ঘ্রাণে অর্ধভোজন

২০২২ সালে আমি সুইডেনে যাই। ৩০ এপ্রিল ‘এরিক্সহেল্পেন সেকেন্ড হ্যান্ড’ নামীয় একটি সেকেন্ড হ্যান্ড মালের দোকানে গিয়েছিলাম। শৈশবে বাতাকান্দী বাজার থেকে শুরু করে ঢাকার বাংলাবাজার, পল্টন, নিউমার্কেটের নীলক্ষেত সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের অধিকাংশ দোকানদার আমার পরিচিত। মজ্জাগত রোগটা দেখা দেয় সুইডেন ‘এরিক্সহেল্পেন সেকেন্ড হ্যান্ড’ দোকানে প্রবেশের সাথে সাথে। চোখধাঁধানো সব সামগ্রী। সব পণ্য পানির দাম বিক্রি হয় এখানে। একটি স্কিনের চেয়ার থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। চেয়ারের ওপর হাত রেখে মেয়েকে বললাম, আমার সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে এরিক্সহেল্পেন সেকেন্ড হ্যান্ডের সব সামগ্রী জাহাজে করে দেশে নিয়ে যেতাম

আমার তিন মেয়ে। তিনজন ইউরোপের তিন দেশে প্রবাসী। তারা দেশে আসে খুব কম। তাতে আক্ষেপ নেই। কারণ যেকোনো সময় যে কারো সাথে কথা বলতে পারি, প্রয়োজনে ভিডিওকলের মাধ্যমে দেখা হয়। স্বদেশে আসতে ভয় পায়। স্বৈরাচারের পতনের পরও দেশে আসতে তাদের ভীতি রয়েছে।

চোখের আড়াল হলেও আল্লাহর ইচ্ছায়, তিন মেয়ে বিদেশে স্বস্তিতে আছে। ঘ্রাণে অর্ধভোজনের মতো স্বস্তির দেশের স্বস্তির গল্প শুনলেও স্বস্তি পাই।

হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে হাঁড়ির খবরও জানা বাদ থাকে না। পয়লা মে বন্ধ ছিল। বাসায় ছিলাম। একে একে সবার খোঁজ নিতে শুরু করি। প্রথমে ফোন করি সুইডেন। যে দেশ প্রতি বছর শান্তির তালিকায় প্রথম দশের ঘরে থাকে। প্রবাসী ছোট মেয়েকে জিজ্ঞাসা করি, কি নাশতা করেছ? তার জবাব, ডিম বাজি দিয়ে রুটি। জিজ্ঞাসা করি, তোমাদের এখানে ডিম কত করে? মেয়ে বলে, প্রতিটি ৩০ টাকা। পরবর্তী প্রশ্ন ডিম কি বাইরে থেকে আসে? উত্তর দেয়, এটি স্থানীয় পণ্য।

সুইডিসরা স্থানীয় পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয় বেশ কয়েকটি কারণে ১. টেকসইতা স্থানীয় কৃষি পরিবহনজনিত কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করে। এটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির সাথে সুইডেনের জলবায়ু লক্ষ্যগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২. গুণগতমান ও নিরাপত্তা সুইডিস কৃষিপণ্য উচ্চমানে পরিচিত, যেখানে কীটনাশক ব্যবহার কম, ভোক্তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ। ৩. গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সমর্থন স্থানীয় কৃষকদের অগ্রাধিকার দেয়া গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং কৃষক সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখে, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ৪. স্বাদ ও সতেজতা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলোর সুইডেনের অনন্য নর্ডিক আবহাওয়ার সুবিধা থাকে, যা ফল এবং সবজির স্বাদ ও ঘ্রাণকে উন্নত করে। ৫. খাদ্য নিরাপত্তা স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহিত করলে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমে যায়, যা একটি স্থিতিশীল এবং আত্মনির্ভর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে। এসব কারণে সুইডেনের টেকসইতা, স্বাস্থ্য ও সম্প্রদায়ের মঙ্গল নিশ্চিত করে।

দ্বিতীয়ত, সুইডেন স্ক্যান্ডিনেভিয়াভুক্ত দেশ। পার্শ্ববর্তী নরওয়ে, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ডও স্ক্যান্ডিনেভিয়াভুক্ত। যে দ্রব্য সুইডেনে উৎপন্ন হয় না কিংবা অভাব দেখা দেয় সে দ্রব্য পার্শ্ববর্তী স্ক্যান্ডিনেভিয়াভুক্ত দেশ থেকে সহজে আনা যায়। স্ক্যান্ডিনেভিয়াভুক্ত ছাড়াও সুইডেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২৮। এর সদর দফতর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। দেশগুলো ১৯৯২ সালে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তির শর্তানুসারে ইউরোপের কোনো দেশের নাগরিকের ইউরোপের অপর কোনো দেশে যেতে ভিসা করা লাগে না। এ ছাড়া ইউরোপের কোনো দেশের জনগণ পুরো ইউরোপে একই কারেন্সি (ইউরো) দিয়ে লেনদেন করতে পারেন। ইউরোপের অনেক দেশে যৌথ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই। নেই কোনো সীমান্ত পাহারার ব্যবস্থা।

ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সীমানা পারাপারে বাধা-বন্ধনহীনসহ আরো অনেক সুবিধা আছে, যেমন যে দ্রব্য সুইডেনে নেই সেই দ্রব্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে সহজে আনা-নেয়া করা যায়। প্রতিরক্ষা খাতেও নামমাত্র খরচ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের যেকোনো নাগরিক পকেটে একটি ক্রেডিট কার্ড নিয়ে নিজের দেশের মতো স্বাধীনভাবে ইইউভুক্ত ২৮টি দেশে ঘোরাফেরা ও অবস্থান করতে পারেন। আবশ্যকীয় দ্রব্য স্ক্যান্ডিনেভিয়াভুক্ত দেশে পাওয়া না গেলে ইইউভুক্ত কোনো না কোনো দেশে অবশ্যই পাওয়া যায়। আর সেই কারণে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হ্রাস বৃদ্ধি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতা যে কী এক অস্বস্তিকর যন্ত্রণা তা বাংলাদেশে বাস না করলে টের পাওয়া যায় না। ইউরোপের বর্তমান লোক সংখ্যা প্রায় ৭৪ কোটি ৩০ লাখ। বিশ্বের মোট লোকসংখ্যার ১১ শতাংশ। অস্থির বাজার মূল্যে দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত তখন বিশ্বের ১১ শতাংশ লোক স্বস্তির নিদ্রায় মগ্ন।

ইউরোপের মাথায় যে চিন্তা ঢুকেছিল নব্বইয়ের দশকে সে চিন্তা এশীয়দের মাথায় ঢুকেছিল আশির দশকে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সংক্ষেপে সার্ক) দক্ষিণ এশিয়ার একটি আঞ্চলিক সংস্থা। এর সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটান এ সাত দেশ নিয়ে সার্কের যাত্রা শুরু, পরে যুক্ত হয় আফগানিস্তান। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা নেতারা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা করার লক্ষ্যে এক সনদপত্রে আবদ্ধ হন। আমরা এমনও শুনেছিলাম, সার্কভুক্ত দেশ ইইউভুক্ত দেশের মতো অভিন্ন কারেন্সিসহ চলাচলে পাসপোর্ট-ভিসা লাগবে না। ইউরোপ ও এশীয়দের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সামষ্টির ও একক। ইউরোপীয়রা যেখানে সামষ্টিক অর্থনীতিতে আস্থাশীল সেখানে এশীয়রা চিন্তা করে এককভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তদুপরি সংস্থায় ছিল চির বৈরী দুই পরাশক্তি ভারত ও পকিস্তান। সে কারণে এই সংস্থা কখনো কার্যকর হতে পারেনি।

এরিক নিলসনের গল্প : ২০২২ সালে আমি সুইডেনে যাই। ৩০ এপ্রিল ‘এরিক্সহেল্পেন সেকেন্ড হ্যান্ড’ নামীয় একটি সেকেন্ড হ্যান্ড মালের দোকানে গিয়েছিলাম। শৈশবে বাতাকান্দী বাজার থেকে শুরু করে ঢাকার বাংলাবাজার, পল্টন, নিউমার্কেটের নীলক্ষেত সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের অধিকাংশ দোকানদার আমার পরিচিত। মজ্জাগত রোগটা দেখা দেয় সুইডেন ‘এরিক্সহেল্পেন সেকেন্ড হ্যান্ড’ দোকানে প্রবেশের সাথে সাথে। চোখধাঁধানো সব সামগ্রী। সব পণ্য পানির দাম বিক্রি হয় এখানে। একটি স্কিনের চেয়ার থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। চেয়ারের ওপর হাত রেখে মেয়েকে বললাম, আমার সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে এরিক্সহেল্পেন সেকেন্ড হ্যান্ডের সব সামগ্রী জাহাজে করে দেশে নিয়ে যেতাম।

‘এরিক্সহেল্পেন সেকেন্ড হ্যান্ড’ যার অর্থ এরিকের সাহায্যের পুরনো দোকান। এক কথায় ‘চ্যারিটি ফাউন্ডেশন’ বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। অনেকে এখানে এসে স্বল্পমূল্যে কিংবা বিনামূল্যে দান করতে মালামাল রেখে যায়।

এরিক নিলসন একটি শিশুর নাম। ১৯৪০ সালে সুইডেনের স্মাল্যান্ডের রুদা নামক স্থানে জন্ম। ছোটবেলা থেকে তিনি হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন, যার কারণে তাকে প্রায়ই হাসপাতালে কাটাতে হতো। কিন্তু এ দুঃখের মধ্যেও তিনি অন্যদের বিশেষ করে তার মতো অসুস্থ এবং একাধিক শিশুর জন্য সুখ আনতে চেয়েছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে এরিক হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের জন্য চিঠি এবং ছোট উপহার পাঠাতে শুরু করেন।

এরিকের এ উদ্যোগ ১৯৪৬ সালে ‘এরিক্সহেল্পেন’ নামের একটি বৃহৎ সংগঠনের জন্ম হয়। ভালোবাসা ও আশার ভিত্তিতে এরিক এমন একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যা বঞ্চিত শিশুদের সাহায্য করতে পারে। এরিক লিনসন ৩৭ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে মারা যান। কিন্তু তার স্ত্রী উল্লা নিলসন এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন। পরে তার উত্তরাধিকাররা এখনো বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সুরক্ষার কাজ করে যাচ্ছেন।

‘এরিক্সহেল্পেন’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসূচি পরিচালনা করে। বিশেষত আফ্রিকা, এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের ১৬টি দেশে সক্রিয়।

‘এরিক্সহেল্পেনের’ উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকল্প :

১. মেয়েদের জন্য শিক্ষা, উপকূলীয় এলাকায় আটটি নতুন স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ‘এরিক্সহেল্পেন’। এসব স্কুল মেয়েদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার কমানো এবং টেকসই শিক্ষা প্রদান, যেমন সৌরশক্তি চালিত সুবিধা, নিশ্চিত করার লক্ষ্য রাখে।

২. ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন : ঘূর্ণিঝড় রেমনের আঘাতের পর ‘এরিক্সহেল্পেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি সহায়তা কার্যক্রম শুরু করেছে। এর মধ্যে ঘর পুনর্নির্মাণ, কৃষি ও ছোট ব্যবসায়গুলোর পুনরুদ্ধারে সাহায্য প্রদান অন্তর্ভুক্ত।

৩. দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন : বন্যাপ্রবণ সম্প্রদায়গুলোকে দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং স্থায়িত্ব উন্নত করতে এরিক্সহেল্পেন কাজ করে। শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়।

৪. সংস্থাটি বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় রেমনের পর একটি জরুরি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ঘূর্ণিঝড়টি দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি করেছিল, যেখানে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া ৪০ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। এরিক্সহেল্পেন স্থানীয় অংশীদার সংস্থা সিওডিইসির সাথে মিলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য সহায়তা দিয়েছে। এ কার্যক্রমের মধ্যে ছিল ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত ও পুনর্নির্মাণ। কৃষি ও মৎস্যশিল্পে সহায়তা প্রদান। ছোট ব্যবসায়গুলোর পুনরুদ্ধারে সহায়তা।

পুরনো পণ্যের দোকান : সুইডেনে সংস্থাটির পুরনো পণ্যের দোকানগুলো থেকে সংগৃহীত অর্থ নিজেদের আন্তর্জাতিক প্রকল্পগুলোতে ব্যয় করা হয়। এরিক্সহেল্পেন কাজের মূলমন্ত্র হলো স্থানীয় অংশীদারত্বের মাধ্যমে শিশুদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক

[email protected]