বৈতরণী শব্দটি দুটো অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রথমত, উপায়-উপকরণ, রীতিনীতি ও বিধিব্যবস্থা। নির্বাচনক্ষেত্রে এর প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে, নির্বাচনী গন্তব্যে পৌঁছার জন্য যে নিয়ম-কানুন ও বিধিব্যবস্থা অতিক্রম করতে হয় তার একটি ইতিবাচক ব্যবস্থা। অপর দিকে বৈতরণী শব্দটিকে অনেকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেন। তার মানে হচ্ছে, নির্বাচন নামক নৌকা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছার কলাকৌশল। নেতিবাচক অর্থে নির্বাচন জয়ের জন্য সত্য-মিথ্যা, প্রতারণা-প্রচারণা এবং মিথ্যা প্রতিশ্রুতি সবই জায়েজ। বাংলাদেশের নির্বাচনী কালচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে বৈতরণী পার হওয়ার জন্য তিনটি এম গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে ‘সড়হবু সঁংপষব ্ সবফরধ’। বিগত নির্বাচনগুলোতে মাস্তানি তথা সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে নির্বাচন জয়ের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নির্বাচনী আচরণবিধির কেউ তোয়াক্কা করে না। ফলে সত্যিকার অর্থে জনগণের মনোভাব প্রতিফলিত হয় না। সমাজের অপরাধী অংশ জিতে যায়। ভালো মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
নাগরিক সাধারণ ও সিভিল সোসাইটির তরফ থেকে বাদ-প্রতিবাদ হয় বটে, তবে তা ধোপে টেকে না। নির্বাচনী জালিয়াতি যেন বাংলাদেশের নির্বাচনী কালচার তথা ভোটাচারে পরিণত হয়েছে। আমাদের মতো দেশে রাজনীতি তথা নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার অভাব রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত শিক্ষক শামসুল হুদা হারুন ১৯৭৯ সালের নির্বাচন সম্পর্কে একটি তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটির নাম ইধহমষধফবংয চংবঢ়যড়ষড়মরপধষ ংঃঁফরবং-১৯৭৯। নির্বাচন নিয়ে গবেষণা এক কথা। আর নির্বাচনে প্রার্থীর ছলা-কলা-বল-কৌশল আরেক কথা। প্রার্থী কিভাবে কথা বলেন, কিভাবে আলিঙ্গন করেন এবং কিভাবে কথার ফুলঝুরি ছড়ান! সেটিই নির্বাচনী সংস্কৃতির বিষয়বস্তু। অনেকে আবার নির্বাচন বৈতরণীকে বষবপঃরড়হ বহমরহববৎরহম অথবা নির্বাচনী প্রকৌশল বলে অভিহিত করেন। এই নামেই একটি গ্রন্থ রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে কারসাজির অন্ত নেই। বাংলাদেশের নির্বাচনী কারচুপি লক্ষ করলে বিগত অর্ধশতাব্দীর তিক্ত অভিজ্ঞতা স্পষ্ট হবে।
আগামী নির্বাচনের ঘোষণা হয়েছে মাত্র। একটি নিশ্চিত নির্বাচন অনিশ্চিত করার যে প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে, তা সত্যিকার অর্থে নির্বাচন বানচাল কিংবা তারিখ পেছানোর ষড়যন্ত্র কিংবা আন্দোলন বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে হয়, এটি একটি নির্বাচনী বৈতরণী। নির্বাচন শুরুর আগেই সমীকরণ, চাপ প্রয়োগ ও জোট গঠনের কৌশল কি না, ভেবে দেখা যেতে পারে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে অনেকেই বলাবলি করছিলেন যে, বিএনপিবিরোধী সব রাজনৈতিক দল হয়তো বা সরাসরি নির্বাচনবিরোধী আন্দোলন শুরু করবে। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম, জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের মতবিরোধ থাকলেও সবাই নির্বাচনকে স্বাগত জানালেন। এখন কোনো কোনো দল নির্বাচন সম্পর্কে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত তারিখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দেয়া হয়েছে। দু’দিন আগে মালয়েশিয়াতেও তিনি তার প্রতিজ্ঞা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ দিকে ডিসেম্বরে তফশিল ঘোষণার কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার। এর পরও নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সদিচ্ছা সম্পর্কে সন্দেহ ও শঙ্কার কারণ নেই। তাহলে তার আশীর্বাদপুষ্ট বলে কথিত ছাত্র নেতৃত্ব কি বিপরীত আচরণ করতে পারে? প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন যে, এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। হতে পারে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে সুবিধা নেয়া এই রণকৌশলের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ তো গুজবের দেশ। ইতোমধ্যে গুজব রটেছে যে, দরকষাকষি চলছে। আবার এটি যদি স্রেফ আন্দোলন হয়ে থাকে তাহলে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিব্রত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অবশেষে তারা এই পিতৃপ্রতিমের ধমক খায় কি না তা দেখার জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। একটি লেজেগোবরে অবস্থা দেখে প্রফেসর ইউনূস পলায়ন করবেন, এরকম মানুষ তিনি নন। এটা সত্যি কথা যে, প্রফেসর ইউনূস দেশকে ভালোবেসে হয়তো দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর যে সংস্কৃতি লক্ষ করেছেন তাতে তার স্বপ্নভঙ্গ হওয়ারই কথা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছেন যে, এই মহৎ মানুষটি ইতোমধ্যে যথেষ্ট ত্যক্তবিরক্ত হয়েছেন। ছেড়ে দিয়ে কেঁদে বাঁচতে চান তিনি। প্রফেসর ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের পর যে নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান গত কয়েক দিন ধরে নির্বাচন নিয়ে সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন। বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেছেন, ইস্যু সৃষ্টি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোস্তফা জামাল হায়দার সন্দেহ করছেন যে, বিভিন্ন অপচেষ্টা চলছে। