পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ শুধুই ‘ভোট ব্যাংক’

পশ্চিমবঙ্গের এ মুসলিম ভোট একটি ম্যাজিক ফিগার। তবু তারা ভোট ব্যাংক! আর তৃণমূলের মুসলিম নেতারা যেন বোবা।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিপন্নতার মধ্যে যেমন থাকে, তেমনি থাকে নানাভাবে নিরাপত্তাহীনতায়। ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছে ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে। কিন্তু যে দু’টি বড় রাজ্য ধর্মীয়ভাবে বিভাজনের শিকার হয় এর একটি বাংলা, অন্যটি পাঞ্জাব। দু’টি রাজ্যের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। বিশেষ করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের যে সশস্ত্র বিপ্লবী ধারা বলতে যা বোঝায়, তা তো বাংলা ও পাঞ্জাব।

পাঞ্জাবে স্থানান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে বিশেষ সমস্যার সূত্রপাত না হলেও বাংলার সেই সমস্যার সমাধান এখনো রয়েছে। স্থানান্তর বা পারাপার শুধু একপক্ষীয় নয়, দ্বিপক্ষীয়। পূর্ববঙ্গ বা পূর্বপাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে যেমন বাঙালি হিন্দুরা এসেছেন, তেমনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাঙালি বা উর্দুভাষী মুসলিমরাও বাংলাদেশে গেছেন। কিন্তু কলকাতার মানুষ মনে করে, পারাপার বা মাইগ্রেশন কেবল একপক্ষীয়। আসলে তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, মীরপুর, ধানমন্ডি বা পুরান ঢাকার বিভিন্ন অংশে কেবল পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত ওরিজিন মুসলিম। মোহাম্মদপুরের রাস্তাঘাট দিল্লির সুলতান অথবা মোগল সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের নামানুসারে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা বা শহরগুলোতে পশ্চিমবঙ্গ ওরিজিন বাঙালি মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি। ঠিক পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও বাংলাদেশ ওরিজিন বাঙালি হিন্দু বেশি; যারা নানান উদ্বাস্তু কলোনিতে বসবাসরত। এটিই হলো প্রকৃত ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গে আজো কিন্তু মুসলিমরা ৩০ শতাংশ যা যেকোনো রাজনৈতিক দলকে পশ্চিমবঙ্গের কুর্শিতে বসতে একটি ম্যাজিক ফিগার। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা কি শুধুই ভোট ব্যাংক? শুধুই কি রাজনৈতিক দলগুলোর লেঠেল হিসেবে ব্যবহৃত? এটি এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।

১৯৪৮-১৯৬২ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে বারবার সরকারি মেশিনারির সাহায্যে দাঙ্গা বাধানো হয়। যাতে মুসলিমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দেশ ছেড়ে পালায়। বিধানচন্দ্রকে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার বলা হলেও তিনি কিন্তু মুর্শিদাবাদের মুসলিমদের সীমানা পার করতে বলেছিলেন। এ নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের তৎকালীন জেলাশাসক (আইসিএস) ও কবি-সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়কে। এ ইতিহাস কী করে ঢাকব? একটি কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, পারাপার দু’পক্ষে হয়েছে। তারপরও বলব, ২০০৫ সালের সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রমাণ করে দিয়েছে, গোটা ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের হালহকিকত কতখানি করুণ। ১৯৭৭-২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল। ৩৪ বছর ধরে সিপিআইয়ের (এম) নেতৃত্বে একটি রেজিমেন্টেড বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল। সরকারি চাকরিতে তাদের হাল মাত্র ৩ শতাংশ কেন? অথচ যে চাকরিগুলো পিএসসির মতো স্বশাসিত সংস্থা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে হয়, সেখানে কিন্তু চাকরির হার ৬ শতাংশের বেশি। যে রাজ্যে ৩০ শতাংশ মুসলিম, সেখানে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে চাকরির হার ৩ শতাংশ কেন? সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সাচার কমিটির রিপোর্টে কেন প্রাথমিক শিক্ষকতা, পরিবহন দফতরসহ কিছু ক্ষেত্রে মুসলিমদের চাকরির ইতিবাচক দিকটি আসেনি কেন? পশ্চিমবঙ্গে যে ভূমিসংস্কার বা বর্গা মুভমেন্ট হয়েছে তার সাফল্য তো মুসলিমরা পেয়েছে। তার ১৭ শতাংশ মোট ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছে মুসলিমরা। এমনকি প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ কথাও বলেছিলেন, যারা মনে করেন আমাদের চোখ খোলা ছিল না, তারা ভুল বলছেন। আমাদের চোখ খোলাই ছিল। বিশেষ ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, খোলা চোখ থাকা সত্তে¡ও কেন মুসলিমদের প্রতি কেয়ার নেয়া হয়নি? যারা শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলেন, তারা যে শ্রেণীটি পিছিয়ে থাকবে তাদের প্রতি কেয়ার নেবেন না কেন? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, পশ্চিমবঙ্গে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা বা থানায় থানায় কলেজ প্রতিষ্ঠা মুসলিম সমাজকে শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তাহলে চাকরি-বাকরির হাল করুণ ছিল কেন? এটি লাখ টাকার প্রশ্ন। কিন্তু বাম আমলে তখনকার সংখ্যালঘু প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সাত্তার সাচার কমিটির সুপারিশ অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরের চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০১১ সালে বাম সরকারের পতন ঘটে। তবে বাম সরকারের আমলে দাঙ্গা সংগঠিত করার কোনো সুযোগ ছিল না।

