শিশু দিবসের ভাবনা

আজকের পথশিশু এবং এতিমদের জন্য রাষ্ট্রীয় আশ্রয়, নিরাপত্তা, তাদের মনোদৈহিক প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিয়ে তাদেরকে আলোকিত নাগরিকে পরিণত করাই হোক এবারের শিশু দিবসের অঙ্গীকার।

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম |নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

৬ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস অনেকটা নীরবেই চলে গেল। এই দিনে বিশেষ কোনো আয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের পক্ষে কিংবা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় করা হয়নি। অথচ বলা হয়, আগামীর নেতৃত্ব তৈরি হবে আজকের শিশুদের মধ্য থেকেই। তারাই গড়বে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ। তারা বিশ্বকে নতুনভাবে গড়বে, নেতৃত্ব দেবে। এ জন্য শিশুদের মানসিক ও শারীরিক দক্ষতার বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশুর প্রতিভা বিকাশে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে সমগ্র শিক্ষাকাল শিশুদের গড়ে ওঠার, বিকশিত হওয়ার সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা বিধান করে রাষ্ট্র। পরিবার ও সমাজ এ ক্ষেত্রে কাজ করে অনুঘটকের।

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের প্রয়োজন এবং গুরুত্ব বিষয়ে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পৃথিবীব্যাপী ৬ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস। একই সাথে শিশু অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যও রয়েছে।

শিশু দিবসে এ বছর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও শিশু একাডেমি ছাড়া আর কোথাও কোনো আয়োজন দেখা যায়নি। মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের প্রবক্তরাও কেন যেন এ দিবসে নিশ্চুপ। যদিও সারা দেশে বাবা-মা হারা শিশুর সংখ্যার সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আমাদের জানা নেই, তবে বিভিন্ন সংস্থার বরাতে জানা যায়, সংখ্যাটা প্রায় ৫০ লাখের মতো। অন্য দিকে মার্চ ২০২৪ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৩৪ লাখ শিশুর রাত কাটে শহরের স্টেশনে, বাসস্টেশনে, ফেরিঘাটে, ফুটপাথ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির সিঁড়িতে বা বারান্দায়। ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রায় এক কোটি এতিম ও পথশিশুর ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য, তাদের নিরাপত্তা, তাদের আশ্রয়-শিক্ষা ও চিকিৎসার কথা ঠাঁই পায়নি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়, ঠাঁই পায়নি কোনো আলোচনা সভায় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের মুখেও এ বিষয়ে কোনো কথা শোনা যায়নি। অবহেলিত এসব শিশুর গন্তব্য কোথায়? তারাও তো এ দেশেরই সন্তান। সুষ্ঠু পরিবেশ এবং শিক্ষা ও আশ্রয়ের অভাবে এদের অধিকাংশই বখে যায়, অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়, গড়ে তোলে কিশোর গ্যাং। সামাজিক জীবনে আইনি শাসনের ক্ষেত্রে এরা একটা কালো তিলক। অথচ তাদের সুষ্ঠু পরিবেশ ও সুরক্ষা দিতে পারলে তারাই হয়ে উঠতে পারে আলোকিত নাগরিক, যারা দেশ ও জাতির কল্যাণে নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা লাভ করতে পারে। পরিবর্তে তারা অবহেলিত, উপেক্ষিতই রয়ে যাচ্ছে। বঞ্চনার মানসিকতা নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে। মানবাধিকারের পাঠ তাদের কাছে পৌঁছায় না। তারা হয়ে ওঠে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের হুকুমবরদার; তাদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। স্বার্থবাদী ও পুঁজিবাদী সমাজে এরা শুধুই স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। অন্য দিকে ইসলাম এদেরকে দিয়েছে নিশ্চিত অধিকার ও সুরক্ষা। মর্যাদাপূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বড় হওয়া স্নেহ ও আদর পাওয়ার অধিকার, সমানাধিকার, উত্তরাধিকার, সামাজিক ও জাতীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার অধিকার। পরিবারের প্রতিটি শিশুকে সমভাবে দেখা, তাদের মনোদৈহিক প্রতিভা বিকাশের সুব্যবস্থা- তাদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ইসলামী জীবনাচারে। তাদের সুন্দর নাম রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নৈতিক ও মৌলিক শিক্ষাসহ পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার সুবিধার কথা বলা হয়েছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, পেশা এবং জীবনসাথী বেছে নেয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ইসলামী সমাজব্যবস্থায় রয়েছে। এতিমদের অরক্ষিত সম্পদের নিরাপত্তা বিধানসহ তাদের মৌলিক চাহিদা জোগানের নিশ্চয়তা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ইসলামী জীবনাচারে।

আজকের পথশিশু এবং এতিমদের জন্য রাষ্ট্রীয় আশ্রয়, নিরাপত্তা, তাদের মনোদৈহিক প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিয়ে তাদেরকে আলোকিত নাগরিকে পরিণত করাই হোক এবারের শিশু দিবসের অঙ্গীকার। এ কথা আমাদের কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না- ১৮ কোটি জনসংখ্যার ভেতর এক কোটি ভবিষ্যৎ নাগরিককে সুবিধাবঞ্চিত রেখে সৃষ্টিধর্মী ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিকল্পনার সাথে সাথে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবধর্মী কর্মসূচি, যা প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্রে সংযোজিত হওয়া দরকার। প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক দলের সুস্পষ্ট বাস্তবায়নযোগ্য শিশুনীতি।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]