রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জনমত সম্পর্কিত একটি বিষয় আছে। উপসংহারে এ রকম করে বলা হয় যে, জনমত আসলে ‘জনও নয় আর মতও নয়’। গণভোট প্রসঙ্গে একই কথা বলা যায়। গণভোটের অবশ্য নানা আকার-প্রকার আছে। কোনো দেশের শাসনতন্ত্রে সংবিধান পরিবর্তন এবং বিশেষ রাষ্ট্রিক বিষয় বা ইস্যুতে গণভোট নেয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে। গণভোট তখনই হয় যখন বিষয়টি রাষ্ট্রিকভাবে গুরুত্ব অর্জন করে, জনমতের ব্যাপক দাবি অনুভূত হয় অথবা জনমনে সংবেদনশীলতা অর্জিত হয়।
দু’ভাবে এই গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমত উন্নত দেশগুলোতে জনগণ একটি বিশেষ প্রশ্নে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপামর জনসাধারণের মতামত গ্রহণে সরকারকে বা যেকোনো সংস্থাকে অনুরোধ করতে পারে। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা কিংবা কুইবেকের বিচ্ছিন্নতা অনুমোদন অথবা প্রত্যাখ্যানের জন্য এ রকম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন বা সংযোজনের জন্য এ রকম গণভোট অনুষ্ঠানের প্রচলন আছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিরা বা সংবিধান প্রণেতারা যদি মনে করেন সংবিধান সংশোধনটি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর, তখন তারা সংশোধনীকে একরকম অসম্ভব করে তুলবেন। আবার যদি তারা চান যে প্রয়োজনে সংশোধনীটি সহজ করবেন তাহলে সে রকম বিধান সংবিধানে সংযোজন করবেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সংবিধান সংশোধনের শ্রেণিবিভাগ আছে। সেখানে সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের নীতিকথা বর্ণিত আছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সুপরিবর্তনীয় সংবিধান উন্নত সমাজের জন্য সহজে প্রয়োগযোগ্য। অপর দিকে যারা কোনো বিশেষ আদর্শ বা মতবাদ বা গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণ করতে চায় তারা সংশোধনীকে দুষ্পরিবর্তনীয় করে তোলেন।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঘোষিত বাংলাদেশের সংবিধানটি প্রাথমিকভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্যের ছিল। সেই সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য গণভোটের বিধিবিধান আবশ্যকীয় ছিল। পরবর্তীকালে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী তাদের চিরস্থায়ী শাসনের প্রয়োজনে দু’বছরের মধ্যেই সংবিধান পরিবর্তন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় বাকশাল। গণভোটের বিধানটি উঠিয়ে নেয়ার ফলে শাসনকর্তাদের সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কোনো বেগ পেতে হয় না। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের ‘আ’ ধারায় বলা হয়েছে- ‘সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোনো বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।’ এর অর্থ দাঁড়াল এই যে, সংসদে কোনো দলের বা সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন থাকলেই তারা তাদের মর্জি মোতাবেক সংবিধান সংশোধনে সক্ষম হবে।
বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। সব পরিবর্তনই শাসকগোষ্ঠীর প্রয়োজনে সংশোধিত হয়েছে। জনগণের প্রয়োজনে নয়। আওয়ামীরা সংশোধনীটি সহজ করেছে; কিন্তু তাদের আদর্শ, মতাদর্শ ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু নির্ণয়ের জন্য সংবিধানের কিছু অংশ পরিবর্তন অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। মৌলিক অংশ বলে কথিত ৭-এর ‘খ’ ধারায় বলা হয়েছে- ‘এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার দোষে দোষিত হইবে।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে, সংবিধান যদি অনড় থাকে আর জনগণ যদি পরিবর্তন আকাক্সক্ষী হয়ে ওঠে, তাহলে বিপ্লব অনিবার্য। ১৬ বছরের অপশাসন অবশেষে ২০২৪ সালের গণবিপ্লবে এই পরিবর্তন বাস্তবিক অর্থেই অনিবার্য হয়ে ওঠে। সংবিধানের অপরিহার্য অংশ কোনোভাবেই আওয়ামী শাসককুলকে রক্ষা করতে পারেনি। এটি প্রমাণিত হয়েছে, কাগুজে বাধ্যবাধকতায় সংবিধান রক্ষা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সংবিধান বলে জনগণই ক্ষমতার উৎস। আর তা চব্বিশের গণবিপ্লব প্রমাণ করেছে।
গণভোটে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়। এটি একটি সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। সংবিধানে গণভোটের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সরকার ইচ্ছা করলে গণভোটের আয়োজন করতে পারে। যেমন- বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর গণভোট। ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ভোটারদের প্রশ্ন করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা উচিত কি না। অনেক বছর পরে এখন যখন সংবিধান সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কথা বলা হচ্ছে, তখন গণভোটের প্রশ্নটি আবার এই সময়ে বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে একই দিনে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোট করা যায় কি না তা নিয়ে এখন রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। কয়েক দিন আগে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসাথে করার বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এর সুবিধা-অসুবিধা বা গণভোটে কী কী বিষয় থাকতে পারে, এগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা চলছে। আরো কয়েকটি বিকল্প পদ্ধতিও আলোচনায় এসেছে। অবশেষে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার মাধ্যমে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে, এটি নিশ্চিত। তবে সংবিধান-সম্পর্কিত নয়, সরকার চাইলে এমন বিষয়াবলি এখনই বাস্তবায়িত হতে পারে- এমন প্রস্তাবনা আছে। এমন সব সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। সরকার আশা করছে, দ্রুততর সময়ের মধ্যে এসব সংস্কার তারা সাধন করতে পারবে। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। এই সনদ তথা সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে? তা নিয়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল-বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে মতভিন্নতা আছে।
