মননের সঙ্কটে মুসলিম যুবক

যুবক যদি জেগে ওঠে, বিশ্ব জেগে ওঠে। মুসলিম যুবকের হৃদয়ে যদি পুনরায় দীপ্তি জ্বলে, তবে নিঃসন্দেহে আগামীর ইতিহাস আবার লিখবে তারা। এই গভীর সঙ্কটে প্রথম আলোর স্নিগ্ধ রেখা হোক তাদের আত্মসচেতনতা।

ডা: মো: এনামুল হক

মানবসভ্যতার ইতিহাসে নবযুগ সূচনার প্রধান হাতিয়ার ছিল যুবসমাজ। রোমের পতন কিংবা আন্দালুসের জ্যোতির্ময় উত্থান- প্রত্যেককালে, প্রত্যেক বিপ্লব ও পুনর্জাগরণে প্রধান ভূমিকায় ছিল তরুণ হৃদয়। অথচ বর্তমান মুসলিম যুবক এক গভীর অন্তঃসারশূন্যতার শিকার। আত্মপরিচয় হারানো, আত্মবিশ্বাসে ভগ্নতা, নৈতিক অবক্ষয়, আর বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতায় আজকের যুবক যেন এক ভেসে যাওয়া তরী।

আত্মপরিচয়ের সঙ্কট আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একজন মুসলিম যুবক তার পরিচয় নির্ধারণে দ্বিধাগ্রস্ত। আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা নিজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো।’ (সূরা আল-ইমরান-১৬০) কিন্তু আত্মবিশ্বাসহীনতা ও ঈমানের দুর্বলতা আজ আমাদের যুবকদের মজ্জাগত। ইসলামী পরিচয়, লক্ষ্য ও দায়িত্ব থেকে তারা অনেক দূরে সরে গেছে। মুসলিম হিসেবে গর্ব তো দূরের কথা, অনেকে নিজের মুসলিম পরিচয় আড়াল করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

রাসূল সা: ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের পদে পদে অনুসরণ-অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি গোসাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তোমরাও তাই করবে।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন ‘হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ববর্তী লোকদের বলতে কি ইহুদি-নাসারা বুঝায়? রাসূল সা: বলেন, তা ছাড়া আর কে? ‘(বুখারি) অথবা The vanquished always want to imitate the victor (IbnKhaldun) অর্থাৎ- ‘পরাজিতরা সর্বদা বিজয়ীর অনুকরণ করতে চায়’ ইঙ্গিত দেয় যে পরাজিতরা প্রায়ই তাদের বিজয়ীদের আচরণ, রীতিনীতি এবং বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে। ওপরের হাদিস ও ইবনে খালদুনের এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি মুসলিমদের মাঝে সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই মনোভাবেই আজকের যুবক পশ্চিমা ভাবধারা, জীবনদর্শন ও সংস্কৃতির প্রতি এক অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত। তাদের কাছে ইসলাম যেন কেবল একটি অতীতের কথা, যা বর্তমানের গতির সাথে বেমানান। দৈন্যতা, মানসিক জড়তা আর হীনম্মন্যতায় ভুগছি আমরা। ইসলামের নিজস্ব স্বকীয়তা বিকিয়ে দিয়ে, ‘যা কিছু পশ্চিমের তাই ভালো’ মানসিকতায় বেড়ে উঠছি। এই ভ্রান্ত ধারণার উৎস- জ্ঞান বিমুখতা, কুরআন-সুন্নাহর গভীর অধ্যয়ন থেকে বিমুখ থাকা এবং চিন্তাশীলতার দারিদ্র্য।

ইসলাম যে কেবল একটি ধর্ম নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, তা আমাদের অধিকাংশ তরুণের কাছে এখন এক অতীত ঐতিহ্য মাত্র। তারা পশ্চিমা শিক্ষার মোহে অন্ধ হয়ে পড়েছে, অথচ সেই পশ্চিমই শিক্ষা-সভ্যতা, চিন্তাশীলতা, অনুসন্ধিৎসুতা ও যুক্তিবাদ সর্বোচ্চ স্তরে বিকশিত হয়েছে ইসলামকে অনুকরণ করে। ইসলামী জ্ঞানের গভীরতা, দর্শনের যুক্তিপূর্ণতা এবং কুরআন-সুন্নাহর বিশ্লেষণধর্মী চেতনা অনুধাবন না করায় তারা আজ এমন বিশ্বাসে আবদ্ধ যে, ইসলাম তাদের আধুনিকতা বা আত্মপ্রকাশের প্রতিবন্ধক। ফলে জন্ম নেয় এক মর্মান্তিক দ্ব›দ্ব, আধুনিক হতে গিয়ে তারা হয়ে ওঠে স্বাতন্ত্র্যহীন, সংস্কৃতিহীন ও আত্মমর্যাদাহীন।

তাদের আকিদা দুর্বল, বিশ্বাসে শৈথিল্য। ধর্মীয় জ্ঞান নেই, জানার আগ্রহও নেই। তারা কুরআনের গভীরে প্রবেশ করে না, সুন্নাহর সৌন্দর্য অনুভব করে না। পশ্চিমা দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশে বলেছিলেন, যে তার ‘কেন’ জানে, সে যেকোনো ‘কিভাবে’ মেনে নিতে পারে। আমাদের যুবকরা আজ তাদের ‘কেন’ হারিয়ে ফেলেছে, কেন আমি মুসলিম, কেন এই জীবন, কেন সত্যের পথই সঠিক।

তারা তীব্র জ্ঞানের অভাবে ভুগছে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন- সবক্ষেত্রে চিন্তার দৈন্য স্পষ্ট। তারা পড়ে না, বিশ্লেষণ করে না, শুধু গ্রহণ করে। তাদের সাহিত্যচর্চা নেই, ইতিহাসজ্ঞান নেই, আত্মপর্যালোচনার সংস্কৃতি নেই। ফলে তারা ‘তথ্যবহুল কিন্তু প্রজ্ঞাহীন’ এক জেনারেশনে পরিণত হয়েছে। আধুনিক চিন্তার নামে তারা কেবলই ভোক্তা, সৃষ্টিশীল নয়।

এই দ্বিধা ও বিভ্রান্তির মাঝেই জেঁকে বসেছে এক ভয়ঙ্কর নৈতিক অবক্ষয়। মাদক, পর্নোগ্রাফি, অবৈধ সম্পর্ক, আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতা ও তাকওয়ার অভাব- এসব আজকের মুসলিম যুবকের জন্য এক ধ্বংসাত্মক বাস্তবতা, তারা ভেসে যাচ্ছে লালসা ও কামনায়। চরিত্রহীনতা এখন যেন জীবনচর্চার অনিবার্য উপাদান। দায়িত্ববোধের চেতনা বিলুপ্ত, উম্মাহ ও সমাজের প্রতি কোনো দায় নেই। তারা ভাবেই না, আমার কাছে জাতির কোনো প্রত্যাশা আছে কি না। একটিই জীবনের মন্ত্র : ‘আমার আরাম, আমার সাফল্য, আমার সম্পদ’। এক গভীর আত্মকেন্দ্রিক দুনিয়ামুখী জীবনদর্শনই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে। ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, ‘মানুষ স্বাধীন জন্মায়, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত।’ মুসলিম যুবকও আজ শৃঙ্খলিত, তবে নিজেরই প্রবৃত্তির কাছে।

মুসলিম যুবকের মাঝে আজ দেখা যায় মানসিক দ্ব›দ্ব। তারা জানে, তাদের পরিচয় এক, কিন্তু পরিচয়টিই যেন তাদের কাছে বোঝা। আধুনিকতাবাদের মোহে পড়ে তারা ইসলামী মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করে, অথচ সেই আধুনিকতা তাদের হৃদয়ের শান্তি দিতে ব্যর্থ। ফলে তারা পড়ে এক আত্মবিরোধী সত্তায়। নিজের চিন্তাকে ছোট করে দেখা, মুসলিম আলেম-দার্শনিকদের চিন্তাকে পিছিয়ে পড়া বলেই ধরে নেয়া, আর নেতৃত্ব সঙ্কটে ভোগা- এসব মিলেই গড়ে উঠেছে এক দ্বিধাগ্রস্ত প্রজন্ম। মনে করে, ইসলামী চিন্তা পিছিয়ে পড়া, মুসলিম দার্শনিকরা কেবল অতীতের গল্প। অথচ আল-গাজ্জালি, ইবনে রুশদ, ইবনে তাইমিয়া, তারা শুধু আলেম নন, ছিলেন তীক্ষè দার্শনিক ও সমাজমনস্ক চিন্তাবিদ। ইবনে রুশদ বলতেন, ‘যুক্তি ও শাস্ত্র যদি একে অপরের বিরোধী হয়, তবে বুঝতে হবে আমরা হয় যুক্তিকে বুঝিনি, নয়তো শাস্ত্রকে।’

কিন্তু আজকের মুসলিম যুবক এই ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের রিলসে নিজেদের বুদ্ধি বিলিয়ে দিচ্ছে।