২০১১ সালে বাম-সরকারের পতন। সাচার রিপোর্ট, সিঙ্গুর-নন্দিগ্রাম জমি আন্দোলন ও কলকাতার পার্কসার্কাস তিলজলা লেনের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রেজওয়ানুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যু তৃণমূলের রাজনৈতিক তুরুপের তাসে পরিণত হয়। সেবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় এসে রাজভবনে শপথ হওয়ার পর তখন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মহাকরণে বৈঠকের পর বলেছিলেন, রাজেন্দ্র সিং সাচারকে নিয়ে এসে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের রোডম্যাপ করা হবে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়- রাজেন্দ্র সিং সাচার দু-দুবার কলকাতায় এসে ফিরে যান। কোনো রোডম্যাপ হয়নি। সাচার কমিটির রিপোর্ট বের হওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গে আরো দু’টি বেসরকারি সংস্থা সমীক্ষা চালায় মুসলিমদের অর্থনৈতিক হাল-হকিকত নিয়ে। একটি হলো অ্যাসোসিয়েশন স্নাপস। অন্যটি এম্পাওয়ার ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন। দুটো বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় তৃণমূলের আমলেও করুণ চিত্র ফুটে উঠে। এই পশ্চিমবঙ্গে আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট বা ওবিসিতে এনে মুসলিমদের সুযোগ-সুবিধার পথটি রুদ্ধ করা হয়। ২০১৮ সালে ভারতের রাজধানী দিল্লির লোধি রোডের সায়েন্স সেন্টারে এক সেমিনারে এম্পাওয়ার ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সমীক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেন সেমিনারের প্রধান অতিথি রাজেন্দ্র সিং সাচার। বিষয়টি ছিল পশ্চিমবঙ্গ ঘিরে।

সাচারজি সেদিন খুব দুঃখ প্রকাশ করেন, কিভাবে তাকে কলকাতায় অপমান করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে এখন মুসলিমদের চাকরি-বাকরি আরো করুণ, যা এসে ঠেকেছে- এক কি দেড় শতাংশে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি রেড রোডে ঈদের নামাজে মুসলিমদের জন্য কী গলাবাজিটাই করেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগে কী দুর্নীতি না হয়েছে। যার জেরে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট প্যানেল বা নিয়োগটিকে অবৈধ বলে বাতিল করে দেন। আজ শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষা বিভাগের অফিসারদের জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে। এ দুর্নীতি সব দফতরে হয়েছে যার শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা। ফলত, এ রাজ্যেও সংখ্যালঘু তোষণ নয়; বরং দূষণ হয়। তারা কেবল মোট ব্যাংক ও খুনোখুনির শিকার হয়। এটিই বাস্তবতা।

পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের চাকরি-বাকরি সবটা হয়েছে ১৯৭২-৭৭ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে। ১১-১২ শতাংশ চাকরির সুযোগ পেয়েছিল মুসলিম সমাজ। ওই আমলে সামগ্রিকভাবে সার্ভিস সেক্টরে সবচেয়ে বেশি চাকরির সুযোগ ছিল। ফলে তার সুযোগটা মুসলিমরা পেয়েছিল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলের মুসলিম মন্ত্রীরা ছিলেন একেকটি রতœ। সিদ্ধার্থবাবু নিজে প্যানেল দেখতেন। তিনি নিজে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাতি। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলায় বেঙ্গল প্যাক্ট তিনি চালু করেন, যার সুযোগ অল্প কিছুদিন পায় মুসলিম সমাজ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা মেয়র। আর ডেপুটি মেয়র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে বেঙ্গল প্যাক্ট বাস্তবায়িত করেন। কিন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অকাল প্রয়াণ বেঙ্গল প্যাক্ট কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ব্রিটিশ রাজত্বের শেষের দিকে অবিভক্ত বঙ্গের তিন তিনটি প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আমলে মুসলিমরা সুযোগ-সুবিধা পান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাতি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ভারতে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের যে অধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘিষ্ঠেরও সমান অধিকার। এটি তিনি কাজে পরিণত করেন। আর সবাই মুসলিমদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেন। এটিই বাস্তবতা। শুধু ভোট ব্যাংক। ভোট নামক বসন্ত যখন আসে তখন যাবতীয় মায়াকান্না আর অভিনয় মুসলিমদের নিয়ে। মুসলিম ভোট নিয়ে যাবতীয় মায়াকান্না। ভোট ফুরিয়ে গেলে সব খতম। পশ্চিমবঙ্গের এ মুসলিম ভোট একটি ম্যাজিক ফিগার। তবু তারা ভোট ব্যাংক! আর তৃণমূলের মুসলিম নেতারা যেন বোবা।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি