বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছ শাসন ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতা বজায় রাখা যায়, তবে বাংলাদেশ হতে পারে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের কেন্দ্র, চীন-ভারত প্রতিযোগিতায় ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি এবং বঙ্গোপসাগরভিত্তিক ‘Blue Economy Powerhouse’। বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন ও সহযোগিতা কাঠামোর সক্রিয় সদস্য এবং এসবের মাধ্যমে দেশটি বাণিজ্য, পরিবহন, জ্বালানি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে

ভূরাজনীতি (Geopolitics) হলো একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, কৌশলগত গুরুত্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়া। আমরা বিষয়টি বিশ্লেষণ করব।

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক কেন্দ্রে অবস্থিত, যা তাকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে তুলে ধরেছে। এর পূর্বে মিয়ানমার ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের অবস্থান, যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ সেতু করে তুলেছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের বিশাল সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চল (Blue Economy Zone) রয়েছে, যা ভবিষ্যতের জ্বালানি, মৎস্য ও বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশ এখন ভারত ও চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ভারত তার ঐতিহ্যগত প্রভাববলয়ের মধ্যে রাখতে চায় বাংলাদেশকে। পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের ভূমিকা ও অবস্থান নিয়ে এদেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা ও বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের নীতিগত অবস্থান ও কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন প্রায়ই সমালোচিত হয়েছে। এই প্রভাব-নির্ভর রাজনীতি দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গঠনে বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলস্বরূপ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও জনগণস্তরের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এক ধরনের শীতলতা লক্ষ করা যায়, যা ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ হলেও সময়ের সাথে সাথে এই সম্পর্ক নানা ধরনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতার মুখোমুখি হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকগুলোতে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার, রাজনৈতিক আশ্রয়, সীমান্ত সমস্যা, পানিবণ্টন, বাণিজ্য ভারসাম্য ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে ঘিরে নতুন নতুন দ্ব›দ্ব সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বিশেষভাবে বিতর্ক দেখা যায়। ভারতের কিছু নীতি এবং বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল অবস্থান বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত বাংলাদেশের অনির্বাচিত হাসিনা সরকারকে সমর্থন ও মদদ দেয়ার কারণে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ বেপরোয়া দুর্নীতি, গুম, খুন, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। প্রশাসনের কাছে পুরো জনগণকে জিম্মি করে ফেলা হয়। এ ধরনের অবস্থান বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ওপর পরোক্ষ প্রভাব ফেলছে এবং দেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি প্রচণ্ড নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে। রাজনৈতিকভাবে একপক্ষীয় সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশের জনগণ ভারতের অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা জনগণস্তরে আস্থা ও পারস্পরিক বিশ্বাস দুর্বল করে দেয়।

অন্য দিকে ভারতের নীতিনির্ধারকরা যুক্তি দেন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ দমন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা তার জন্য অপরিহার্য। তাদের মতে, এই সহযোগিতা উভয় দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উপকারী। কিন্তু বাস্তবে, এই প্রভাবনির্ভর কূটনীতি প্রায়শই ভারসাম্য হারায়, যার ফলে সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও নীতিগত বড় ফাটল তৈরি হয়। ফলস্বরূপ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘আস্থার ঘাটতি’ (trust deficit) স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। এটি শুধু কূটনৈতিক পর্যায়েই নয়, বরং জনগণস্তরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আঞ্চলিক সহযোগিতা, যেমন- সার্ক (SAARC), বিমসটেকের (BIMSTEC) মতো মঞ্চেও এই সম্পর্কের টানাপড়েন প্রভাব ফেলে। যদি উভয় দেশ পারস্পরিক সম্মান, সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ও জনগণকেন্দ্রিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নতুন করে সম্পর্ক পুনর্গঠন না করতে পারে, তবে ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করতে হলে উভয় দেশের উচিত পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে সমতা ও স্বচ্ছতার নীতি গ্রহণ করা, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব বা অভ্যন্তরীণ পক্ষপাতের পরিবর্তে যৌথ উন্নয়ন ও আঞ্চলিক শান্তিই হয়ে ওঠে মূল চালিকাশক্তি। কোনোভাবেই ভারত যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে, প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে হবে।

অন্য দিকে চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত প্রভাব বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশ ভারসাম্য নীতি (Balance Policy) অবলম্বন করে উভয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি করছে চীন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উপস্থিতি মজবুত করতে চায়। বাংলাদেশে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, পাওয়ার প্ল্যান্ট ও শিল্পাঞ্চল নির্মাণের মতো বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণ তার বিনিয়োগের পরিধি ও প্রভাব আরো প্রসারিত করেছে। এর মাধ্যমে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাবকে শমিতকরণ, বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সামুদ্রিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত একটি সমন্বিত বাণিজ্য করিডোর গঠন করার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ এ অবস্থায় ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অবলম্বন করেছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ একপাক্ষিকভাবে কোনো দেশের দিকে ঝুঁকে না পড়ে বরং উভয়ের সাথেই অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে। এই নীতি বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা, কারণ এক দিকে ভারত তার ভৌগোলিক ঘনিষ্ঠতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়, অন্য দিকে চীন তার বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো দুই দেশের প্রতিদ্ব›িদ্বতা থেকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা অর্জন করা; কিন্তু কোনো এক পক্ষের প্রভাবাধীন না হওয়া। এভাবে, বাংলাদেশকে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক ভারসাম্যপূর্ণ, বাস্তববাদী ও কৌশলগতভাবে বিচক্ষণ অবস্থান ধরে রাখতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির অংশ হিসেবে দেখতে চায়। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে মার্কিন প্রভাব থাকলেও, নিরাপত্তা ও সামুদ্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। বঙ্গোপসাগর ভবিষ্যতের জ্বালানি যুদ্ধ ও বাণিজ্য রুটের কেন্দ্রবিন্দু। এটি মলাক্কা প্রণালী হয়ে চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যের লাইফলাইন। বাংলাদেশ SAARC, BIMSTEC, IORA এবং BCIM করিডোরের সদস্য হিসেবে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের পূর্ণ সম্ভাবনা এখনো ব্যবহৃত হয়নি।

চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি বর্তমানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে বিরোধ রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের লক্ষ্য শান্তি, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি। তবে বড় শক্তিগুলোর প্রভাবের কারণে দেশগুলো বিভক্ত অবস্থায় থাকে।

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের নেতৃত্বে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ মূলত চীনের প্রভাব প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে গঠিত। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগর উভয় অঞ্চলই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীনের প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামোগত বিনিয়োগ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো (Build Back Better World, PGII) গড়ে তুলতে চাইছে।

বাংলাদেশ এই অঞ্চলের ‘Pivot State’ অর্থাৎ- যে দেশটি আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য বাংলাদেশকে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। যে দেশ উন্নয়নে সহায়তা দেবে, তার সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। আঞ্চলিক সংযুক্তি- সড়ক, রেল, বন্দর ও জ্বালানি করিডোরে সক্রিয় থাকতে হবে। সামুদ্রিক নিরাপত্তা (Maritime Security) বঙ্গোপসাগরে নৌনিরাপত্তা ও নৌবাণিজ্য রক্ষা করতে হবে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছ শাসন ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতা বজায় রাখা যায়, তবে বাংলাদেশ হতে পারে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের কেন্দ্র, চীন-ভারত প্রতিযোগিতায় ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি এবং বঙ্গোপসাগরভিত্তিক ‘Blue Economy Powerhouse’। বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন ও সহযোগিতা কাঠামোর সক্রিয় সদস্য এবং এসবের মাধ্যমে দেশটি বাণিজ্য, পরিবহন, জ্বালানি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।

লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি

[email protected]