো একজন মানুষ হিসেবে। একই রাগ। একই স্বপ্ন। একই অসম্মতি। তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘আমরা কাউকে উৎখাত করতে চাই না। আমরা মিথ্যাকে উৎখাত করতে চাই।’ এই কথায় তরুণরা নিজেদের খুঁজে পেত।
হাদির সাথে তরুণদের সম্পর্ক ছিল অনুভবের। আদেশের নয়। তিনি বলতেন না- এভাবে করো। বলতেন- এই প্রশ্ন নিজেকে করো। তাই তার মৃত্যু তরুণদের কাছে শুধু শোক নয়। এটি বিশ্বাসভঙ্গের মতো। কারণ তারা ভেবেছিল- কথা বললে ঝুঁকি আছে; কিন্তু গুলি নয়। আজ তরুণরা হাদিকে শহীদ হিসেবে দেখছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি- একটি অসমাপ্ত কথার প্রতীক হিসেবে। হাদি তাদের শিখিয়েছেন ভয়কে অস্বীকার করতে। কিন্তু সহিংসতা নয়। তিনি বলতেন, ‘রাগ যদি বিবেক না পায়, সে নিজে ফ্যাসিবাদ হয়ে যায়।’ এ শিক্ষা আজ আরো প্রাসঙ্গিক।
তরুণরা জানে, হাদির পথ সহজ নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয়। কারণ হাদি তাদের দেখিয়েছেন, তরুণ হওয়া মানে শুধু বয়স নয়। তরুণ হওয়া মানে প্রশ্নে বেঁচে থাকা। হাদি ছিলেন জুলাইয়ের সন্তান। আর জুলাই- এখনো শেষ হয়নি। অনেকে বলছেন, এ হত্যাকাণ্ড ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। স্বাভাবিক। কারণ রাজনীতি শূন্যতায় চলে না। রক্তের ওপর দিয়ে চলে। হাদির মৃত্যু রাজনীতিকে আরো তীক্ষè করেছে। রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়িয়েছে। আস্থা কমিয়েছে।
কারা লাভবান হবে- এ প্রশ্নও উঠছে। কারণ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর কেউ না কেউ সুবিধা নেয়। ক্ষমতার হিসাব মেলে। বয়ান তৈরি হয়। এই বয়ান তৈরিতে টকশো ও সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা কি নির্দোষ? না। ঘৃণামূলক বক্তব্য কি পরিবেশ তৈরি করেনি? করেছে। একটি কণ্ঠকে ‘উগ্র’ বলা সহজ। তারপর তাকে মানুষ না ভেবে নিশানা করা- সবচেয়ে সহজ। এই সহজ পথ সমাজকে কঠিন বিপদে ফেলে।
হাদিকে হত্যা করে কাদের ভয় দেখানো হলো? একজন ব্যক্তিকে? না পুরো একটি প্রজন্মকে? যারা কথা বলে। যারা প্রশ্ন তোলে। যারা মাথা নত করে না। এ হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপড়েনও বাড়িয়েছে- এ কথা অস্বীকার করা যায় না। তরুণদের মধ্যে ভারতবিরোধিতা বেড়েছে। অবিশ্বাস ঘন হয়েছে। কারণ ভারতের সাম্প্রতিক আচরণে একটি পুরনো প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে- ৫ আগস্টের বিপ্লবকে তারা মেনে নিতে পারছে কি? অনেকে মনে করেন, পারছে না। এর দায় তারা তরুণদের ওপর চাপায়।
এখানেই বিপদ। কারণ যখন মিথ্যা অভিযোগে, অসৎ বয়ানের মাধ্যমে তরুণদের দায়ী করা হয়, তখন তরুণরা প্রতিক্রিয়া দেখায়। প্রতিক্রিয়া যুক্তি মানে না। প্রতিক্রিয়া আবেগে চলে। হাদির মৃত্যু সেই আবেগকে উসকে দিয়েছে। তাই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বিচারের দায়িত্ব। স্বচ্ছতার দায়িত্ব।
হাদি তরুণদের চিন্তার জগৎ পাল্টাতে চেয়েছিলেন। স্লোগানে নয়। ব্যানারে নয়। বইয়ে। ইনকিলাব মঞ্চের অফিসে ঢুকলে প্রথমে চোখে পড়ে না কোনো দলীয় পতাকা। চোখে পড়ে বই। দেয়ালে। টেবিলে। মেঝেতেও। এটি সাজসজ্জা নয়, এটি অবস্থান। হাদি বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব আগে মাথায় ঘটে। তারপর রাস্তায় নামে। তিনি জানতেন; চিন্তা ছাড়া আন্দোলন অন্ধ। অন্ধ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে খেয়ে ফেলে। তাই তিনি তরুণদের আগে পড়তে বলতেন। তর্ক করতে বলতেন। নিজের সাথে দ্ব›েদ্ব যেতে বলতেন। তিনি ইচ্ছা করেই কোনো রাজনৈতিক ব্যানারে নাম লেখাতে চাননি। তিনি জানতেন, রাজনৈতিক ব্যানার মানুষকে শক্তি দেয়, আবার ছোট ঘরে ঢুকিয়েও ফেলে। হাদি ভালোভাবে জানতেন, রাজনৈতিক দলে একবার নাম লেখালে, প্রশ্ন করার জায়গা সঙ্কুচিত হয়। এই সঙ্কোচন তিনি ভয় পেতেন।
তিনি দেখেছেন, দল তৈরি হয়। তারপর স্বার্থ তৈরি হয়। তারপর সত্য চাপা পড়ে। হাদি সেই পথ এড়াতে চেয়েছেন। স্বতন্ত্র থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। এটি ছিল তার দর্শন। একলা নায়ক হতে চাননি। আবার দলে হারিয়েও যেতে চাননি। তিনি জানতেন, একলা থাকলে তুমি দুর্বল। ভিড়ে হারালে তুমি মিথ্যা। এ দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়ানো কঠিন। হাদি সেই কঠিন জায়গাটি বেছে নিয়েছিলেন। তরুণদের শেখাতে চেয়েছেন- নিজের মত ধরে রাখার সাহস। আবার অন্যের কথা শোনার ধৈর্য। ইনকিলাব মঞ্চ তাই কোনো ‘পার্টি অফিস’ নয়। একটি ভাবনার ঘর। খোলা। প্রশ্নে ভরা। সেখানে সবাই একমত হয় না। হাদি তাই চাইতেন। তিনি জানতেন, যেখানে সবাই একমত, সেখানে চিন্তা মরে যায়। এ কথা অনেকের পছন্দ হয়নি। ঐক্যের নামে সবাই আসলে নিয়ন্ত্রণ চায়।
হাদি নিয়ন্ত্রণ চাননি। চেয়েছেন সচেতনতা। তাই তার রাজনীতি ছিল ধীর। গভীর এবং কায়েমি স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক। কারণ সচেতন তরুণকে শাসন করা কঠিন। হাদি জানতেন- বিপ্লব এক দিনের নয়। এটি দীর্ঘ প্রস্তুতি। বই দিয়ে শুরু। প্রশ্ন দিয়ে চলা। আর বিবেক দিয়ে শেষ- যদি কখনো শেষ হয়। হাদি সেই যাত্রা শুরু করেছিলেন।
ইতিহাসে শরিফ ওসমান হাদি কিভাবে স্মরণীয় হবেন? আধিপত্যবাদের বিরোধী মুখপাত্র হিসেবে? একজন বিপ্লবী হিসেবে? না একজন শহীদ হিসেবে? সম্ভবত- তিনটিই। তিনি ছিলেন এমন এক সময়ের সন্তান, যখন কথা বলা ছিল ঝুঁকি। চুপ থাকা ছিল সুবিধার। তিনি ঝুঁকি বেছে নিয়েছিলেন। হাদি স্মরণীয় হবেন তার কণ্ঠের জন্য। তার কাজের জন্য। তার তির্যক প্রশ্নের জন্য। তার অটল অবস্থানের জন্য। আর স্মরণীয় হবেন এ কারণে- তাকে হত্যা করেও প্রশ্ন থামানো যায়নি।
আজ তরুণরা শোক করছে। কিন্তু শোকের ভেতরে ক্ষোভ। ক্ষোভের ভেতরে প্রতিজ্ঞা। এ প্রতিজ্ঞা যদি সহিংসতায় যায়- দেশ হারবে। আর যদি ন্যায়বিচারের পথে যায়- দেশ জিতবে। হাদির রক্ত আমাদের সামনে একটি আয়না ধরেছে। এ আয়নায় আমরা কী দেখতে চাই- সেটিই এখন সিদ্ধান্তের বিষয়। কারণ ইতিহাস লেখা হয় রক্তে। কিন্তু ভবিষ্যৎ লেখা যায় বিবেক দিয়ে। হাদি চলে গেছেন। প্রশ্ন রেখে গেছেন। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। নইলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না কাউকে।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন



