আমাদের মূল্যবান মুহূর্তগুলো

দুর্নীতির টাকা দিয়েই সুশাসন ও নীতিনৈতিকতার টুঁটি চেপে ধরার শক্তি ও সামর্থ্য যদি এমনই বলশালী হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তার সর্বনাশ দেখার জন্য অপেক্ষা করারও থাকবে না কিছুই।

মনোহরদীর মোহন মিয়ার ভোররাতে ওঠার অভ্যাস সেই কৈশোরকাল থেকেই। আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ- এ ধরনের প্রবাদবাক্যের জন্য শুধু নয়, মোহন মিয়া জানে অতি ভোররাত ইবাদত-বন্দেগির, এ সময় খোদার সাথে মোলাকাতের মর্তবা অনেক, পড়াশোনা ও লেখালেখির সেরা সময়ও এটি। আগের দিনের চিন্তাভাবনা কায়কারবারের হিসাবনিকাশ আগের রাতে শেষ হলেও চলমান জীবনে তার রেশ বা রিকনসিলিয়েশন বা তামামি চলতেই থাকে। চার ধারে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্যানধারণায় ভেবে পায় না মোহন মিয়া, ইদানীং তার দয়াময় দাতা সৃষ্টিকর্তাকে মন খুলে ডাকতে বা স্মরণে আনতে প্রকাশ্য হতে তাগিদ অনুভব করে না। মোহন মিয়া প্রায়ই ভুলে যায়, তার ‘দুই কাঁধে দুই মুহুরি লিখতে আছেন ডায়েরি’। সারা দিন নিজের, পরিবারের, পাড়া-প্রতিবেশীর, সমাজের, দেশের এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেবের অতিমাত্রার লাফালাফি নিয়েও হরেকরকম চিন্তাভাবনা মোহন মিয়াকে তাড়া করে ফিরলেও তার কদাচিৎ মনে হয় না যে, তার দুই কাঁধে যে দুই মুহুরি তার নিজের ডায়েরি লিখে চলছেন, তাদের কথা তার কেন স্মরণে আসে না? আসতই যদি তাহলে তার বা তাদের চলাচলে কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা চালাচালিতে অন্তত একটা সচেতনতা আসতে পারত। মোহন মিয়া এটি ভেবেই পায় না, তার নফস বা প্রবৃত্তি কিভাবে শয়তানের সাম্রাজ্যবাদী কর্মপরিকল্পনার কাছে বারবার ধরা খাচ্ছে। মোহন মিয়ার চিন্তার চৌহদ্দিতে এটি আসে না যে, তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান। কেননা, একেকটি মুহূর্ত তার জীবনের জন্য বরাদ্দকৃত সময় থেকে মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। সে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে। যে মৃত্যু অবধারিত। যে সময় চলে যাচ্ছে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

ভোররাতে প্রভু নিরঞ্জনের সাথে মোলাকাতের সময় মোহন মিয়া ভাবে- তার জীবন থেকে ইতোমধ্যে কিভাবে লাখ লাখ মুহূর্ত চলে গেছে, অনেকটা অবহেলায়, অগোচরে, বেহিসাবে বিনা বিবেচনায়। দেশের অর্থনীতি, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ সংস্কার, আত্মবিশ্লেষণ কত কিছু নিয়ে ভাবভাবনা মোহন মিয়ার মাথায় আসে-যায়। কিন্তু এসবে কী তার সঞ্চয়, কী তার অর্জন বা বর্জন তার হিসাব মেলাতে পারে না। ভূ-রাজনীতির ভায়রাভাইরা তাকে হিসাব মেলানোর ফুরসত দেয় না। বিভিন্ন ছুতানাতায় তাকে ব্যস্ত রাখে, ব্যস্তবাগিশ শয়তান। মোহন মিয়া ইদানীং ঘাপটি মারা মিডিয়ার খপ্পরে পড়তে চায় না; কিন্তু চোখ এখন যেন মোবাইল ফোনের কাছে লিজ দেয়া। প্রকৃতি তার চার পাশে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে সে দিকে তার চোখ যায় কম। রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে পড়ায় সেই রাজনীতি এমনভাবে তার মন-মানসিকতায় ঢুকে পড়ছে যে, এখন তার দেশে ডেঙ্গুরোগে প্রতিদিন কত মানুষ ভুগছে, কষ্ট পাচ্ছে এটি রাজনীতির ডামাডোলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে, স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অর্থনীতি, শিল্প উৎপাদন, বেসরকারি বিনিয়োগের বেহাল অবস্থা- এসব রাজনীতির তর্কবাগিশদের চিন্তাভাবনার জাবেদা বইয়ে ততটা এন্ট্রি পাচ্ছে না। যতটা অন্য অনেক ছোটখাটো বিষয়ের পেছনে সবার মূল্যবান সময় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।