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনী পরিবেশ, আচরণবিধি ও বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করলেও নির্বাচন বাতিল করার কথা বলেনি। এটি নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ। কিন্তু নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি ঘোষণা দিয়েছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। সব সংস্কার করেই নির্বাচন হতে হবে। এটি একটি নেতিবাচক বক্তব্য। এনসিপির বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সময়ে নরম-গরম কথা বলছেন। তারা সরকারের অংশ নয়। এমনকি তারা এমন বিরোধী দল নয় যে, নির্বাচন বানচাল করতে পারে। অথচ তারা কর্তৃত্বের ভাষায় কথা বলছে, এটি সঙ্গত নয়। শোভন নয়। এ ধরনের কথাবার্তায় তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বিব্রত করছেন।
যে সংস্কারের নামে তারা এত কথা বলছেন, তার প্রথম পর্যায় অতিক্রান্ত হয়েছে। অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। এখন আবার সংস্কার সম্পন্ন করার জন্য সরকার দ্বিতীয়বারের মতো সক্রিয় হয়েছে। অথচ বিভিন্ন জরিপের নামে নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে, প্রকাশিত তথ্য ও জরিপ জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। অবশিষ্ট সংস্কার সম্পন্ন করতে আরো এক মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় রেখে একমত হয়েছে যে, ক্রমান্বয়ে নির্বাচিত সরকার আগামী দু’বছরে নির্দিষ্ট সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে। সবাই জানে এবং বোঝে, সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সুতরাং নতুন দলের নেতাদের উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভিন্ন ধরনের কথা বলতে পারছে।
সারা দেশে নির্বাচনী তৎপরতা চলছে। উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। উত্থিত নেতিবাচক কথাগুলো নির্বাচনী কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করছে। মনস্তাত্তি¡কভাবে জনগণের একটি অংশ প্রশ্ন উত্থাপন করছে, সন্দেহের সৃষ্টি করছে যদিও তা আদৌ উচিত নয়। এ দিকে আরেকটি অংশ দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিপক্ষ ভাবছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়ে গেলে তার প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। এই প্রভাব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সুখকর নাও হতে পারে। তারা সন্দেহ, অবিশ্বাস থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন পেছাতে চায়, যাতে নির্বাচন পরবর্তী প্রভাব কাজে লাগানো যায়।
জাতীয় নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য নেপথ্যে কাজ করছে পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি। ইতোমধ্যে তার আলামতও লক্ষ করা গেছে। তাদের সাথে সক্রিয় রয়েছে প্রতিবেশী শক্তি। তারা দেখাতে চায় যে, দেশের অবস্থা ভালো নয়। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে তারা রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যেসব কটূক্তি ও অপপ্রচার তারা একে-অপরের বিরুদ্ধে করছেন তা প্রকারান্তরে নির্বাচন ঠেকানোর পক্ষে কাজ করছে। ২৪ গণ-অভ্যুত্থানের নেতাদের কেউ কেউ নতুন করে বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা প্রকাশ্যেই বলছেন। এতে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আরেকটি অভিযোগ এই যে, খোদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি অংশ ক্ষমতায় থেকে হালুয়া-রুটি খাওয়ার সময় দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। আর দুটো বিপজ্জনক গুজব হচ্ছে এই যে, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর ২৪ অভ্যুত্থানের নেতাদের নিরাপত্তা শঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। তারা ব্যক্তিগতভাবে হয়রানি, হামলা ও মামলার সম্মুখীন হতে পারেন। এরকম ধারণা থেকে যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সত্যিই প্রশ্নের সম্মুখীন হন, তাহলে অবশ্যই তা বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়। অভ্যুত্থানের নেতারা চিরকাল এই জাতির অহঙ্কার হয়ে থাকবেন। আরেকটি মারাত্মক গুজব হচ্ছে উত্তর বাড়ির উত্থান। গুজব দু’টি অবশ্যই সর্বৈব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বাংলাদেশের সাধারণ জনবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন সব লোক অবশ্যই বলবেন যে, তালগোল পাকানো আমাদের বাংলাদেশ জনগোষ্ঠীর একটি চরিত্র। বিশেষ প্রাণীর মতো তারা পানি খায় তবে সাতঘাট ঘুলিয়ে। তার বিপরীতে আশাবাদী মানুষ আছে যারা বিশ্বাস করতে চায় যে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস এই যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্থিত বুদবুদ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। জাতি অবশ্যই ফেব্রুয়ারিতে একটি নতুন নেতৃত্ব ও একটি নতুন সরকার উপহার পাবে।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়