আরব বসন্তের উত্থানের পরে তিউনিসিয়ার আন নাহদা এবং মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও খুব দ্রুত রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে গেছে। মূল প্রশ্ন হলো, কেন উল্লিখিত দেশ দু’টিতে টিকতে পারল না? দুর্বলতা কী ছিল? বাংলাদেশে যারা রাজনীতিতে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত তাদের এ থেকে কী শিক্ষা নেয়ার আছে?
বিশ্বের শীর্ষ বিশ্লেষকরা- অলিভিয়ে রোয়া, নোয়া ফেল্ডম্যান, শাদি হামিদ, নাথান ব্রাউন, খলিল আনানী, আসেফ বায়াত, ইউসুফ শেরিফ, ফাওয়াজ গেরগেস- এ ব্যর্থতার পেছনে যে ব্যাখ্যাগুলো দেন, সেগুলো বাংলাদেশের ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জরুরি শিক্ষণীয়।
এ দু’টি দেশে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণ কেবল বাহ্যিক চাপ নয়- গভীরে ছিল রাজনৈতিক অদক্ষতা, ভুল কৌশল এবং আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে অজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা আজ বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা বহন করে।
১. রাষ্ট্রযন্ত্রের বাস্তবতা না বোঝা
নোয়া ফেল্ডম্যান দেখিয়েছেন-ইসলামী দলগুলো নির্বাচনে জিতলেও সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র (ব্যুরোক্র্যাসি), বিচারব্যবস্থা, নিরাপত্তাকাঠামো এবং মিডিয়ার মতো মূল ক্ষমতাকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে ছিল না। শুধু জনপ্রিয়তায় ক্ষমতা- এ ভুল ধারণা ওই দুটি দেশে ইসলামপন্থীদের দ্রুত রাজনৈতিক পতন ডেকে আনে।
২. নীতি-প্রণয়ন ও বিশেষজ্ঞ নেতৃত্বের ঘাটতি
ইসলামী দলগুলো আন্দোলন সংগঠনে দক্ষ হলেও- অর্থনীতি, কূটনীতি, প্রশাসন, নিরাপত্তা, আধুনিক নীতি উদ্ভাবন-এসব ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ক্ষমতায় এসে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া এবং দূরদর্শিতার অভাবে প্রশাসনিক অদক্ষতা, নীতির ঘাটতি প্রভৃতি সঙ্কটে পড়ে।
৩. ভূরাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতার অভাব
অলিভিয়ে রোয়া লিখেছেন, ‘তারা অতীতের গৌরব বয়ানে মগ্ন থাকেন, কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বৈশ্বিক শক্তির হিসাব বোঝেন না।’
মিসরের ব্রাদারহুড
আঞ্চলিক শক্তির ভূমিকা, সেনাবাহিনীর প্রকৃত ক্ষমতা, আন্তর্জাতিক চাপ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা এসব ভুলভাবে মূল্যায়ন করায় গুরুতর রাজনৈতিক ক্ষতিতে পড়ে।
৪. বিরোধীদের সামলাতে ব্যর্থতা
শাদি হামিদ লিখেছেন, নিজেকে ‘ভিকটিম’ মনে করলে রাজনৈতিক অভিযোজন (পলিটিক্যাল অ্যাডাপটেশন) ক্ষমতা কমে যায়।’ বিরোধীদের অন্তর্ভুক্ত করা, পারস্পরিক সমঝোতা করা, আলোচনা ও জোট- এসবকে রাজনীতির স্বাভাবিক অংশ হিসেবে না নেয়ায় দ্রুত রাজনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়ে।
৫. বাজার স্থিতিশীলতায় অক্ষমতা
মিসরের ব্রাদারহুড দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ও বাজারে পণ্য সরবরাহ বজায়ে রাখতে ব্যর্থ হয়, জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় অক্ষমতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং সরবরাহ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় মিসরে ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে ছিটকে ফেলতে অন্যতম কার্যকারণ হয়ে ওঠে। ফাওয়াজ গেরগেস বলেন, ‘মুরসির পতনের প্রধান কারণ আদর্শিক নয়; অর্থনৈতিক ব্যর্থতা।’ জনগণ অর্থনৈতিক কষ্ট কখনো ক্ষমা করে না, এটাই তাদের রাজনৈতিক পরাজয় ত্বরান্বিত করে।
৬. পোশাকের পরিচয়ে সমাজে দূরত্ব সৃষ্টি
যদিও ইসলাম কখনো কোনো নির্দিষ্ট পোশাককে বিশ্ব মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেনি, তবু অনেক ইসলামপন্থী দল বাহ্যিক পোশাককে ইসলামী পরিচয়ের প্রধান ভিত্তি মনে করে। আসেফ বায়াত এ বিষয়ে বলেন, ইসলামিজম অব অ্যাপেয়ারেন্স, নট ইসলামিজম অব গভর্ন্যান্স’। এর ফলে তরুণসমাজ দূরে সরে যায়, নেতৃত্বের যোগ্যতা আড়াল হয়, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৭. বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর দুর্বলতা :
রি-ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব এবং একাত্তরের বিতর্ক থেকে বের হতে না পারা বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর জন্য একটি বাড়তি সমস্যা। জামায়াত-নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করেনি, কাঠামোগত সংস্কার করেনি, রি-ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেয়নি। ফলে একাত্তরের ঐতিহাসিক ভূমিকা এখনো বিরোধীদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। এসবের বিপরীতে জামায়াত গতানুগতিক বয়ানে আটকে আছে। যেমন ‘শহীদি কাফেলা’ ইত্যাদি ধরনের আবেগী ভাষা কর্মীদের উদ্দীপিত রাখতে পারলেও আসল কাজ নীতি উদ্ভাবন, প্রশাসনিক দক্ষতা, সৃজনশীল নেতৃত্ব ও আধুনিক রাষ্ট্র পরিকল্পনার চিন্তা নিস্তেজ করছে। আন্দোলনের মানসিকতা থেকে সরকার পরিচালনার মানসিকতায় উঠতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর সামনে আজ মোক্ষম সুযোগ ও নতুন দায়িত্ব হাজির। যদি আগামী নির্বাচনে জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামী দলগুলো বিজয়ী হয়; তখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই, অর্থনৈতিক নীতি, শিল্পনীতি, বাজার-ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক সংস্কার, সামাজিক নীতি, পররাষ্ট্র নীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্পষ্ট, আধুনিক ও বাস্তবসম্মত পথরেখা থাকতে হবে। সঠিক নীতি ও প্রস্তুতি থাকলে এ দেশের ইসলামপন্থীদের সামনে সম্ভাবনার অবারিত দুয়ার খুলে যাবে।
লেখক : কানাডা প্রবাসী রাজনৈতিক বিশ্লেষক



