আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন। তা কার্যকর করা নিয়েই এখন নানা কথা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ছিঁচকে চুরি বা যেনতেন হত্যা কিংবা নির্যাতনের নয়। তা কেবল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ই নয়, টানা জবরদস্তিমূলক শাসনামলের পুরোটা সময় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ জঘন্য নানা অপরাধ তিনি করেছেন। কিছু করেছেন নিজে, কিছু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, বাকিগুলো সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে। পরিকল্পিত নির্যাতন, বিনাশ, গায়েবি মামলার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বাইরে লুট-চুরি-চামারিসহ দেশবিরোধী, সমাজবিরোধী হেন অপকর্ম নেই যা না করেছেন। একটু দেরিতে হলেও এর পরিণতিতে তাকে দেশ ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই রায় কি শেষ পর্যন্ত প্রতীকী হয়েই থাকবে। কারণ ভারত তাকে বাংলাদেশের কাছে দিচ্ছে না। এ পর্যন্ত তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিচ্ছে। সেখানে থেকে সামনের দিনগুলোতেও হয়তো তিনি উসকানি দিয়েই যাবেন। যেমনটি রায় ঘোষণার আগের দিনও গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছেন। শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কিছু প্রশ্ন তোলার উদ্যোগ নেয়া হবে। আগে থেকেই তা বোঝা যাচ্ছিল। জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। রোম স্ট্যাটিউটে কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে হতে পারে; কিন্তু মূল বিচার এবং শুনানি অভিযুক্তের উপপস্থিতিতে হতে হয়। জাতিসঙ্ঘের তদন্ত রিপোর্টেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশে উচ্চমাত্রায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা আছে। যেসব অপরাধের সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব, পরিচালনা এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের দফতরের ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং’ প্রতিবেদনে এক হাজার চার শতাধিক ছাত্র-জনতা হত্যার তথ্য এসেছে। ৩০ হাজারের মতো মানুষ আহত; যাদের অনেকেই চোখ হারিয়েছেন, হাত-পা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব আহত-নিহতের পরিবারের সদস্যদেরও ক্ষোভ রয়েছে আওয়ামী লীগের ওপর। গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের এ দাগ মুছে যাবে, এটি মনে করার কারণ নেই। এই রায় বদলাতে হলে তাদের ক্ষমতায় আসতে হবে। সেই বিবেচনায় হাসিনার মৃত্যু হয়ে গেছে। দল হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়ার কথা আলোচনায় আছে। এরই মধ্যে কার্যক্রম স্থগিত হয়েই আছে।
সরকার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারবে না। শীর্ষ নেতৃত্বের বড় অংশ পলাতক বা বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে কারাগারে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কোন পথে- সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে অনুশোচনা নেই। বাংলাদেশে ফিরে এসে হাসিনা আবার মায়াকান্না করে আবেদন করবেন, দল চালাবেন, আপাতত সেই লক্ষণ নেই। পারবেন শুধু অডিও-ভিডিওতে পরাজিত চেহারা দেখাতে, ভেংচি দিয়ে নানা উসকানি ছড়াতে।
এই রায়ে শহীদ পরিবারগুলোর সান্ত¡না এতটুকু যে, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখানে মূল হুকুমদাতা হিসেবে হাসিনা কিংবা আসাদুজ্জামান খান কামালদের বাইরে মাঠপর্যায়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো আরো অনেকে ছিলেন। হাসিনার রায়ের মাধ্যমে সে পথে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পার হয়েছে। আবু সাঈদ-মুগ্ধদের ত্যাগকে অর্থপূর্ণ করতে যেতে হবে আরো অনেক পথ। হাসিনা আমলের অন্যতম আতঙ্কের নাম ছিল গুম। বিরুদ্ধ মত দমনের এই হাতিয়ার গোটা সমাজকে একটি দম বন্ধ করা অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গুমবিষয়ক কমিশনের নেতৃত্বে অনেক রোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা সামনে এসেছে। নানা সংশয়ের পরও বিচার শুরু হয়েছে গুমে জড়িত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ অন্যদের। এ বিচারপ্রক্রিয়ার সুষ্ঠু সমাপ্তি ভবিষ্যতে গুমের দরজা বন্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই শহীদ কিংবা আহতের পরিবার ন্যায়বিচার চেয়েছে সব সময়; কিন্তু তাদের অপরিসীম ক্ষতিকে পুঁজি করে গুটিকয়েক পকেট ভারী করতে চায়নি কখনো।
সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে আমাদের আইনি কাঠামো। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় শেষ দিকে। নানা সংশয় আর ঘাত-প্রতিঘাতের পর এখন দেশ অনেকটাই নির্বাচনমুখী। হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর গত কিছু দিনে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা ও সাবেক মন্ত্রী যে মনোভাব দেখাচ্ছেন, আগামী নির্বাচন তাদের ছাড়া হবে না। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পতন ঘটানো ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় বলেও মনে করেন বিদেশে আশ্রয় নেয়া আওয়ামী লীগ নেতারা।
আর সেটি সম্ভব না হলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে না পারে, সেই চেষ্টা করবে দলটি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে স্বল্প সময়ের জন্য ঝটিকা মিছিল করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ঘিরে অনলাইনে ডাক দেয়া ‘লকডাউন’, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির আড়ালে চোরাগোপ্তা ককটেল নিক্ষেপ ও গাড়ি পুড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। যদিও তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন।
এসব কর্মসূচিতে দলটির নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত অনলাইনে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন শেখ হাসিনা, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং কেন্দ্রীয় নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পেছনে বিদেশী শক্তির হাত থাকার কথা শুরু থেকে বলে আসছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু স¤প্রতি ভারতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিউজ ১৮-এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার সরকার পতনে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো বিদেশী শক্তি ‘সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত’ ছিল না বলে জানিয়েছেন। দলটির ভেতরে ‘রিফাইন্ড’ বা ‘পরিশুদ্ধ’ হওয়ার কথার বিপরীতে সোজা উত্তর- ভুল করলেই না রিফাইন্ড বা শুদ্ধ-পরিশুদ্ধ হওয়ার প্রশ্ন। তাই সে বিষয়ে কাছে-কিনারেও না গিয়ে আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র কিংবা অন্য দলের হয়ে আওয়ামী লীগের কারো কারো প্রতিদ্ব›িদ্বতার লক্ষণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
লুকোচুরি বা গুপ্ত পথে না গিয়ে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার দু’টি পথ খোলা আছে। প্রথমত, যেভাবে তারা বিদায় হয়েছে, সেভাবে যদি আরেকটি পাল্টা গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। দ্বিতীয়ত, জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে মাঠে নামা। এ দুইয়ের কোনোটারই নমুনা আছে বলে মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কেন্দ্রীয় নেতাদের বাইরে সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের কাউকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না এখন। পলাতক নেতাদের মধ্যে দ্ব›দ্ব বেড়েছে। বিশেষ করে ভারতে থাকা নেতারা দলীয় সরকারের পতন ও দলের বর্তমান অবস্থার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছেন। দেশে থাকা তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে যে টাকা দরকার; তা কারা দেবেন, সেটি নিয়েও বিভেদ আছে। খারাপ এ সময়ে নানা উসকানিতে ফেলে নেতাদের মার খাইয়ে সুখ নেয়ার একটি গ্রুপও তৈরি হয়েছে, যা আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট মৃত্যু নিশ্চিত করছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