বিএনপি মনে করে, আইন-বিধি সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলি অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। আর সংবিধান সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন করবে আগামী জাতীয় সংসদ। জামায়াতে ইসলামী চায় গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা হোক। এ দিকে গণপরিষদ গঠন করে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন চায় এনসিপি। তারা গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই সাথে করার পক্ষে। ইতোমধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি তথা সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এসব বৈঠকে জাতীয় সনদ ও সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এগুলো হলো- ক. গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন; খ. রাষ্ট্রপতির ঘোষণা বা প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে; গ. অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন; ঘ. সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স গ্রহণ; ঙ. বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ সাংবিধানিক ব্যবস্থা নেয়া যায় কি না- এসব বিবেচনা। অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে সাধারণ মত আসে সিভিল সোসাইটির বৈঠকে। সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সের পক্ষপাতী নন অনেকে। তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন নিয়ে ইতোমধ্যে একবার সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নেয়া হয়েছে। বারবার রেফারেন্স নেয়া ঠিক নয়।
অবশেষে এখন জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে গণভোট করার চিন্তাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। গণভোট সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি, এটি এখন আর সংবিধানে বিধিবদ্ধ নেই। তবে সরকার ইচ্ছা করলে গণভোটে যেতে পারে। গণভোট সম্পর্কে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বাস্তবতাও ভিন্ন কথা বলে। সামরিক শাসন অবসানে জনগণের আস্থা গ্রহণের জন্য জিয়াউর রহমান গণভোট গ্রহণ করেছিলেন। ওই গণভোটের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল যে, সেই সময়ে সংবিধানের সংশোধনীগুলোর ওপর জনগণের আস্থা যাচাই করা। পরবর্তী সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আস্থা-অনাস্থা ভোট গ্রহণ করেছিলেন। এ ধরনের গণভোট অর্থহীন। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এই গণভোট প্রসঙ্গে একেবারেই নিষ্পৃহ। তারা ভোট মানে নির্বাচন বোঝে, প্রার্থিতা বোঝে। এখন সংস্কার তথা জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের যে প্রস্তাব করা হচ্ছে তা আসলে যথার্থ সিদ্ধান্ত নয়। এই গণভোটে অনর্থকভাবেই অর্থের, সময়ের ও শ্রমের অপচয় ঘটবে।
এতগুলো প্রস্তাবনা একসাথে বিবেচনা করতে পারা জনগণের জন্য কঠিন। একই সাথে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট নেয়ার যে প্রস্তাব তাও বাস্তবসম্মত নয়। আগের নিয়মে জাতীয় সংসদ নির্বাচন মানুষের কাছে পরিচিত। গণভোট নিতে হলে সেই বিষয়ে জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সাংবিধানিক গণভোট যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আস্থা দাবি করে, তা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে না। তবে এর একটি আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি আছে। অন্য কোনো প্রস্তাবনা কার্যকর না থাকলে বা রাজনৈতিক ঐকমত্য সূচিত না হলে, গণভোটে যাওয়ায় আইনগত বা সাংবিধানিক কোনো বাধাবিপত্তি নেই। এটি হবে একটি লোকদেখানো বিষয় বা আইওয়াশ। আইনের প্রয়োজনে এটি করা যেতে পারে। যেমন- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি। শেখ সাহেব যে ওই সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে সম্মত ছিলেন না তার প্রমাণ্য সাক্ষী আছে। পরে অবশ্য স্বাধীনতার ঘোষণাকে বৈধতা দেয়ার জন্য একটি গল্পের অবতারণা করা হয়। যেমন- তিনি টেলিগ্রাম মারফত চট্টগ্রামের হান্নান চৌধুরীর কাছে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। সেই বার্তা জনে জনে প্রেরিত হয়েছিল। ওই ঘোষণাটি অবাস্তব ছিল। এই সময়ে যদি নিতান্তই দায়ে পড়ে গণভোট গ্রহণ করতে হয়, তাও আইনানুগতা অর্জন করবে। সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা হলো রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মাধ্যমে এটির বৈধতা দেয়া। সেটি সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ঘোষিত হতে হবে।
শিরোনামে বলা হয়েছে- গণভোট ‘গণও নয় ভোটও নয়’। বাংলাদেশের জনচরিত্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে, গণভোট প্রস্তাবনায় জনগণের মতামত দেয়ার সুযোগ সীমিত। একটি উত্থিত বিষয় সম্পর্কে সাধারণভাবে ভোট দেয়াই মুখ্য। এর ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানার ও বলার কোনো সুযোগ থাকে না। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের স্বার্থে কথা বলে, সংস্কার বা জুলাই সনদ নিয়ে নির্বাচন প্রাক্কালে তাদের আগ্রহ হ্রাস পেতে থাকবে। সুতরাং গণভোটের ব্যয়বহুল ও গণবিচ্ছিন্নতা মনে রেখে অন্য যেকোনো পন্থায় সংস্কার প্রস্তাবনা ও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়