দেশের অর্থনীতি যদি বেগতিক হয়, দ্রব্যমূল্য যদি চলে যায় আমজনতার ধরাছোঁয়ার বাইরে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তাহলে রাজনীতিবিদরা কাদের নিয়ে, কী দিয়ে করবেন বাহাদুরি, চাঁদাবাজির বিনিময়ে দেশসেবা? দুর্নীতির দুষ্টচক্রে নীতিনির্ভরতা এখন আইসিইউতে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষককে এখন ছুটি নিতেও ঘুষ দিতে হয়। এসব দেখেশুনে মোহন মিয়া বড় বিব্রত, বড় বিমর্ষ, বড় অসহায় বোধ করে। অগোছালো এলোমেলোভাবে তার জীবন থেকে একেকটি দিন চলে যাচ্ছে। থামানো যাচ্ছে না। আসলে কি প্রবহমান সময়কে থামানো যায়? যায় না। কিন্তু যে চলে যাচ্ছে সে কী রেখে যেতে পারছে সেটি দেখার অবকাশ তার মিলছে না। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ধান্ধায় এভাবে থাকতে থাকতে তালিবালি করে জীবনযাপনে না তার নিজের না পরিবারের, পাড়া প্রতিবেশীর, না দেশের জন্য কিছু রেখে যেতে পারছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা তাকে এগোতে দিচ্ছে না। জট পাকানো চিন্তাভাবনা তাকে প্রভু নিরঞ্জনের সাথে মোলাকাতের সময়ও বাধা সৃষ্টি করেই চলেছে। কিভাবে তার চিন্তাভাবনা স্বচ্ছ, সুশৃঙ্খল ও জবাবদিহির মধ্যে আনা যায়, এ নিয়ে মোরাকাবায় বসার তাগিদ এসেও আসছে না। এমন অস্থির সময়ে এর আগে মোহন মিয়া পড়েনি।

মোহন মিয়ার বয়স চার কুড়ি হতে আট বছর বাকি। যখনই তার সামনে অঘটন কিছু ঘটে তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার মাথায়, মনে ও মুখে সান্ত¡না ও প্রবোধ জাগে, দৈবিপাকে ঠেকে যা শিখলাম তা আর কখনো ঘটবে না ভবিষ্যতে। ইদানীং কেন জানি তার মনে প্রশ্ন জাগছে, এই ঠেকে শেখার কি কোনো শেষ নেই? ঠেকে শিখতে শিখতে তার কবরে যাওয়া পর্যন্ত এবং তার পরের প্রজন্মের মধ্যেও এই ঠেকে শেখার কার্যক্রম এডিপিতে বরাদ্দ না থাকলেও চলতে থাকবে বলে তার ধারণা। সেই আদি পিতা হজরত আদম ইবলিশ শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেছিলেন। প্রভু নিরঞ্জনের নির্দেশ-উপদেশ উপেক্ষা করে সম্পাদিত সেই ভুলের খেসারত হিসেবে স্বর্গ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল প্রথম মানব-মানবীকে। মোহন মিয়ার ধারণা, এমনতর অসতর্ক না হলে, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল না করলে, এমন নির্দেশ অমান্যের ঘটনা না ঘটলে আজ সবাই স্বর্গে স্থায়ীভাবে বিনা দলাদলিতে বিনা সঙ্কট, সন্ত্রাসে, নিঃসংশয়ে বাস করা যেত। যা হোক, আদি মানবের প্রথম নির্দেশ অমান্যের ঘটনা থেকে গতকাল পর্যন্ত সারাবিশ্বে যত নিষেধাজ্ঞা, অমান্য, আইনের বরখেলাপ, চোরাগোপ্তা হামলা, ডাকাতি, পুকুর ও সাগর চুরি, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা, দুর্নীতি-দুঃশাসন, স্বৈরাচার- সবকিছুর সালতামামি ও শুমার করলে তার সারমর্ম দাঁড়ায় অনেকেরই ‘ঠেকে শেখা শেষ হয়নি’ অর্থাৎ অনেকেই উপযুক্ত শিক্ষা পাননি।

অনুপযুক্ত ওরফে কুশিক্ষার কারণে একেকটি দুর্ঘটনা ঘটে আর তখনই আশায় বুক বাঁধা হয়ে যায়, এমন ভুল আর ঘটবে না, এমন পথে পা বাড়ানো হবে না, ইত্যাদি। আর যারা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন, ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা বা পথপন্থা শুরু করেন তাতে কখনো সখনো মনেও হয় এমন সুরক্ষা লাভ ঘটবে যে, তাতে শনৈঃশনৈঃ গতিতে উন্নতির পথে সবাই যাবে বা থাকবে। কিন্তু এরকম প্রবোধ, প্রত্যয় অতীতে অনেক ঘটনার পরপরই নেয়া হয়েছে কিন্তু ঘটনা-দুর্ঘটনা থেমে থাকেনি। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা, প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা বস্তুতপক্ষে সেভাবে থামাতে পারেনি অঘটন সংঘটন।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, সনাতন কথা। আর ভারতে ব্রিটিশ সরকার সবাইকে শিখিয়ে গেছেন, ‘চোর তো চুরি করবেই গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে’, সেই চাণক্যের আমল থেকে বলা হচ্ছে- ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ’। এমনতরো নীতিকথা খনারবচনে ঠাঁই পাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েই চলেছে। এগুলো প্রায়শ উচ্চারিত হয় ঠেকে শেখার পর প্রবোধ দেয়ার জন্য। মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি বড় হয়, চুল পাকে যে প্রকারে ও গতিতে, চোর-ডাকাত আর দুষ্কর্মী দুর্নীতিবাজের হাত পাকে তার চাইতে বেশি মাত্রায় ও গতিতে, সে কারণেও ঠেকে শেখা শেষ হয় না। কেননা, কালো টাকায় দুষ্ট বুদ্ধির বিনিয়োগ বেশ প্রখর, লক্ষ্যভেদী ও সুতীক্ষè, পক্ষান্তরে তাকে মোকাবেলা করা ওরফে মাড়িয়ে বা এড়িয়ে চলার প্রয়াস-প্রচেষ্টা কেন যেন তত জোরালো নয়। পরস্পরের দোষারোপে অধিকাংশ সময় পার হয় এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঠেকে শেখার উপাদান শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। একটু অন্য কায়দায় কিছু একটা ঘটলে তখন সবাই আবার যুক্তির বাড়ি দৌড়ায়, যৌক্তিকতা খোঁজার কাজে লেগে যায় এবং একসময় আবার ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানেরটা বটেই, অতীতেরটা মোকাবেলার অগ্রগতি অনুসরণের জন্য উদ্যম আর মেলে না। এসবই উপযুক্ত, কার্যকর তথা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার অবর্তমানে, অভাবে।

মোহন মিয়ারা এমন একসময় ও পরিবেশে বাস করে সেখানে অতি সতর্কতার নামে সময় ব্যয় হয় যত্রতত্র। দুরবস্থা থেকে দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূরে। সেখানে সকালে সবাই সুকান্তের মতো ‘শিশুর নিরাপদ বাসযোগ্য বিশ্ব রচনায় মনোনিবেশের মন্ত্র জপে, তাদের সময় কাটে ‘সব জঞ্জাল সরানোর’ প্রত্যয় ও প্রগলভতায়। কিন্তু কিছুই না করে বা করতে না পেরে বিকেলে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়ে সবাই বলে, ‘আমার হাতে তো ছিল না পৃথিবীর ভার’। অদৃশ্যের ওপর সব দায় চাপানোর চৌকস চতুর লোকের সংখ্যা বাড়ছে সমাজে। আসলে দশখান অব্যবস্থাপনার মধ্যে সবাইকে ব্যস্ত রেখে ঠেকে শেখার দাওয়াইয়ের আড়ালে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কারো আসল কাজ উদ্ধারের পথ করা হয় প্রশস্ত।

নানাবিধ উন্নতির অবয়বে গ্রামীণ সমাজে ভাঙা-গড়ার পটপরিবর্তন হচ্ছে। সেখানে ঠেকে শেখার আকাক্সক্ষারাও দ্রুত ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন অপকর্মের উন্নতিতে। যা কোনো দিন ভাবা হয়নি বা যায়নি, তা ঘটছে এখন গ্রামীণ সমাজজীবনেও। গ্রেশামের থিওরি মতো নগরের মতো গ্রাম থেকেও সুবচন, ধৈর্যশীলতা, শোভনীয়তা নির্বাসিত-অপসারিত অপদস্থ হচ্ছে, সেখানেও অকর্মন্য-অপদার্থদের সরব উপস্থিতি বাড়ছে। যুবসমাজের মধ্যে যে অস্থিরতা বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে শিক্ষায়তনে যেন পড়াশুনার যথাযথ চাপ বা তাগিদ নেই, পরীক্ষা দিলে পাস হয়ে যাওয়ার প্রথা পরিব্যপ্ত হওয়ার ফলে মাদকাসক্তি বাড়ছে, মুঠোফোনে, দূরদর্শনে দেশী-বিদেশী অবৈধ সংস্কৃতির অবাধ প্রচার বাড়ছে। কাউকে মর্মান্তিক আক্রমণ করার ছবি তোলার লোক পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু আক্রমণ ঠেকানো বা উদ্ধারে এগিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবক ও সমাজচিন্তকদের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। শিক্ষকসমাজে আদর্শস্থানীয়দের অপসৃয়মানতায় অবস্থা আরো সঙ্গিন। সমাজের সামনে ঠেকে শেখার ব্যাপ্তি বাড়ছে।

উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ও মানসিকতা না বাড়ার কারণ শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণের দিকে যথানজর না থাকায় বারবার নতুন অবয়বে দুর্ঘটনা ঘটছে। আজকাল অনেকেই কেন যেন নাটকীয়তা পছন্দ করেন। তৃপ্তি পান একের পর এক ঘটনা ঘটুক, এটি যেন চান কেউ কেউ। দুর্ঘটনার পেছনে সবাই দৌড়ায়, কেন দুর্ঘটনা ঘটছে তার ‘কজ’ ও ‘ইফেক্ট’-এর মূল্যায়ন ও তদারকি হচ্ছে না। দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ এবং এর উৎসমূলে যাওয়া হয় না, কারণ প্রতিকার, প্রতিরোধ, প্রতিষেধনে, তদন্ত প্রতিবেদনে চোখ দেয়ারই যেন সময় নেই। দুর্ঘটনার পরবর্তী বিষয় নিয়ে পরস্পর দোষারোপে মেতে ওঠা হয়। প্রচার-প্রগলভতায় ভোগা হয় কিছু একটা করা হচ্ছে দেখে। দুর্ঘটনার উৎসমুখ বন্ধ করার উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না। এ যেন দুর্নীতি হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ যেমন শুরু হয়, যখন ক্ষতি বা দুর্নীতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। দুর্নীতির টাকা দিয়েই সুশাসন ও নীতিনৈতিকতার টুঁটি চেপে ধরার শক্তি ও সামর্থ্য যদি এমনই বলশালী হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তার সর্বনাশ দেখার জন্য অপেক্ষা করারও থাকবে না কিছুই।

লেখক : অনুচিন্তক