একাত্তরে ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাট

ঢাকা সেনানিবাসে মেজর জলিলের কোর্ট মার্শাল হয়েছিল এবং ওই কোর্ট মার্শালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন লে. কর্নেল আবু তাহের (যিনি পরে জাসদের সামরিক শাখা গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন)। কোর্ট মার্শালে মেজর জলিল বেকসুর খালাস পান।

১৯৭১ সালে যুদ্ধবিজয়ী ভারতীয় সৈন্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনানিবাস এবং শিল্পাঞ্চলের কল-কারখানায় ব্যাপক লুটপাট চালায় বলে অভিযোগ আছে। ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ অবশ্য সেসব অভিযোগ সত্য নয় বলে মনে করে।

ঢাকার রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান তত্ত¡াবধানকারী ভারতীয় ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তার Surrender at Dhaka : Birth of a Nation বইয়ে ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাট সম্পর্কে লিখেছেন, আমি তাকে বললাম যে, আমাদের সৈন্যরা যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করে, ততই মঙ্গল। কারণ এর মধ্যেই তাদের কার্যকলাপ নিয়ে অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। এর কয়েক দিন পরে জেনারেল মানেকশ’ টেলিফোনে আমাকে বলেন যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রসদ লুট হওয়ার গুজব শুনতে পেয়েছেন। আমি জবাব দিলাম, এটা গুজবই, আর কিছু নয়। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কী শুনেছি। আমি বললাম, আমি গুজব ছড়াই না। এর পরে তিনি অরোরার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন।

পরদিন জেনারেল মানেকশ’ লুটতরাজের গুজব সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য আমাকে ঢাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেদিনই আমি ঢাকায় গিয়ে কমান্ডার ও স্টাফের সদস্যদের সাথে কলকাতা ও দিল্লিতে লুটতরাজের যেসব গুজব পৌঁছাচ্ছে, সে সম্পর্কে কথা বলি। এসব অভিযোগ তারা অস্বীকার করেন। ফিরে এসে মানেকশ’কে আমি এসব গুজবের অসারতার ব্যাপারে আমাকে প্রদত্ত নিশ্চয়তার কথা বলি। কিন্তু অবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে আমার সুপারিশ অব্যাহত রাখি। বাংলাদেশে যত বেশি দিন আমরা থাকব, জনপ্রিয়তা হারানোর আশঙ্কা আমাদের তত বাড়বে। (পৃষ্ঠা ১২৮)

অন্য দিকে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার Witness to Surrender বইয়ে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের কথা উল্লেখ করেছেন। তার ভাষ্য মতে, ভারতীয় বাহিনী ওই জয়লব্ধ মালামাল ভারতে নিয়ে যেতে ব্যস্ত ছিল। ট্রেন ও ট্রাকের বহরে করে সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যদ্রব্য শিল্পকারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন সামগ্রী এবং টেলিভিশন, ফ্রিজ ও কার্পেটসহ বাসগৃহে ব্যবহৃত বিভিন্ন মালামালও ভারতে নিয়ে যায়। (পৃ.২১২) উল্লেখ্য, সিদ্দিক সালিক ওই সময় ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধবন্দী অবস্থায় ছিলেন। তাই সেনানিবাসে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের ব্যাপারটি তিনি দেখে থাকতে পারেন।

জেনারেল জ্যাকব লুটপাটের বিষয়টি অস্বীকার করলেও বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী জে এন দীক্ষিত তার Liberation and beyond : India-Bangladesh Relations বইয়ে তা স্বীকার করে লিখেছেন, বাংলাদেশ থেকে ফেরত আসার পর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে লুটপাটের অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। সামরিক সরঞ্জাম ভারতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ভারত সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা এ কাজটি করেন। দখলকৃত সামরিক সরঞ্জাম বাংলাদেশকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুপারিশ করলেও তা ফেরত দেয়া হয়নি।

এবার দেখা যাক বাংলাদেশী লেখক এই বিষয়ে কী লিখেছেন। বাংলাদেশের সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এ কাইউম খান তার Bittersweet Victory : A Freedom Fighters Tale বইয়ে লিখেছেন ওইসময় ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্পিত অস্ত্রশস্ত্র ভারতে নিয়ে যাচ্ছিল। উপরন্তু তাদের কিছু সদস্য লুটপাটেও জড়িয়ে পড়েছিল। বিষয়টি মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ওই ব্যাপারে কী করা উচিত সে বিষয়ে ওসমানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা কোনো নির্দেশনা পাননি। নবম সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল সামরিক সরঞ্জাম ও খুলনার বিভিন্ন জুটমিল থেকে খুলে নেয়া যন্ত্রপাতি ভারতে নিয়ে যেতে ভারতীয় বাহিনীকে বাধা দিলে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঠাণ্ডা মাথায় ওই পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার মেজর জলিলকে আটক করে। তাকে প্রকাশ্যে অপদস্ত করা হয়। মেজর জলিল নিজের জন্য কোনো সম্পদ জমা করেননি এবং তার ক্ষমতার অপব্যবহারও করেননি। ভারতীয় বাহিনী সমর্পিত সামরিক সরঞ্জাম এবং বেসামরিক সম্পদ ভারতে নিয়ে যেতে পারে কি না সে ব্যাপারে তিনি একটি নীতিগত অবস্থান নিয়েছিলেন। (পৃ. ১৯৭-১৯৮)

মুজিবনগর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মঈদুল হাসান তার ‘মূলধারা ৭১’ বইয়ে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাট প্রসঙ্গে লিখেছেন, (ওই সময়) ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও গুরুতর শৃঙ্খলা ভঙ্গের সূত্রপাত হয় যখন দৃশ্যত কিছু শিখ অফিসার ও তাদের অধীনস্থ সেনা যশোর, ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মূলত ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এবং খুলনার ক্যান্টনমেন্ট ও শিল্প এলাকায় লুটপাট শুরু করে; কিন্তু তা ব্যাপক আকার ধারণ করার আগেই তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃঢ় হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে যায়। (পৃ. ১৯৯)

ভারত ও শেখ হাসিনা সরকারের অত্যন্ত প্রিয়জন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও তার ‘আমার একাত্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন, এ দিকে যশোর মুক্ত হওয়ার পর থেকে সীমান্তের দুই দিকে লোক চলাচল শুরু হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পর তা বাড়তে থাকে। খুলনা থেকে আসা পরিচিতজন কেউ কেউ অভিযোগ করল ভারতীয় সৈন্যরা কলকারখানার যন্ত্রপাতি কিংবা শীততাপ-নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী খুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ইচ্ছে, আমি বিষয়টা যেন আমাদের সরকারের গোচরে আনি। প্রধানমন্ত্রীকে বললাম সে কথা। তিনি বলেন, এ রকম অভিযোগ পেলে আমি যেন বিস্তৃত বর্ণনাসমেত বাংলাদেশ সরকারকে লেখা একটি চিঠি নিয়ে রাখি। পরে আমার কাছে যারা অভিযোগ করেছিল তাদের বলেছিলাম, লিখিত অভিযোগ পেশ করতে। তারা আমার পরামর্শ নেয়নি। (পৃ- ১৮৩)

এরপর তিনি আরো লেখেন, খুলনায় নতুন জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন কামাল সিদ্দিকী। এক ফাঁকে তার সাথেও দেখা করে এলাম। তার মুখে শুনলাম দু’টি অভিযোগ। একটি ভারতীয় সেনাদের সম্পদ-অপহরণের, অন্যটি মেজর জলিল ও তার মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে অবাঙালিদের সম্পত্তি লুটপাট ও অবাঙালি মেয়েদের প্রতি অত্যাচারের। (পৃ. ১৮৪)

ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের ব্যাপারে মেজর জলিল তার ‘সীমাহীন সমর’ বইয়ে লেখেন ‘দেশ মুক্ত হওয়ার পর, ১৯৭১ সালের ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় সৈন্যরা এই সব কুকর্মে লিপ্ত হয়েছিল। মিত্রবাহিনী রাতে কারফিউ দিয়ে এরই ছত্রছায়ায় পরিকল্পিত উপায়ে দোকানপাট, ফ্যাক্টরি, পোর্ট, রেডিও স্টেশন ও নিউজপ্রিন্ট মিলে লুট করেছে।’

‘আমার মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর এই দুর্ব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতার বিবরণ লিখে ওদের অধিনায়কের কাছে পাঠিয়েছিলাম। মি. তাজউদ্দীনের কাছেও এক কপি দিয়েছিলাম। বাধা দিয়েছিলাম, প্রতিবাদ করেছিলাম। অ্যালাইড কমান্ডার মেজর জেনারেল দালবীর সিংহকে বলেছিলাম, ‘লুটপাট বন্ধ করো, তা না হলে বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরবে এবং ১৭-১৮ ডিসেম্বর রাতে সহ্য করতে না পেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে গোলাগুলি হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে।’

‘১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর যশোরের কাছাকাছি ওৎ পেতে আমাকে বিনা কারণে বন্দী করা হয়েছিল। তারা আমাকে মেরে ফেলত যদি আমার সাথে অন্য ১৫ জন সাথী না থাকত। অন্য সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে যশোর ক্যান্টনমেন্টের একটি নির্জন কক্ষে আমাকে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?’ তিনি উত্তর দিলেন : ‘তুমি বিদ্রোহী।’ আমি উত্তর দিলাম : ‘কী করে এমন মন্তব্য করতে পারেন? শুধু আপনাদের লুট করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছি বলে?’ আমার কথা শুনে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। (পৃষ্ঠা: ২১৩-২১৪)

মেজর জলিলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় পরে তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের লেখা ‘সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর’ বই থেকে জানা যায়, ঢাকা সেনানিবাসে মেজর জলিলের কোর্ট মার্শাল হয়েছিল এবং ওই কোর্ট মার্শালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন লে. কর্নেল আবু তাহের (যিনি পরে জাসদের সামরিক শাখা গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন)। কোর্ট মার্শালে মেজর জলিল বেকসুর খালাস পান।

সিনিয়র সাংবাদিক