তরুণ বয়সেই দুনিয়াকে জানার, শিক্ষা অর্জনের, দাওয়াতের ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা-ইবনে বতুতা থেকে আমাদের যুবকরা প্রেরণা পায় না। নেতৃত্ব, সাহস, আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিকতার গুণে গুণান্বিত- জেরুসালেম বিজয়ী সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সংগ্রাম-ত্যাগ-চেতনা তাদের আন্দোলিত করে না। দাস থেকে সেনাপতি, তারপর গভর্নর, আন্দালুস বিজয়ী মুসা বিন নুসাইরের স্বপ্ন, সাহস, অসামান্য কৌশল-দূরদর্শিতা ও একাগ্রতা আমাদের তরুণদের উজ্জীবিত করে না। দিনে ঘোড়ায় চড়া আর রাতে জায়নামাজে দাঁড়ানো জাতির বর্তমান প্রজন্ম এখন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বা ভিডিও-ফেসবুকেই আটকে পড়েছে। সংস্কৃতির নামে বেলাল্লাপনায়ও ঝোঁক তাদের। যেই পোশাক পরে মানব সভ্য হলো পাশ্চাত্যের জোয়ারে সেই পোশাক খুলে সভ্য হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। জ্ঞান ও ইসলামিক চেতনা না থাকায় বাবা-দাদার মতবাদের বাইরে তারা কোনো রাজনৈতিক দর্শন চিন্তা করতে পারে না।

নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও তারা হতাশ। রোল মডেল বলতে যারাই সামনে আসে, তারা হয় নীতিহীন, নয়তো আত্মপ্রচারের বলয়ে ঘেরা। সত্যনিষ্ঠ আলেম ও চিন্তাবিদদের আলো চাপা পড়ে যায় চটকদার ইউটিউবারদের কণ্ঠে। মিডিয়ার ভ্রান্ত চিত্রায়ণ, প্রযুক্তির অপব্যবহার, অজস্র সময় নষ্ট, তথ্যবিকৃতি, লাইক-ক্লিকের নেশা আমাদের যুবকদের ভিতরকার শূন্যতাকে আরো শূন্য করছে।

রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব, দালালি ও চাটুকারিতার সংস্কৃতি এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রতি অনীহা তাদের মননে গভীর অসাড়তা এনে দিয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন কেবল বইয়ের পৃষ্ঠা কিংবা পুরাতন বক্তৃতার বিষয়। তাদের মাঝে নেই সামষ্টিক চেতনা, নেই হক-বাতিলের স্পষ্টতা। তারা বিভ্রান্ত, অথচ আত্মবিশ্বাসহীন। এভাবে তাদের চেতনা এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত আত্মা হয়ে গেছে।

ইমাম গাজ্জালি বলেছিলেন, ‘যে জাতি তার নিজস্ব চিন্তাধারায় আস্থা হারায়, সে জাতি মরে যায়, তবে তার লাশটা মাটিতে না গিয়ে বাজারে ঘোরে।’ আমাদের যুবকসমাজ আজ সেই চলমান লাশে পরিণত হচ্ছে, যাদের মধ্যে প্রাণ আছে, কিন্তু দিকনির্দেশনা নেই।

এই গভীর সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন এক চেতনার পুনর্জাগরণ। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, ‘যারা রাজনীতি এড়িয়ে চলে, শেষ পর্যন্ত শাসিত হয় অযোগ্যদের দ্বারা।’ তাই যুবকদের চাই নেতৃত্বের চেতনা, আদর্শের সাধনা। দরকার আত্মসচেতন ধর্মীয় শিক্ষা, যা যুক্তি ও হৃদয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। প্রয়োজন এমন পরিবার ও সমাজ, যেখানে ধর্মীয় পরিচয় লজ্জার নয়, গৌরবের বিষয় হবে। আমাদের দরকার আদর্শ নেতৃত্ব, যারা যুবসমাজকে তাকওয়া, দায়িত্ববোধ ও জ্ঞানপিপাসার পথে ফিরিয়ে আনবে। জার্মান দার্শনিক গ্যেটে বলেছিলেন, ‘যে নিজের জাতিকে সম্মান করে না, অন্য জাতিও তাকে সম্মান করে না।’ আমাদের যুবকদের আবারো নিজেদের আত্মপরিচয়, ইতিহাস ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাদের মধ্যে জাগাতে হবে গবেষণার উৎসাহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, চিন্তায় গভীরতা ও ঈমানে দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল, এক জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন।

যুবক যদি জেগে ওঠে, বিশ্ব জেগে ওঠে। মুসলিম যুবকের হৃদয়ে যদি পুনরায় দীপ্তি জ্বলে, তবে নিঃসন্দেহে আগামীর ইতিহাস আবার লিখবে তারা। এই গভীর সঙ্কটে প্রথম আলোর স্নিগ্ধ রেখা হোক তাদের আত্মসচেতনতা।

লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক