এম এ মাসুদ
তিনি রাখঢাক করতে জানতেন না, মুখের উপর সত্য বলতে পছন্দ করতেন। ধরিয়ে দিতেন সরকারের দোষ-ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি। সরকারের জনবিরোধী কাজের ছিলেন তীব্র সমালোচক। কাউকে তোয়াজ তোষামোদ করে কথা বলার লোক ছিলেন না তিনি।
সৎ উপায়ে ব্যবসায় অর্জিত অর্থে তার জীবিকা এবং রাজনীতির ব্যয় নির্বাহ হত, ঋণখেলাপি হয়ে বা ব্যাংক লুট করে নয়। মানুষটি আর কেউ নন, তিনি হলেন একজন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান, সংবিধান বিশেষজ্ঞ রাজনীতিবিদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আজ ২২ নভেম্বর তার দশম শাহাদতবার্ষিকী। ২০১৫ সালের আজকের এই দিনে তিনি শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে বিচারিক হত্যার শিকার হন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে। তার বাবাও শেখ মুজিবের শাসনামলে কারাগারে মারা যান। অভিযোগ রয়েছে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
বাবার মৃত্যুর পর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনীতিতে পথচলা শুরু। দেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ফটিকছড়ি, রাউজান এবং রাঙ্গুনিয়া- এই তিনটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের জাঁদরেল প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া- এ দুই আসনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে মাত্র ২৯ বছর বয়সে এমপি নির্বাচিত হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।
শুধু তাই নয়, ১৯৭৯ সালের বাজেট অধিবেশনে তিনি যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন, তাতে তার প্রজ্ঞা, মেধা ও দূরদৃষ্টির স্ফুরণ এবং সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি এবং সংবিধান সম্পর্কে জ্ঞানের গভীরতার যে প্রকাশ ঘটেছিল; তা সারা দেশে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। তখন থেকে তিনি একজন বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে সবার মনযোগ কেড়েছিলেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ইংরেজি ও বাংলায় সহজ করে কম কথায় কিভাবে সুন্দর বক্তব্য উপস্থাপন করতে হয় তা আয়ত্ত করেছিলেন। সংসদে পূর্বনির্ধারিত কোনো বক্তৃতা থাকলে কয়েক দিন আগে থেকে বক্তৃতার বিষয়ে এবং সমর্থনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও দলিল সংগ্রহে তৎপর থাকতেন তিনি। সঠিক তথ্যের আলোকে সংসদে ভাষণ দিতেন; যা দেশব্যাপী সমাদৃত হতো।
নিজ মেধায় ও যোগ্যতায় অল্প দিনের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশে যে কয়জন প্রথিতযশা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও পার্লামেন্টারিয়ান আছেন, তাদের সারিতে জায়গা করে নিয়েছিলেন। একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার বাংলাদেশ পার্লামেন্ট লাইব্রেরির তিনি একজন নিয়মিত পাঠক ছিলেন। তার ধানমন্ডির বাসায় রয়েছে অনেক দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহে সমৃদ্ধ এক বিরাট ব্যক্তিগত লাইব্রেরি।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতার আসার পর মাগুরা উপনির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ওই আন্দোলনের জন্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিরোধীদলীয় মোর্চার মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সেই দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন।
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্যেও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এবং ২০০২ সালে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) মহাসচিব নির্বাচনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালে অজ্ঞাত কারণে উভয়ের সম্পর্ক শীতল পর্যায়ে পৌঁছে যায়। শেখ হাসিনা ও তার দল দেশে এবং বিদেশে ওআইসি নির্বাচনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ভোট না দিতে প্রচারণা চালান। তখন থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ, প্রতিহিংসা ও ঈর্ষা পোষণ করতেন শেখ হাসিনা।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজের অর্জিত অর্থে রাজনীতি করতেন। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী উপজেলায় নিজের অর্থে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ সমাজকল্যাণধর্মী বহু প্রতিষ্ঠান।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টাসহ ছয়বার সংসদ সদস্য ছিলেন। এত সব পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময় বা এর পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অসাধুতার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তার দুর্নীতির খবর বের করতে কিছু সংবাদমাধ্যম এবং বিভিন্ন সরকারি তদন্ত সংস্থা সবসময় সক্রিয় ছিল। তাতে তারা ব্যর্থ হয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সম্পর্কে কিছু সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, যাতে থাকত ব্যক্তিগত আক্রমণ, আক্রোশ আর বিদ্বেষ। তার মৃত্যু পর্যন্ত কিছু সংবাদমাধ্যমের এ অনৈতিক অপকর্ম অব্যাহত ছিল।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন সৎ, দক্ষ প্রশাসক, বড় হৃদয়ের অধিকারী, নির্লোভ জনবান্ধব নেতা। তার মতো সৎ এবং জনকল্যাণকামী নেতা বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। তার প্রবল ব্যক্তিত্ব, সততা, সত্য কথনে নির্ভীকতা তাকে পতিত আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চক্ষুশূল, ঈর্ষা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছিল।
তাইতো তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ‘বিচারের’ নামে নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তবে ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দিয়ে বিচারিক হত্যা করলেও আজ শেখ হাসিনা তার নিজের সৃষ্ট আদালতে জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার এখন আশ্রয় হয়েছে তার প্রভুদেশ ভারতে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা জীবন বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
লেখক : সমাজকর্মী



