জনরোষকে মব বলা হচ্ছে

মানুষের মনে দীর্ঘ দিনের ধূমায়িত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। সেই ক্ষোভের কিছু বহিঃপ্রকাশতো হবে। নুরুল হুদাদের মতো অপরাধীদের পেলে সেটি বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক। তারা তো বিচার হাতে তুলে নিচ্ছে না; যারা তাদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে, অপমান করেছে, তাদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছে। একে মব বলে ঘৃণা করতে পারে তারা যারা আসলে ফ্যাসিবাদী শক্তির দোসরদের কোনো অপরাধ চোখে দেখে না।

লেখক : জসিম উদ্দিন
লেখক : জসিম উদ্দিন |নয়া দিগন্ত

ভোটাধিকার হরণকারী কে এম নুরুল হুদাকে পাকড়াও করে জনতা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এই সময় জনতা বেপরোয়া হলেও তাকে মারধরের ঘটনা ঘটেনি। তিনি আহত কিংবা শারীরিক ক্ষতির শিকার হননি। জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করে যেভাবে তাকে অপমান করা হয়েছে সেটি দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে তার সীমাহীন অপরাধের কারণে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। নাগরিক অধিকারকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার সময় হুদারা সামান্য চিন্তাও করেননি; বরং তারা জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হাসিঠাট্টা করেছেন। মানুষকে গরু-ছাগলের মতো ভেবেছেন। তার পরও যে লাঞ্ছনা ও অপমান তাকে করা হয়েছে তা যথার্থ বলা যাবে না। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে পুলিশকে ক্ষুব্ধ জনসাধারণকে বিরত রাখতে হবে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যতই থাকুক, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের মানুষ বিপুল ধৈর্যের পরিচয় দেয়ায় বড় বড় অপরাধীরা প্রকাশ্যে মারধর ও প্রাণহানি থেকে বেঁচে গেছে। হাসিনার ফ্যাসিবাদে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশের মানুষ এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে।

হুদার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়ায় বেজায় ক্ষেপেছে বাংলাদেশের মিডিয়ার একটি অংশ। আওয়ামী মিডিয়া সিন্ডিকেট এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে চড়াও হয়েছে জনতার ওপর। তারা জনরোষকে ‘মব’ বলে ক্ষুব্ধ জনতাকে দমন করার ফন্দিফিকির শুরু করেছে। প্রথম দিন হুদার প্রতি দয়া দেখানো মিডিয়া সিন্ডিকেটের সংখ্যা ছিল অল্প কয়টি। ফ্যাসিবাদের পীড়নে কোণঠাসা যে সামান্য ক’টি পত্রিকা ছিল পরের দিন সেগুলো ছাড়া বাকি সবাই প্রথম পাতায় ঢাউস রিপোর্ট করেছে মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে। যদিও এটি জাস্টিস ছিল না, পুলিশের হাতে জাস্টিসের জন্য হুদাকে জনতা সোপর্দ করেছিল। এ নিয়ে মিডিয়ার বিচার-বিশ্লেষণ দেখলে মনে হবে, ক্ষুব্ধ জনতা এক মহা অন্যায় করে ফেলেছে। অচিরেই তাদের বিচারের আওতায় না আনলে জাতির সর্বনাশ হয়ে যাবে। অন্তর্বর্তী সরকারও তাদের চাপে বিবৃতি দিয়ে বসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের প্রতি সাড়া দিয়ে ‘মবের’ বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি সবাই একই লাইনে গলা চড়িয়েছেন। ইতোমধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অথচ গত এগারো মাসে বিএনপির নিজেদের মধ্যে সঙ্ঘাতে যে শতাধিক মানুষ মারা গেছে তা নিয়ে কোনো কথা নেই।

পাড়ায়-মহল্লায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যারা অবনতি ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। হুদা নিজে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, তার বিপুল সম্পদ আছে। কারান্তরীণ হলেও সেখানে ডিভিশন পেয়ে রাজার হালে থাকবেন। তার জন্য এসির ব্যবস্থা থাকবে, রাজকীয় খাবার থাকবে। তিনি যে অপরাধ করেছেন তার যে উচিত বিচার হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। অথচ যারা তার দ্বারা অধিকারহারা হলো তারাই ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে এখন বিচারের মুখোমুখি।

এ বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে, দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনে জনগণ মর্মে মর্মে পিষ্ট হয়েছে। তাদের এই ক্ষোভ প্রশমন হতেও তাই দীর্ঘ সময় লাগবে। তবে এর আগে জনগণের অধিকার যারা হরণ করেছে তাদের বিচার হতে হবে। এখন পর্যন্ত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। হাসিনা পালানোর পর প্রায় এক বছর লেগে গেল হুদাকে গ্রেফতার করতে। আরো অসংখ্য ভয়াবহ-অপরাধী রয়েছে যারা হাসিনার আঁচলের নিচে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাদের বেশির ভাগকে আইনের আওতায় আনা যায়নি; বিচার তো বহু দূরের কথা। এ অবস্থায় ভুক্তভোগীদের শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করার কারণে তাদের ‘মব’ বলে গালি দেয়া হচ্ছে। খবর বিশ্লেষণ ও সম্পাদকীয় লিখে আওয়ামী মিডিয়া হইচই ফেলে দিয়েছে।

বাস্তবতা হচ্ছে- মব সবসময় নিপীড়ক। তারা শক্তিশালী ও অবৈধ ক্ষমতার পক্ষের লোক হয়। তাদের একটি সুনির্দিষ্ট স্বার্থ থাকে। সমাজের অধিকারহারা গোষ্ঠী সাধারণত মব হয় না। আবার উত্তেজিত বিশৃঙ্খল জনতাই কেবল মব তৈরি করে না। মব তৈরি করে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। এই মবকে আমরা হাসিনার পুরো সময়ে দেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে এই মবের সংগঠক ছিল দেশের মূল ধারার মিডিয়া। প্রথম ভয়াবহ মব আমরা দেখি শাহবাগে। এটি এমন এক মব ছিল যেটি দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে নিজের রায় পাল্টে মৃত্যুদণ্ড দিতে বাধ্য করেছিল। শাহবাগের সংগঠক ছিল বামপন্থীদের একটি গ্রুপ। পরে একে জমিয়ে দিয়েছিল আজ যারা নুরুল হুদাকে অপমান করায় কষ্ট পাচ্ছে সেই মিডিয়া। তারা তখন জল্লাদ হয়ে উঠেছিল। দিনের পর দিন শাহবাগ নিয়ে সীমাহীন প্রচারণা চালিয়েছে। অথচ দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ বোগাস। ফরিদপুরের কাদের মোল্লাকে মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লা বানিয়ে ইতিহাসের এক জঘন্য প্রহসন তারা বানিয়েছে। এরপরে যুদ্ধাপরাধ আদালতে আরো পাঁচটি বিচারিক হত্যা হয়েছে, এগুলোর সবগুলোর দায় মব সৃষ্টিকারী মিডিয়াকেও নিতে হবে। রাস্তায় তৈরি হওয়া মবে মানুষ অপমানিত লাঞ্ছিত হয়, কিন্তু মিডিয়া সৃষ্টি করা মব একটি পুরো জাতিকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে, তার প্রমাণ শাহবাগ।

মিডিয়া নুরুল হুদার বিরুদ্ধে মব সৃষ্টি করার যে প্রচারণা চালাচ্ছে- এ ধরনের অসংখ্য মব বিগত সরকারের সময় সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা দেখেছি, একবার অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ রক্তাক্ত শরীরে ছেঁড়া পাঞ্জবি নিয়ে বিএনপির সভায় হাজির হলেন। সেখানে বেগম খালেদা জিয়াও উপস্থিত ছিলেন। তাকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা মব সৃষ্টি করে রাস্তায় পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। মিডিয়া এ মারধরের খবর প্রচার করেছিল। কিন্তু এই মবের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পায়নি অথবা বলেনি। একই ধরনের মবের শিকার খালেদা জিয়া নিজেও হয়েছিলেন। কারওয়ান বাজারে তার গাড়িবহরে হামলা চালান হয়েছিল। তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত লেকেরা মারধরের শিকার হন, তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এমনকি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকবার মবের শিকার হয়েছেন। এগুলোকে মিডিয়া মব বলেনি।

দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক বৃদ্ধ আবুল আসাদকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ তার অফিসে গিয়ে জঘন্যভাবে লাঞ্ছিত করে। তারা তাকে সম্পাদকের চেয়ার থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে দেয়। মব নিয়ে যারা আজ এত সচেতন তখন এই সাংবাদিকরা কোথায় ছিলেন? প্রতিবাদ করা দূরে থাক, তারা এমনকি খবরটি প্রকাশ করতেও লজ্জা পেয়েছে। তাকে বছরের পর বছর জেলে আটক নিয়েও এদের কখনো টুঁ শব্দ করতে দেখা যায়নি। আমার দেশের সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানকে কুষ্টিয়ায় আদালত প্রাঙ্গণে একদল আওয়ামী পান্ডা মেরে রক্তাক্ত করেছিল। এটি তখন মিডিয়ার কাছে কেবলই একটি মারধরের ঘটনা ছিল। এভাবে শত শত মবের ঘটনা সেই সময় ঘটেছে। এগুলো ঘটিয়েছে ক্ষমতায় যারা ছিল তারা। এর মাধ্যমে তারা নানা স্বার্থসিদ্ধি করেছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে তখন পদপদবি বাগিয়ে নেতা হতো। কেউ এতে নগদ লাভবান হতো। যারা এমন নির্মম বেদনাদায়ক কাজে শরিক হতো তাদের ক্যারিয়ারে এটি একটি স্থায়ী যোগ্যতা হিসেবে থেকে যেত। হাসিনা তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করতেন। তখন যারা মবের আয়োজন করেছিল, এরা কেউ নির্যাতিত বঞ্চিত ছিল না; বরং ছিল সরকারের লোক, সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণী। আজকে নুরুল হুদাকে অপমানিত করেছে ভোটাধিকারবঞ্চিত জনতা।

নুরুল হুদা নামা

দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করেছে, রাতের ভোটের কারিগর জনতার হাতে আটক। প্রথম পৃষ্ঠার উপরের দিকে বক্স করে গুরুত্ব দিয়ে পত্রিকাটি তার গ্রেফতারের খবরটি প্রকাশ করেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তার গলায় জুতার মালা পরানো। ক্ষুব্ধ জনতা তার আগে তাকে ঘরের ভেতর থেকে ধরে নিয়ে এসে জুতাপেটা করে।

একটি মিডিয়া লিখেছে, ‘সাবেক সিইসি নুরুল হুদার বাসায় মব তৈরি করা হয় সন্ধ্যার দিকে। এ ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তাতে দেখা যায়, নুরুল হুদা সাদা একটি টিশার্ট ও লুঙ্গি পরা। তাকে ঘিরে রয়েছেন একদল লোক। তারা নুরুল হুদাকে একটি জুতার মালা পরিয়েছেন। এক ব্যক্তিকে জুতা দিয়ে তাকে আঘাত করতেও দেখা যায়। পাশেই পুলিশ দাঁড়ানো। ভিডিওতে আরো দেখা যায়, কেউ কেউ নুরুল হুদাকে ডিম ছুড়ে মারছেন এবং নানাভাবে তাকে হেনস্তা করছেন।’

প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে- হাসিনা গুম খুন আয়নাঘর সংস্কৃতি চালু করতে পেরেছেন এ ধরনের একদল অবিবেচক ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকদের জন্য। তারা ফ্যাসিবাদকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে পরিপুষ্ট না করলে জনগণকে ভোটাধিকার হরণসহ নারকীয় পীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না। নুরুল হুদা একজন মানুষ কিংবা অল্প কিছু মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ করেননি। তিনি ১৭ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন। তার ওপর মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে তখন যা-তা বলেছিলেন তাতে পুরো জাতিকে অপমান-অপদস্থ করতে সামান্যতম দ্বিধা করেননি তিনি। হাসিনার খুনি বাহিনী তাকে রক্ষা না করলে নুরুল হুদার মতো লোকেরা জনতার হাতে বহু আগে গণধোলাইয়ের শিকার হতে পারতেন। এদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার ব্যবস্থা করা না গেলে আবারো নতুন হাসিনার জন্ম হবে। আবারো জন্ম হবে নতুন নতুন নুরুল হুদার।

রাজনৈতিক দল সুশীলসমাজ ও ভোটারদের বিরোধিতার তোয়াক্কা না করে নুরুল হুদা চার হাজার কোটি টাকার ইভিএম মেশিন কেনেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে তদন্ত করে দেখা গেল, প্রতি তিনটি মেশিনের একটি ত্রুটিপূর্ণ। বিপুলসংখ্যক যন্ত্র এখন নির্বাচন কমিশনের গলার কাঁটা। এগুলো অকেজো, নষ্ট হলেও নির্বাচন কমিশন ও আঞ্চলিক অফিসগুলোর বিপুল জায়গা দখল করে আছে। একটি মেশিন দুই লাখ ৩৪ হাজারের কিছু বেশি টাকা দিয়ে তখন দেড় লাখ মেশিন কেনা হয়। এই দাম আমাদের আশপাশের দেশের তুলনায় কয়েকগুণ।

দেশের ৪২ জন নাগরিক ২০২০ সালে ১৪ ডিসেম্বর নুরুল হুদার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ তোলেন। নির্বাচনের দায়িত্বে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষক হিসেবে দ্ইু কোটির বেশি টাকা তিনি নেন অবৈধভাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে চার কোটি আট লাখ টাকা ভাগাভাগি করে নেন। তিনি অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন বিলাসবহুল গাড়ি।

সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কে এম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে বিএনপি মামলা করেছে। এরা দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করেন। এরা ছিলেন হাসিনার শিখণ্ডি, নির্বাচন কমিশন অফিসকে রাবার স্ট্যাম্প বানিয়েছিলেন। সারা দেশে হাসিনা একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন। কেন্দ্র থেকে হাসিনা এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা যাকেই সরকারের প্রতিনিধি বানাতে চাইতেন, মেম্বার-চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর-মেয়র, এমনকি সংসদ সদস্য বানাতে পারতেন। টাকা দিয়ে মেম্বার-চেয়ারম্যান বা স্থানীয় সরকারের যেকোনো সদস্যপদ কেনা যেত। সরকার একটি কোটা বেঁধে দিত। এর ভাগিদার হতো দলের প্রভাবশালী নেতা, পুলিশের কর্তারা, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা। হাসিনার অধীনে থাকা এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বার বানিয়ে দিতেন। এর বিনিময়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাতেন। এ দিকে নির্বাচন কমিশন সদস্যদের দায়িত্ব ছিল ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বলে মিডিয়ায় বক্তৃতা দেয়া। বাংলাদেশের নির্বাচন আমেরিকার চেয়েও ভালো হয় বলে হুদা একবার দাবি করেন।

জুলাই বিপ্লবে মূল ধারার মিডিয়ার

তেমন ভূমিকা নেই

গণতন্ত্র হরণ করে ফ্যাসিবাদ নির্মাণে এ দেশের মূল ধারার মিডিয়া যতটা সহযোগী হয়েছে তার কানাকড়িও তারা দেশ উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। বর্বর শাসন থেকে দেশকে উদ্ধার করেছে দীর্ঘ দেড় যুগ গুম-খুনের শিকার, আয়নাঘরে নির্মম নির্যাতনে পিষ্ট, অন্যায়ভাবে মামলার শিকার ভোটবঞ্চিত কোটি কোটি মানুষ। ছাত্র-জনতার রূপ ধরে তারাই রাস্তায় বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে। এদের সংগঠিত করতেও মূল ধারার মিডিয়া কোনো ভূমিকা রাখেনি; বরং মিডিয়ার বিরাট অংশ সরকারের দমননীতির পক্ষে ছিল, সাংবাদিকরা স্পট থেকে আন্দোলনকারীদের ধরিয়ে দেয়ার জঘন্য কাজও করেছেন। মূলত সামাজিক মাধ্যমে লাখ লাখ দেশপ্রেমিক মানুষ অ্যাক্টিভিজম করে রাস্তায় কোটি মানুষের সুনামি তৈরি করেছিল। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে না পারা মানুষের ক্ষোভ কতটা হতে পারে- এই মিডিয়া ধারণাও করতে পারে না।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলেছিলেন, হাসিনা ক্ষমতা হারালে লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হবে। অনেক নেতাই এই ভবিষ্যদ্বাণী তখন করতেন। কেন তারা এমন কথা বলতেন- একটু বিচার-বিশ্লেষণ করলে তার উত্তর আমরা পাবো। মূলত তারা জানত, কী পরিমাণ ভয়াবহ অন্যায় তারা জাতির বিরুদ্ধে করছিল। হাসিনার দলীয় লোকেরা পাড়া-মহল্লায়, হাটবাজারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের ছাড়া অন্যদের মানুষ বিবেচনা করেনি। যাকেই শত্রু গণ্য করেছে তাকে মারধর-অপমান করেছে, দরকার হলে খুন করেছে, কাউকে নিয়ে গেছে আয়নাঘরে। এর ওপর ছিল দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট ও মুদ্রাপাচার। মূলত এই বিশাল বঞ্চিত মানুষ যাদের বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে শৃঙ্খল পরিয়ে রাখা হয়েছিল ক্ষমতা, হারালে তারাই উৎপীড়কদের শায়েস্তা করবে- আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সেই আশঙ্কা করত। সে জন্যই সুযোগ পেলেই এ কথা জানিয়ে দলীয় লোকদের তারা সতর্ক করত।

ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগের ক’জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে- সেই প্রশ্ন এখন আলোচিত হচ্ছে। যেখানে একেবারে শেষ সময়ে এসে হাসিনা নিজেই দুই হাজার ছাত্র-জনতা হত্যা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও মানুষ যে সচেতনতা সতর্কতা ও আত্মসংযমের পরিচয় দিয়েছে সেটি নজিরবিহীন। অপরাধ অনুযায়ী তারা উৎপীড়কদের ওপর চড়াও হয়নি। খেয়াল রাখতে হবে, মানুষের মনে দীর্ঘ দিনের ধূমায়িত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। সেই ক্ষোভের কিছু বহিঃপ্রকাশতো হবে। নুরুল হুদাদের মতো অপরাধীদের পেলে সেটি বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক। তারা তো বিচার হাতে তুলে নিচ্ছে না; যারা তাদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে, অপমান করেছে, তাদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছে। একে মব বলে ঘৃণা করতে পারে তারা যারা আসলে ফ্যাসিবাদী শক্তির দোসরদের কোনো অপরাধ চোখে দেখে না।