ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো- সবাই নিজস্ব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এরপরও জনমনে প্রশ্ন, নির্বাচন কী সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে? অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে না হওয়ার কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। আমরা তার সাথে একমত। সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে বারবার তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছেন। ইসি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথরেখা তৈরি করে পূর্ণোদ্যমে কাজ করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুতরাং আশা করা যায়, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে।
সাংবিধানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিগত কয়েক দশকে দু’টি রাজনৈতিক দল- বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল। তৃতীয় শক্তি হিসেবে ছিল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৯১ সালে দলটির সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াত চারদলীয় জোট গঠন করে নিরঙ্কুশ বিজয় পায়। আবার ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে বিএনপিকে বাধ্য করেছিল ওই দাবি মেনে নিতে।
২০০৯ থেকে চব্বিশের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করেছিল। শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াতকে নির্মূল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। এমনকি তাদের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল কিলিং, মামলা-হামলা, গুম, হত্যার মতো অপরাধের আশ্রয় নেয়।
চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর রাজনৈতিক রসায়নের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও জাতীয় সংসদের প্রায় সব সদস্য পালিয়ে গেছেন বা গ্রেফতার হয়ে এখন বিচারের সম্মুখীন। ১৭ অক্টোবর (২০২৫) আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকালে গণহত্যার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হওয়ায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গভীর অনিশ্চয়তায় পতিত হয়েছে। দলটির কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ রয়েছে, ফলে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। স্বাভাবিকভাবে বিএনপি পরবর্তী সরকার গঠনের প্রতিযোগিতায় সামনের সারিতে চলে এসেছে।
১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমানের উত্থান এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ইসলামী মূল্যবোধ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে বিএনপি গঠিত হলে বিপুল সাড়া পড়ে। জিয়ার সততা ও দক্ষতা তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। ঘাতকের হাতে শহীদ হওয়ার পর তার ইমেজ আরো বৃদ্ধি পায়। জিয়ার অনুপস্থিতিতে তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আপসহীন নেত্রী হিসেবে ভাবমর্যাদা গড়ে তোলেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। বেগম জিয়াও তার স্বামীর মতো সততার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। অবশ্য তার সরকারের সবাইকে তিনি দুর্নীতি থেকে বিরত রাখতে পারেননি, যেটি জিয়াউর রহমান পেরেছিলেন। তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় জেল-জুলুম ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। অসুস্থতার কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন। তিনি তার পুত্র তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনিও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার পর প্রবাসে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধেও বহু মিথ্যা মামলা দিয়ে শেখ হাসিনা তাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে চেয়েছেন।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি পরবর্তী সরকার গঠন করবে এবং তারেক রহমানই সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী- এরূপ একটি ধারণা জনমনে রয়েছে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন গিয়ে তারেক রহমানের সাথে একান্ত বৈঠক করার পর ধারণাটি আরো জোরদার হয়। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খুনাখুনির অভিযোগ ব্যাপকভাবে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে দলটির দলীয় ইমেজ ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কৌশলী ভূমিকা পালন করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এমনিতে শেখ হাসিনার দ্বারা দলটি ভয়াবহ জুলুমের শিকার হওয়ায় তাদের প্রতি জনগণের একটি সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছে, তদুপরি দলটিকে শেষ মুহূর্তে নিষিদ্ধ করায় তাদের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। অন্যদিকে, তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা দুর্নীতির অভিয়োগ ওঠেনি। তাদের সংগঠিত জনশক্তি জনগণের দুয়ারে দ্রুত পৌঁছে গেছে। অধিকন্তু, ডা: শফিকুর রহমান তার সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতা ও বক্তব্যের মাধ্যমে একটি ক্লিন ও ক্যারিশমেটিক ইমেজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
দৃশ্যত যে জামায়াত একসময় বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, সেই দলটি এখন ভোটের মাঠে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জামায়াতকে মোকাবেলার জন্য বিএনপি কৌশল প্রণয়নে হিমশিম খাচ্ছে। আওয়ামী লীগ যে কৌশলে জামায়াতকে ঘায়েলের চেষ্টা করত, বিএনপি সেই একই কৌশল অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। সেটি- জামায়াতের ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই কৌশল নিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে হত্যা করে ভেবেছিল, দলটিকে ধ্বংস করা গেছে। কিন্তু ফিনিক্স পাখির মতো তারা আবার উত্থিত হয়েছে। হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তার মানে- মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিরোধিতার অপবাদ দেয়ার কৌশলটি ভালোভাবে কাজ করেনি; বরং হাসিনাকে বিদায় নিতে হয়েছে। এখন সেই পুরনো বুলি বিএনপি কাজে লাগাতে পারবে কি? বিএনপির বিভিন্ন কঠোর মন্তব্য সত্তে¡¡ও জামায়াতের জনপ্রিয়তা বেশ বেড়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে বেরিয়ে আসছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমরা বিএনপির শক্তি, দুর্বলতা, সম্ভাবনা ও ঝুঁকির দিকগুলো পর্যালোচনা করার প্রয়াস চালাবো।
প্রথমত, বিএনপি গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের একদলীয় বাকশালী নীতির বিপরীতে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিপরীতে ইসলামী মূল্যবোধ- এই তিন আদর্শ সামনে রেখে। জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্য ও সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করার দৃষ্টিভঙ্গি নেয়ায় ইসলামপন্থী, উদার গণতন্ত্রী ও চীন ঘরানার বামপন্থীরা সহজে জিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হন। জিয়ার সততা ও দক্ষতায় নতুন দলটি দ্রুত জনগণের বিরাট অংশের হৃদয় জয় করে। আওয়ামীবিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিএনপি একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলে। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক দলটিকে একটি ‘রাজনৈতিক ছাতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন যেখানে বহু মত ও পথের লোক শামিল হয়েছেন। বিভিন্ন নির্বাচনে দলটি আওয়ামী লীগের বিপরীতে নেগেটিভ ভোটে বিজয়ী হয়েছে বলে মনে করা হতো। ২০২৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেই; সুতরাং এবার নেগেটিভ ভোট নয়, পজিটিভ ভোট পেতে হবে বিএনপিকে। দলটি যেখানে সর্বদা আওয়ামীবিরোধী ভোট পেত, এখন সেখানে আওয়ামী ভোট পেতে কৌশল নিয়েছে। এটি কৌতূহল-উদ্দীপক একটি বিষয়। তবে এটি অস্বীকারের উপায় নেই, জিয়ার নীতি ও বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন চরিত্রের প্রতি অনুরাগী ভোটার সংখ্যা এখনো প্রচুর রয়েছেন, যারা আগামী নির্বাচনেও বিএনপিকে ভোট দেবেন বলে আশা করা যায়।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি বারবার নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে দেশ শাসন করেছে। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি নেই। রাজনীতির জটিল সমীকরণ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। আবার দলটির উদার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাঠামো থাকায় যেকোনো যোগ্য ব্যক্তিকে দলে বা সরকারে নিয়ে নিতে পারে। ফলে সরকার পরিচালনার যোগ্য লোক পাওয়া দলটির জন্য কঠিন হবে না।
তৃতীয়ত, বিএনপি কয়েকবার ক্ষমতায় থাকায় দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দলটির শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। প্রতিটি গ্রামে বা ওয়ার্ডে সংগঠন রয়েছে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। অবশ্য এ শ্রেণীর দলীয় জনশক্তি প্রবীণ হয়ে গেছেন।
চতুর্থত, বাংলাদেশ মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও ইসলামী অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করা লোকের সংখ্যা ব্যাপক নয়; বরং বিরাট একটি জনগোষ্ঠী উদার ধর্মনিরপেক্ষ আচরণে বেশি অভ্যস্ত। তারা আবার মুসলিম সেন্টিমেন্ট বা চেতনাও ধারণ করেন। বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল এরূপ বিরাট জনগোষ্ঠী রয়েছে।
পঞ্চমত, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রে বিএনপি সমর্থক অনেকে রয়েছে যারা নীতি-নির্ধারণে প্রভাব খাটিয়ে থাকেন বলে একটি প্রচারণা রয়েছে। অনেকে ধারণা করেন, বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলেও রাষ্ট্রে ও ক্ষমতা কাঠামো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ষষ্ঠত, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বৃহত্তম দল হিসেবে বিএনপি দক্ষতা ও কৌশল খাটিয়ে ভোটারদের কাছে টানতে পারে। তবে তা দলটির কর্মদক্ষতার উপর নির্ভর করবে।
সপ্তমত, খালেদা জিয়ার প্রতি দেশের মানুষের দারুণ ভালোবাসা ও আকর্ষণ রয়েছে। তিনি ভোটারদের কাছে যেতে পারলে মাঠের অবস্থা পরিবর্তন হতে সময় লাগবে না। কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতা ও রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকায় বিএনপি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এখনই বলা মুশকিল।
এতসব ইতিবাচক দিক থাকা সত্তে¡ও বিএনপি বর্তমানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। সেগুলো হচ্ছে- প্রথমত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিএনপি নেতাকর্মীদের কার্যকলাপ দলটির ভাবমর্যাদা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, নিজেদের মধ্যে কোন্দল ও সংঘর্ষ এবং এর ফলে শতাধিক দলীয় কর্মীর মৃত্যু জনমনে বীতশ্রদ্ধার সৃষ্টি করেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, দলটির সব পর্যায়ের উপর নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ নেই। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলটি ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না এবং ভোটের রাজনীতিতে এর কতটুকু প্রভাব পড়বে তা ভাবনার বিষয়।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া যদিও তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানানো হয়েছে; কিন্তু অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকায় তিনি মাঠপর্যায়ে যেতে পারবেন কি না সন্দেহ রয়েছে। ফলে বেগম জিয়ার ইমেজকে দলটি এবারের নির্বাচনে কাজে লাগাতে পারবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে ফিরে আসতে কেন এত দেরি করছেন, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে দু-একবার শিগগির আসার কথা বলা হলেও নির্দিষ্ট কোনো তারিখ জানানো হচ্ছে না। প্রথমে তার মামলার কথা বলা হলেও তা তো আর নেই। সুতরাং তার দেশে আসতে বিলম্বের জন্য দলের ক্ষতি বৈ উপকার হচ্ছে না। নির্বাচনের স্বল্প আগে এসে ভোটারদের কতটা আকৃষ্ট করতে পারবেন তিনি?
তৃতীয়ত, ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য মনে করেন, বিএনপি বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভোটারদের মন জয় করতে আকর্ষণীয় বয়ান (ন্যারেটিভ) তৈরি করতে পারেনি। অতীতে সবসময় তারা প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ বা জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সহজে বয়ান তৈরি করতে পারত। এখন আওয়ামী লীগ বা এরশাদের অনুপস্থিতিতে বিএনপি ভোটারদের প্রতি কোন বিষয়ে আহ্বান জানাবে সে কৌশল তারা দাঁড় করাতে পারেনি। এক্ষেত্রে তারা বর্তমানে দুটো কথা বলছে- দলীয় ৩১ দফা ও জামায়াতে ইসলামীর ১৯৭১ সালের ভূমিকা। বলাই বাহুল্য, দলটি তার ৩১ দফা জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি, এমনকি দলের নেতাকর্মীরাও তা ভালোভাবে জানে বলে মনে হয় না। বাস্তবে ৩১টি দফা অনেক লম্বা যা ক্যাম্পেইনের জন্য কৌশলগতভাবে সঠিক নয়।
চতুর্থত, দলটিতে অন্তঃকোন্দল রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য ২৩৭ প্রার্থীর প্রাথমিক নাম ঘোষণার পর বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়া যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা কোনোভাবে জনমনে ভালো বার্তা দেয়নি। অবশিষ্ট আসনগুলোতে যদি মিত্রদের জন্য আসন ছেড়ে দেয়া হয়; তখন প্রতিক্রিয়া ও কোন্দল আরো বেশি হবে বলে ধারণা করা যায়। দলটি কীভাবে এসব সামাল দেবে, তা দেখার বিষয়।
পঞ্চমত, বিএনপি নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদলের দুর্বল অবস্থা দেখে এটি আঁচ করা যায়।
ষষ্ঠত, অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তাতে নানা সময়ে বিএনপির বিভিন্ন নেতা সংস্কার ও গণভোট নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করায় এবং জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট দেয়ায় এরূপ একটি ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, দলটি সংস্কার চায় না। এতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, জনগণ ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন-পরবর্তী রাষ্ট্র ও শাসন কাঠামোতে বিরাট সংস্কার চান। এ জন্য বর্তমান সরকারকে সমর্থনও করেন। সেখানে বিএনপি জনগণকে কী বলে আকৃষ্ট করবে, তা দেখার বিষয়।
সপ্তমত, লক্ষ্যণীয় যে, বিএনপি প্রতিবেশী ভারত ও আওয়ামী লীগের সাথে একটি সমঝোতা করেছে বা করতে চাচ্ছে- এরূপ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়েছে। দলটি এই অপবাদ কীভাবে কাটিয়ে উঠবে, তা দেখার বিষয়।
অষ্টমত, বিএনপিকে প্রচুর ধর্মপ্রাণ মানুষ ভোট দেন। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বিএনপি নেতারা ইসলামী মূল্যবোধের কথা তেমন একটা বলেন না। জুলাই বিপ্লবের পর দলটির কিছু নেতার বিভিন্ন বক্তব্য ইসলামী মনোভাবাপন্ন ভোটারদের মনে আঘাত দিয়েছে। ফলে ধর্মপ্রাণ ভোটারদের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তা দলটি কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে, তা দেখার বিষয়।
নবমত, বিএনপি কিছু ছোট দলের সাথে নির্বাচনী সমঝোতা করতে যাচ্ছে। তাই এখনো ৬৩টি আসনে মনোনয়ন দেয়নি। এতে দলটি নির্বাচনে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা পাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। কারণ, ওই সব দলের নিজস্ব ভোটব্যাংক উল্লেখযোগ্য নয়। আরপিও সংশোধনের ফলে ওই সব ছোট দলকে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। পাশাপাশি বিএনপি থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যাবে যা মোকাবেলা করার ক্ষমতা ছোট দলগুলোর নেই।
যাই হোক, ইনোভেশন নামক একটি সংস্থার দুটো জরিপে বিএনপি ভোটের শতকরা হারে এগিয়ে রয়েছে। সুতরাং বিএনপি যদি তার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক কৌশল ও প্রজ্ঞা খাটিয়ে ভোটারদের মন জয় করতে পারে, তাহলে আবারো হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পেতে পারে।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব



