সম্প্রতি একটি খবর অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বেশ আলোচিত খবরটি দেখে অনেকে ভ্রুকুঁচকেছেন, অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, কেউ বা বিরক্ত হয়েছেন। খবর হলো, প্রাথমিক স্কুলে কয়েক হাজার নৃত্য ও সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। অনেকে বাহবা দিয়েছেন ছোট ছোট শিশুকে সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তোলার এই যুগান্তকারী (!) সিদ্ধান্তের জন্য। বাস্তবে এই নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য কী? যেখানে মর্যাদার দাবিতে, ভালোভাবে বেঁচে থাকার দাবিতে শিক্ষকরা দিনের পর দিন আন্দোলন করছেন, রাজপথে দিন কাটাচ্ছেন, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন চাকরির নিশ্চয়তা ও ন্যূনতম আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, যখন তাদের ১৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধির আর্থিক সংস্থান নেই সরকারের তহবিলে, তখন নাচ-গান শেখার জন্য নতুন করে হাজারো শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাবনা শিক্ষকদের প্রতি নিষ্ঠুর তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য শিক্ষকদের আবারো রাস্তায় নামতে হবে না- এর কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? নৃত্যসঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের কী শেখানো হবে? সঙ্গীত শেখার জন্য প্রচুর সময় এবং নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। এ জন্য সময় ছাড়াও সঙ্গীত শেখার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহের অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ সামলানোর ক্ষমতা সাধারণ অভিভাবকদের আছে কি না তা প্রস্তাবকরা কখনো ভেবেছেন কি? প্রাথমিক স্কুলের ক্ষণিকের শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের পেশাজীবনে সঙ্গীত ও নৃত্যচর্চা কতটুকু সাহায্য করবে তা বিবেচ্য ছিল কি?
শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার পেশামুখী, দেশপ্রেমিক সৎ, আদর্শ নাগরিক তৈরি। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তবতার আলোকে সুনির্দিষ্ট আদর্শনির্ভর শিক্ষানীতি, যা আজও তৈরি হয়নি। পরিণতি ২৬ লক্ষাধিক স্বল্পশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণ ও যুবকের লম্বা মিছিল যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির কপালে কালো তিলক। লক্ষ্যহীন শিক্ষানীতিই এর কারণ। অন্য দিকে এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বাহুল্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
কেউ বলছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে দেবেন, কেউ বলছেন, তারা বৈষয়িক শিক্ষার সাথে সাথে নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেবেন। প্রয়োজনে তারা ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করবেন। সব প্রতিশ্রুতিই অত্যন্ত শ্রুতিমধুর, মনোতুষ্টিযোগ্য। তবে এ ক্ষেত্রে চতুরতা লক্ষণীয়। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এটি সব চেয়ে চমৎকার ব্যবস্থা। প্রথমত, এর মাধ্যমে প্রস্তাবিত হাজারো নৃত্যসঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের কার্যকারণ চতুরতার সাথে সহজেই চাপা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য সৎ, দেশপ্রেমিক, যোগ্য নাগরিক তৈরির ভাবনা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পরিণতি কী হবে তার বাস্তব নমুনা এখনকার বাংলাদেশ। রাস্তার ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে পুলিশ আমলা সরকারি বেসরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ব্যবসায়ী সর্বত্রই দুর্নীতির রাজত্ব। এই দুর্নীতির কল্যাণেই দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়ে কেউ কেউ বেগমপাড়া গড়েন, কেউ বা সেকেন্ড হোমের সন্ধানে ব্যস্ত। দেশের শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য ও অপসংস্কৃতির করাল থাবার প্রভাব থেকে বাঁচাতে নিজের সন্তানদের বিদেশের শান্তির নীড়ে পাঠিয়ে সংশ্লিষ্টরা দেশ সেবার নামে দেশ শোষণের মহাযজ্ঞে ব্যস্ত। দেশে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল অবস্থায় রোগীদের বিদেশে পাড়ি দেয়ার লম্বা লাইন। পক্ষান্তরে যারা দেশের পরিচালক তারা সর্দি হলেই ছুটছেন বিদেশে চিকিৎসার জন্য। কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, অথচ সিন্ডিকেট নামক অধরা (?) কর্তৃপক্ষের সাজশে বিদেশী পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এভাবে সর্বত্রই নৈরাজ্য আর অশান্ত পরিবেশে চলছে এ দেশের জনজীবন। একই চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় শিক্ষাক্ষেত্রেও। বর্তমান সরকার সবকিছুর ব্যাপারে কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা কমিশন কোনো এক অজানা শক্তির প্রভাবে গঠন করা হয়নি। এতে বোঝা যায় শিক্ষার ক্ষেত্রে, জাতির মেরুদণ্ড শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান অভিন্ন। মেধার মূল্যায়নের ক্ষেত্র, দেশের ভবিষ্যৎ যোগ্য নাগরিক গড়ার মৌলিক উপাদান শিক্ষা নিয়ে সবাই রহস্যজনকভাবে নীরব। সরকার ১১টি কমিশন গঠন করলেও মৌলিক সমস্যা যেখানে দেশপ্রেমিক সৎ ও মননশীল নাগরিক তৈরির মূল জায়গা শিক্ষা সংস্কারের ব্যাপারে গুরুত্ব না দেয়ায় চলমান জাতীয় সমস্যাগুলো; বেকার সমস্যা, দুর্নীতি, অর্থপাচার, নাগরিক ও নারী অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্যনিরাপত্তার সমস্যাগুলো বারবার ফিরে আসবে। আইনের অপব্যবহার রাস্তাঘাটের বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করা সম্ভব যেসব মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থার নীতিগত সংস্কার, সে ব্যাপারে সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা নীরব। জাতীয় নেতারা, দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ, প্রগতি ও চেতনার ধারক দাবিদার মিডিয়াগুলো রহস্যজনকভাবে নীরব। সুপরিকল্পিত সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে যেমন দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগ্রত হয় না, তেমনি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠন সম্পূর্ণভাবেই অসম্ভব, এ কথা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকসহ সবাই জানেন এবং বোঝেন। কিন্তু তারপরও শিক্ষা খাতে সংস্কার করতে সবারই অনীহা। কারণ একটাই, জাতির ভিত দুর্বল করে রাখা। যেন পরবর্তী সময়ে এ দেশকে শোষণ করা যায়, শাসন করা যায়, বাগে রাখা যায়।
দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, উৎপাদনশীল জনশক্তি তৈরি করতে হলে, শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বাস্তবধর্মী উদ্যোগের সমন্বয় সাধন করা। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দলীয় কর্মসূচি ও নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে এর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা ও রূপরেখা থাকা দরকার। আমাদের দেশকে গড়তে হবে আমাদেরকেই। বাইরে থেকে এসে কেউ এ দেশ গড়ে দেবে না। শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রেও তাই। ভবিষ্যতে দুর্নীতিমুক্ত আদর্শ সমাজ ও দেশ গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী আদর্শিক সংস্কার ছাড়া গত্যন্তর নেই।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ



