বৈষম্য নিরসন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে রাজনৈতিক অঙ্গীকার

সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার-বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য ওয়াকফ ও হেবা আইনকে সহজীকরণ করতে পারে। সরকারের এমন আইন ও নীতি প্রণয়ন করা উচিত যাতে সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিরা মানবকল্যাণমূলক কাজে বেশি উৎসাহিত হন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় জাকাত, ওয়াকফ, সাদাকা প্রভৃতি ইসলামী সামাজিক অর্থায়নের সব ইনস্ট্রুমেন্ট সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা হলে সমাজে তার ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব
ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব |নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

ইতিহাসের পথ-পরিক্রমায় বাংলাদেশ জনপদের মানুষ রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের শিকার হয়েছেন বারবার। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বখতিয়ার খিলজির আগমনের আগে সেন বংশীয়দের জাতপ্রথা ও সংস্কৃত ভাষার উপদ্রবে এ জনপদের মানুষ দারুণভাবে নিষ্পেষিত হয়েছেন। এরপর মোগলরাও বাংলার প্রতি সুবিচার করেননি। প্রথমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশ সরকার প্রায় ২০০ বছর ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নিষ্পেষণ করে বাংলাদেশের জনগণকে নিঃস্ব ও দুর্ভিক্ষপীড়িত অবস্থায় পৌঁছে দেয়। একপর্যায়ে জমিদারি প্রথা চালু করে শোষণ ও পীড়নকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও জমিদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে পূর্ববাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানান। তারা আশা করেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে একটি ইনসাফপূর্ণ সমাজ কায়েম করবে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও রাজনৈতিক সরকার এমন সব নীতি গ্রহণ করেন, যাতে দেশটির দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ববাংলার জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়। প্রতিবাদী জনগণের ওপর স্টিমরোলার তথা গণহত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে’ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন ও অনুমোদন করা হয়। ওই সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়-

১. সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।

২. মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

সুতরাং এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশকে একটি শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা ছিল জনগণের অভিপ্রায় ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার। কিন্তু দীর্ঘ ৫৪ বছরে বহু কিছুর উন্নতি ও পরিবর্তন ঘটলেও শোষণ এবং বৈষম্যের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু চেষ্টা করে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও এখনো প্রায় দুই কোটি মানুষ দরিদ্র ও হতদরিদ্র অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন। এর প্রধান কারণ জনগণের সম্পদ বণ্টনে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে সমাজের কিছু লোকের হাতে সম্পদের বেশির ভাগ পুঞ্জীভূত হয়েছে। অন্য দিকে লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সম্পদের বৈষম্য শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী বৈষম্যের মাত্রা বাড়ছে। ২০২০ সালে এমআইটির প্রফেসর অলিভার ব্লানচার্ড ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড্যানি রড্রিক বলেন, ‘Inequality is widening, posing major moral, social and political challenges to which policymakers must react.’ বলা বাহুল্য, মুক্তবাজার অর্থনৈতিক পলিসি ও অর্থনীতিতে নৈতিক মাপকাঠির অনুপস্থিতির জন্য বৈষম্য সম্প্রসারিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের কথা ধরা যাক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, ‘... income inequality in Bangladesh has been on the rise and has reached a point where the emergent trends demand urgent and priority attention from the country’s policymakers.’

বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের তথ্যনুযায়ী, দেশের বিত্তবান ১০ শতাংশ মানুষ ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ সম্পদের মালিক। অপর দিকে ডেইলি স্টারের মতে- কম সম্পদশালী ৫০ শতাংশ মানুষ মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ সম্পদের মালিক। প্রথম আলো পত্রিকার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোটজাতীয় আয়ের ৪১ শতাংশের অধিকারী হচ্ছে উচ্চবিত্ত ১০ শতাংশ ব্যক্তি। পক্ষান্তরে, সমাজের নিম্নআয়ের ১০ শতাংশ লোক মোট জাতীয় সম্পদের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশের অংশীদার। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, সম্পদ সিঁড়ির উঁচু স্তরের ১০ শতাংশ লোকের হাতে দেশের মোট আয়ের ৩৮ দশমিক ৫০ শতাংশ রয়েছে। অপর দিকে সিঁড়ির নিচের ধাপের ৪০ শতাংশ লোকের হাতে মাত্র ১২-১৩ শতাংশ আয় রয়েছে।

উল্লিখিত তথ্য থেকে দেশে আয় ও সম্পদের ভয়াবহ বৈষম্যের একটি পরিষ্কার চিত্র দেখা যাচ্ছে। এরূপ বৈষম্য রাতারাতি হয়নি। বিগত ৫৩ বছরে ক্রমপুঞ্জীভূত হয়ে বর্তমান আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিগত ১৬ বছরে ভয়াবহ দুর্নীতির কারণে বৈষম্যের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ কেন ও কোন প্রক্রিয়ায় সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়?

প্রথমত, মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতায় সরকারি ও বেসরকারি খাতে অবকাঠামো এবং শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য শহর এলাকাতে বেশি বিনিয়োগ হয়, তার তুলনায় পল্লী অঞ্চলে ঘটে খুব কম। এসব বিনিয়োগ থেকে প্রধানত সম্পদশালীরা লাভবান হয়।

দ্বিতীয়ত, দেশের শ্রমবাজারের ৮৫ শতাংশ হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক। এর মানে হচ্ছে, ৮৫ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ ঠিকমতো মজুরি পায় না এবং তাদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবে কর্মজীবী মানুষের মধ্যে একটি বড় বৈষম্য সৃষ্টি হয়।

তৃতীয়ত, সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুরা বিশেষ করে পল্লী এলাকা ও শহুরে বস্তিবাসী শিশুরা উপযুক্ত শিক্ষা পায় না; আবার যতটুকু পায় তা মানসম্মত নয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ কেবল বিত্তশালী পরিবারের শিশুরা পায়।

চতুর্থত, দেশে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বেশি। এমনকি শহরের জমির মালিকানা ধনীদের হাতে, বিশেষ করে রিয়াল স্টেটগুলোতে জমির প্লট ও অ্যাপার্টমেন্টের মালিকরা সবাই কমবেশি বিত্তশালী। শহরের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত অধিকাংশ পরিবার ভাড়াবাড়িতে বাস করে এবং লাখ লাখ গৃহহীন মানুষ আকাশের নিচে ঘুমায়। একদিকে বিশাল প্রাসাদের সারি, আর তার পাশে ঘিঞ্জি বস্তি নিয়ে আমাদের শহুরে জীবন চলছে। আমরা বৈষম্যের এমন চিত্র প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সেই সাথে আমাদের মানবিক উপলব্ধিও ভোঁতা হয়ে গেছে।

পঞ্চমত, দেশে আয়করদাতার সংখ্যা খুব কম, মাত্র ৮-৯ শতাংশ। এটি আমাদের অর্থনীতির দুর্বল দিকনির্দেশ করে। অপর দিকে, আয়করের চেয়ে ভ্যাটের পরিধি অনেক সম্প্রসারিত। ফলে একজন ভিক্ষুকও যখন কোনো কিছু ক্রয় করেন তখন ভ্যাট দিয়ে থাকেন। দেশে প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্স সংগ্রহের পলিসি নিয়ে নানা কথা চালু রয়েছে। ফলে আয়কর থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী তেমন উপকৃত হয় না।

ষষ্ঠত, সরকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি চালু রেখেছে তার পরিমাণ জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু এটি অনেকটা সত্য যে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতির কারণে প্রকৃত অভাবীরা ওই কর্মসূচির সুবিধা কম পেয়ে থাকেন। একইভাবে বিভিন্ন খাতে সরকার যেসব ভর্তুকি দিয়ে থাকে তা থেকেও সুবিধা পান ধনীরা। ঋণখেলাপিরা তো সবাই ধনী। ঋণ পরিশোধের পুনঃতফসিলীকরণ সুবিধাও তারাই পান।

সপ্তমত, দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য বিস্তার সমাজে বৈষম্য সৃষ্টির একটি বড় কারণ। কিছু রাজনীতিবিদ দুর্নীতি করে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। রাজনীতি করে দরিদ্র হয়েছেন এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। দেশের ব্যাংক খাতে এত লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে যা ইতিহাসে বিরল। ঋণখেলাপির সংখ্যা ও টাকার পরিমাণও দেশের আর্থিক খাতে সুখকর নয়। আর্থিক ও ব্যবসার ক্ষেত্রে যদি জবাবদিহি ও নৈতিকতার বালাই না থাকে, তাহলে সেখানে স্বাভাবিকভাবে বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে।

অষ্টমত, দেশের গার্মেন্ট সেক্টরে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। রফতানি আয়ের বেশির ভাগ আসে এ খাত থেকে। কিন্তু এখানকার শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পান না। যদিও কর্মসংস্থানে এটি একটি উল্লেখযোগ্য খাত।

নবমত, দেশের সম্পদ বণ্টনে ন্যায্যতার নীতি অনুসৃত হয় না। রাষ্ট্রীয় সম্পদে সবার সমঅধিকার রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে বৈষম্য প্রকট। সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নৈতিক পরিশোধন প্রক্রিয়া ও জবাবদিহির আওতায় না আনলে তা বঞ্চিত মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।

এবারে আমরা পর্যালোচনা করে দেখি, দেশে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি বৈষম্য হ্রাস বা দারিদ্র্য দূরীকরণে কতটুকু অবদান রাখতে পারছে।

যেসব কারণে বৈষম্য বাড়ে সেগুলোর প্রতিকারের জন্য কার্যকর কর্মসূচির অভাব থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় দেশে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সরকারি ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায়, সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ দিয়েছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৭.০৬ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এক লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা যা বাজেটের ১৪.৭৮ শতাংশ। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, সরকার এ খাতে মোট জিডিপির ২.০০ থেকে ২.৫০ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দ দিয়ে থাকে।

এখন আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি, সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়নে কতটুকু লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে।

প্রথমত, সরকার এ খাতে মোট জিডিপির ২.০০ থেকে ২.৫০ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দ করে বলে যে দাবি করে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। কারণ এ হিসাবের মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁক রয়েছে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির জন্য বরাদ্দের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয় হিসাবের সুদ ও বিভিন্ন ধরনের সাবসিডিকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। বস্তুত এসব বাদ দেয়া হলে প্রকৃত বরাদ্দের হার জিডিপির ১.৩২ শতাংশ দাঁড়ায়। যদিও দাবি করা হয়, প্রায় ২০টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেকটা কমেছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- সরকারের এসব কর্মসূচি হতদরিদ্রের হার কমাতে কিছুটা ভূমিকা রাখলেও প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসকরণে এর তেমন কোনো অবদান নেই।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির জন্য বরাদ্দের পরিমাণ এতটাই কম যে, তা দিয়ে ন্যূনতম চাহিদা পূরণ, এমনকি শুধু খাবারের ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয় না। আবার যতটুকু দেয়া হয় তা যে সবসময় নিয়মিত পাওয়া যায়, তাও নয়। স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা তো দুরাশা বৈকি।

তৃতীয়ত, এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারী এবং স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিরা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকেন। ফলে সঠিক লোকেরা সুবিধা পান না। অতীতে সরকারি দলের পছন্দের লোকেরাই সুবিধা বেশি পেত।

চতুর্থত, ২০টি মন্ত্রণালয় কর্তৃক কমবেশি একই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে ওভারল্যাপিং হচ্ছে এবং সমন্বয়ের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্রহণ করা হয় বিধায় তার ফল টেকসই হয় না।

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির জন্য বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করতে গেলে সরকারকে অন্য খাতের বরাদ্দ কমাতে হয়; কারণ দেশের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ তেমন সন্তোষজনক নয়। এখানে আমরা সরকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করতে পারি। সেটি হচ্ছে- ইসলামী সামাজিক অর্থায়নকে রাজস্বের একটি উৎস হিসেবে গ্রহণ করা। বিশেষ করে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে :

ক. ২০২২ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকা জাকাত সংগ্রহ করা যেতে পারে। সংখ্যাটি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির জন্য সরকারি বরাদ্দের সমান বা আরো বেশি। সরকার বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত সংগ্রহে আইন প্রণয়ন করতে পারে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া জাকাত ও ইসলামী সামাজিক অর্থায়নে যে সফলতা লাভ করেছে তা থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। এ কর্মসূচির জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য জাকাত তহবিল কাজে লাগানো যেতে পারে। জাকাতের মতো একটি সুপ্ত রাজস্ব খাতকে সক্রিয় করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।

খ. সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার-বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য ওয়াকফ ও হেবা আইনকে সহজীকরণ করতে পারে। সরকারের এমন আইন ও নীতি প্রণয়ন করা উচিত যাতে সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিরা মানবকল্যাণমূলক কাজে বেশি উৎসাহিত হন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় জাকাত, ওয়াকফ, সাদাকা প্রভৃতি ইসলামী সামাজিক অর্থায়নের সব ইনস্ট্রুমেন্ট সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা হলে সমাজে তার ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

গ. আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রধান শিকার নারীরা। উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে আইন সংশোধন, বিশেষ করে কন্যারা যাতে মা-বাবার সম্পত্তির অংশ ঠিকমতো পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া মেয়েরা যাতে বিয়ের মোহরানা ঠিকমতো পায় তা আইনের দ্বারা নিশ্চিত করা হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

ঘ. বেকার যুবক ও যুবমহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানে সুদমুক্ত ঋণ চালু করা যেতে পারে।

ঙ. বিদ্যমান আয়কর নীতি সংস্কার করে করাদাতার সংখ্যা সম্প্রসারণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। কর সংগ্রহে দুর্নীতি দূর করা গেলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটবে। একই সাথে যেসব করদাতা সমাজকল্যাণমূলক কাজে জাকাত ও অনুদান দিতে আগ্রহী তাদের জবাবদিহির সাথে কর অব্যাহতি প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

চ. ঘুষ-দুর্নীতি তথা হারাম পথে সম্পদ অর্জনের পথ প্রতিরোধ করতে সরকারের কঠোর নীতি অনুসরণের অঙ্গীকার করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি-কৌশল সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে হালাল ব্যবসায় করা সহজতর হয় এবং হারাম ব্যবসার পথ কঠিন হয়ে যায়।

ছ. সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষানিশ্চিত করা, কারিগরি দক্ষতা অর্জন ও নৈতিক শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। এর ফলে শিক্ষায় বৈষম্য হ্রাস পাবে।

জ. শ্রমিকদের মজুরি ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্ধারণে শিল্প-মালিক, শ্রমিক ও সরকারের সমন্বয়ে নীতি নির্ধারণ করতে হবে।

ঝ. কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তি যাতে ন্যায্য মজুরি ও পণ্যের ন্যায্য দাম পায় সে জন্য বাজার ব্যবস্থায় নৈতিক ও কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে।

ঞ. দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সম্পদ ও সরকারি সুবিধার বৈষম্য রয়েছে। সেটি চিহ্নিত করে বৈষম্য হ্রাসের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

ট. জনপ্রশাসনের সব স্তরে সততা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে সুবিধাভোগী নির্বাচন ও ব্যবস্থাপনা সেবায় অধিকতর স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব