ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী
জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি। তার শাসনামলে (১৯৭৭-৮১) বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি স্বনির্ভরতা, সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন।
জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির মূল দিক
জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম এবং প্রধান দিক ছিল দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থান তৈরি হয়। জিয়া বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী, স্বাধীন এবং মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
জিয়াউর রহমান পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা পছন্দ করতেন। বিদেশী শক্তির প্রভাবে দেশ পরিচালনা না করে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ছিল ‘জোটনিরপেক্ষতা’ তত্তে¡র অনুসরণ, যা ছিল পূর্ববর্তী শাসকদের তুলনায় ভিন্ন।
বিশ্ব শক্তির সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য : জিয়াউর রহমান জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে কার্যকরভাবে উপস্থাপন করেন এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন। পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। পাশাপাশি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ পূর্ব বøকের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন।
ভারতের সাথে সম্পর্ক : জিয়াউর রহমানের সময় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা অপরিসীম হলেও, পরে বাংলাদেশের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি নিয়ে উভয় দেশ দ্ব›েদ্ব জড়িয়েছিল। তবে জিয়াউর রহমান ভারতকে প্রধান প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচনা করেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করেন। তিনি সামরিক নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে চেয়েছিলেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি ভারতকে অনেক সময় সতর্ক করেন, যাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ না হয়।
পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক : জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত করার লক্ষ্যে কাজ করেন। এ সময়ে পাকিস্তানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখা হয়, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে। এ ছাড়াও পাকিস্তানের সাথে সামরিক সহযোগিতা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও নতুন মাত্রা পেয়েছিল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনে পদক্ষেপ : জিয়াউর রহমানের সময় আরব দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ে। আরব দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সম্পর্কের ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশ তখনো মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। জিয়াউর রহমানের কূটনীতির ফলে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
বিশেষ করে, সৌদি আরব, কুয়েত এবং অন্যান্য গালফ দেশের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এদের সাথে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, ঋণ সুবিধা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে সমন্বয় ঘটে। এসব সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক : পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল মিশ্র। জিয়াউর রহমান পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের অবস্থান এবং প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষা, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি। তবে তার সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে কিছুটা জটিলতা ছিল, কারণ তিনি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের হস্তক্ষেপকে প্রায়শ ভালোভাবে নিতেন না। তবে তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে মিত্র হিসেবে পাবার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।
সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট ব্লকের সাথে সম্পর্ক : জিয়াউর রহমানের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট ব্লকের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত বাস্তববাদী। জিয়া জানতেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার অধীন রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, বিশেষ করে তাদের থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য এবং সামরিক সহায়তা পাওয়া সম্ভব।
তবে জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কিছুটা সংযত মনোভাব পোষণ করতেন, যাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি না আসে। তিনি এ ধরনের সম্পর্ককে সুষম এবং সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলেন, যা তার কূটনৈতিক দক্ষতার প্রতিফলন ছিল।
জাতীয় স্বার্থরক্ষা : রাষ্ট্রপতি জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি দেশের জাতীয় স্বার্থের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি দেশ যত ছোট হোক না কেন, তার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানানো জরুরি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এবং বিশ্ব শান্তির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ ছাড়া জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের ভূমিকা শক্তিশালী করতে একাধিক উদ্যোগ নেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকে, যা দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্মরণযোগ্য তিনি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের সাথে সম্পর্ক : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে, জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। তিনি বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ হ্রাস, উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা এবং বিদেশী বিনিয়োগে একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে আগ্রহী ছিলেন।
সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা জিয়া : সার্ক বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৮০ সালে সার্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন এবং এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা, শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেন।
সার্কের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, যেমন- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তান, একে অপরের সাথে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করতে এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজের সুযোগ পায়। এ ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা প্রতিষ্ঠায় জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সামরিক শক্তি এবং পররাষ্ট্রনীতি : জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণে গুরুত্ব দেন। তার মতে, দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শক্তিশালী সামরিক বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশকে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ১৯৮৮ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ শুরু করলেও, মূলত তার সময় থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে আন্তর্জাতিক মিশনগুলোতে অংশগ্রহণের সূচনা হয়।
জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ : যদিও জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল, তবু তার শাসনামলকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সিদ্ধান্ত অনেক সময় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়াস হিসেবে দেখা হলেও, পররাষ্ট্রনীতির কিছু দিক যেমন- প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের সঠিক ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্কের অস্থিরতা, বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। তার শাসনামলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং পররাষ্ট্রনীতি নতুন রূপ লাভ করেছিল। যদিও তার কিছু পদক্ষেপ বিতর্কিত ছিল, তবে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী ও সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছিল। তার পররাষ্ট্রনীতি আজো বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



