কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষিতে নিযুক্ত। খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের আয় ও রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কৃষি। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে, মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে এবং ফসলের গুণমান নিশ্চিত করতে সারের ব্যবহার অপরিহার্য। সারের যথাযথ ব্যবহার না হলে ফলন কমে যেতে পারে, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন ফসলের জন্য ইউরিয়া, ফসফেট ও পটাশ সারের চাহিদা বিপুল। বাংলাদেশে ২০০০-২০২৫ সময়কালে সার ব্যবহারের হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান, আখ ও সবজিতে সারের যথাযথ ব্যবহারে হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ২০-৩০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে সারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস এবং আমদানিতে বাধার কারণে বিশেষ করে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ইউরিয়ার অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ও আমদানির ঘাটতির কারণে দেশের মোট সাপ্লাই প্রায় ১৫-২০ শতাংশ কমেছে। এই সঙ্কট দেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশে ধানের মূল তিনটি মৌসুম- আউশ, আমন ও বোরো। এর মধ্যে বোরো মৌসুম সেচভিত্তিক হওয়ায় সার প্রয়োগের চাহিদা সর্বোচ্চ। আমন মৌসুমে বৃষ্টিভিত্তিক চাষের কারণে সার ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম হতে পারে, তবে সঠিক প্রয়োগ না হলে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। আউশ মৌসুমে হেক্টরপ্রতি জমির আয়তন কম এবং সারের চাহিদা কম হলেও ভুল প্রয়োগে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
তথ্যমতে, দেশে ইউরিয়ার চাহিদার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। পটাশ ও ফসফেট প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আসে। দেশে উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও তা কার্যকরভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। এর কারণ, কাঁচামালের অনিশ্চয়তা, পুরনো প্রযুক্তি, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, গ্যাস সরবরাহের সমস্যা।
বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে সারের ব্যবহার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো সঠিক সার মিশ্রণ, চাষি প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি স¤প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়িয়েছে। মাটির ধরন, ফসল ও জমির অবস্থার সঠিক বিশ্লেষণ ছাড়া সার প্রয়োগ হলে তা অপচয় ও মাটির ক্ষয় ঘটাতে পারে। এ ছাড়া, সারের শুধু পরিমাণ নয়, সঠিক সময় ও সংমিশ্রণের প্রয়োগ অপরিহার্য। দেখা গেছে, কৃষকের সচেতনতার অভাবে সারের উচ্চ ব্যবহার সত্ত্বেও ফলনে যথাযথ বৃদ্ধি হয়নি।
বাংলাদেশে সারের উৎপাদন ও আমদানি দেশের কৃষি নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় উৎপাদনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউরিয়া কারখানা। কিন্তু গ্যাসের অনিয়মিত সরবরাহ, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও যন্ত্রাংশের অভাবে কারখানাগুলোয় পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে বার্ষিক চাহিদার বড় অংশই আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানি খরচ বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। দেশের সার বাজার বিদেশী নির্ভরশীলতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ এবং অর্থনীতিতে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা বিশেষভাবে কৃষি খাতের জন্য ক্ষতিকর। কৃষি খাত এখনো দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১১-১২ শতাংশ অবদান রাখে।
সারের সঙ্কটের পেছনে বাস্তব ও কৃত্রিম উভয় কারণ কাজ করছে। বৈশ্বিকভাবে গ্যাস ও জ্বালানির দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মিউরেট অব পটাশ সার সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে, বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা, কালোবাজারি, অবৈধ মজুদ ও মনিটরিং অভাব সঙ্কটকে আরো গভীর করেছে। এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ে সারের স্থানীয় সরবরাহের মাত্রা চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষকরা যথাযথ সময়ে সার না পাওয়ায় চাষ পরিকল্পনায় অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছেন এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
সারের অভাব সরাসরি কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। যথাযথ সার ব্যবহার না হলে ধানের হেক্টরভিত্তিক ফলন প্রায় ছয়-সাত টন থেকে কমে চার-পাঁচ টনে নেমে যেতে পারে, একইভাবে আখ ও সবজির উৎপাদনও প্রায় ২০-৩০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। ফলস্বরূপ কৃষকের আয় কমে যায় এবং অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে সারের অভাব সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রায় চাপ সৃষ্টি করছে। ২০২৪ সালে সার আমদানি খরচের ২৮ হাজার ৯৬৮ মিলিয়ন টাকার প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশী মুদ্রায় হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য হুমকির মুখে। কৃষি খাতের স্থবিরতা গ্রামীণ কর্মসংস্থান, আয় এবং সমগ্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলছে।
খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সারের সঙ্কট বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। সাপ্লাই বিঘ্নের কারণে দেশে চাহিদার তুলনায় খাদ্য উৎপাদন কমে যেতে পারে, খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হতে পারে এবং বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি জনস্বাস্থ্য ও খাদ্যাভ্যাসকে প্রভাবিত করে এবং উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও এ সঙ্কট চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। কৃষকরা সরবরাহ ঘাটতির কারণে সামাজিক উত্তেজনা বা বিক্ষোভ সৃষ্টি করতে পারে, যা সরকারের নীতি বাস্তবায়নে আস্থা কমায়।
বর্তমান বাস্তবতা প্রমাণ করে, দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, বিতরণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা উন্নত করা, অবৈধ মজুদ ও কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণ করা এবং আমদানি-নির্ভরতা কমানো অত্যন্ত জরুরি। সার-সংক্রান্ত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যকর নীতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া কৃষি ও অর্থনীতির ওপর চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
সা¤প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ক্রমে কমছে। সার সঙ্কটের কারণে তা আরো কমে যেতে পারে। অর্থনীতিতে বৃহৎ অংশগ্রহণকারী কৃষি খাত দুর্বল হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিদেশী খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়তে পারে; অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যমূল্য বাড়তে পারে।
এসডিজি-২ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সর্বসাধারণের কাছে নিশ্চিত করা এবং কৃষি উৎপাদন ও আয় দ্বিগুণ করার কথা রয়েছে। সারের সঙ্কট এ লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। কারণ উৎপাদন দক্ষতা কমে যাচ্ছে, কৃষকের আয় সীমিত হচ্ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ছে। একই সাথে এসডিজি-১২ এর ‘দায়িত্বপূর্ণ উৎপাদন ও ব্যবহার’ অর্থাৎ পুষ্টিসংবলিত খাদ্য উৎপাদন ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করার লক্ষ্যে সারের সঠিক ব্যবহারের অপরিহার্যতা রয়েছে। সারের অপচয় বা অনিয়মিত প্রয়োগ মাটির কার্যকারিতা নষ্ট করতে পারে, যা পরিবেশ ও উৎপাদনদোষ উভয় দিকেই হুমকি। বাংলাদেশে সারের সঙ্কট কেবল কৃষি খাতের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বড় ফাঁক, সরবরাহে অনিয়ম এবং আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সমস্যাকে জটিল করেছে। এ ছাড়া, বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও নীতিগত ঘাটতিও সঙ্কটের মূল কারণ।
সার সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে হবে। পুরনো কারখানাগুলো আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর, গ্যাস ও উৎপাদন খরচ কমানো এবং কাঁচামালের নিরাপদ সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, আমদানি নীতিকে পুনর্গঠন করতে হবে, প্রধান সরবরাহকারী দেশগুলোর সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা, কাস্টমস ও লজিস্টিক ঝামেলা কমাতে হবে। তৃতীয়ত, সরকারি ও বেসরকারি বিতরণ ব্যবস্থার সমন্বয় বাড়িয়ে কৃষকের কাছে সরাসরি সার পৌঁছান নিশ্চিত করতে হবে, কালোবাজারি ও মজুদের মতো অনিয়ম নির্মূল করতে ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও মনিটরিং কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। চতুর্থত, কৃষকদের সঠিক সময়, পরিমাণ ও মিশ্রণে সার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, তাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। জৈব সারের প্রচলন এবং মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা পরিষেবা স¤প্রসারণ জরুরি। পঞ্চমত, দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কৃষি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়।
পাশাপাশি সারের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে অপচয় কমাতে হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক সুষম কৃষি পদ্ধতিতে কম পরিমাণে সার প্রয়োগে সুফল পাওয়া সম্ভব। অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের কিছু অঞ্চলে ড্রোন, স্যাটেলাইট ইমেজিং, মাটি ও উদ্ভিদের সেন্সর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করে সারের প্রয়োজনীয়তার পরিমাপ ও সেই অনুপাতে সারের মাত্রা এবং সময়সূচি ঠিক করা সম্ভব। আমাদের দেশেও এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলে সারের অপচয় কমবে এবং ফসলের পরিমাণ ও মান দুই-ই উন্নত হবে।
সারের অভাব নিয়ন্ত্রণ ও সমাধান না হলে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট



