সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পতিত লীগ তাদের বন্ধুদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। অতি সম্প্রতি তার কিছু খণ্ডচিত্র দু’টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। নিশ্চয়ই সে খবর সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। সেই দুই দৈনিকের শীর্ষ প্রতিবেদনগুলোর কেবল শিরোনাম দেখেই পাঠকের চমকিত-স্তম্ভিত হওয়ার কথা। গুটিকতক ব্যক্তি নিজ স্বার্থে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অতি অল্প মূল্যে দেশ বিকিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে না। এরা সবাই কাল কালান্তরে ‘মীর জাফর’ হিসাবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। দিন শেষে রাত পোহালে সব দেনা পাওনা পাই পাই করে চুকিয়ে দিতে হয়। কাল নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক কবিতার কয়টি চরণ স্মরণ রাখলেই যথেষ্ট। ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও/ তারি রথ নিত্যই উধাও/ জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন/ চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন/ ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল।’ এ বাণী তো চিরন্তন। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটেনি, কখনো ঘটবে না। এমনটাই স্রষ্টার স্পষ্ট বিধান। যে নদীর স্রোতে সমুদ্রে মিলায়, সেটা কখনো ভাটি থেকে উজানে ফেরে না।
যেহেতু ধরে নিচ্ছি বহু পাঠক ওই খবরগুলো গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করেছেন। সে কারণে পুরো খবর উদ্ধৃত করার প্রয়োজন মনে করি না। শুধু শিরোনাম তুলে ধরা হচ্ছে। আর বোদ্ধাদের জন্য শিরোনামগুলোই যথেষ্ট। গত ১৫ আগস্ট সহযোগী দৈনিক আমার দেশ-এর শিরোনাম ছিল, ‘পান্নায় ভর করে আওয়ামী লিগের প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা।’ তবে তাকে নিয়ে এগোনোর প্রয়াসের পূর্বাহ্নে হোঁচট খেয়েছে পতিত লীগ। পান্নার একটি ভিডিও ভাইরালের পর তাতে লীগের গুড়েবালি পড়ে। সবাই জানে জনাব পান্না লীগ বলয়ের বয়োবৃদ্ধি আইনের কৌশলী। যাই হোক, লোকসমাজে পান্নাকে নিয়ে এগোনোর সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সেই পরিকল্পনায় ১৫ আগস্টকে ঘিরে লীগের জানবাজ নেতাকর্মী এবং সাংস্কৃতিক চক্রের চিহ্নিত নায়ক-গায়ক, পটুয়া এবং তথাকথিত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজন। যারা দিল্লিতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা মেলে দাঁড়ায়, তাদের এই মুহূর্তের ‘সদিচ্ছা’ বাংলাদেশকে ‘ডিস্ট্যাবিলাইজ’ করা। কিন্তু নিজেরাই ছত্রভঙ্গ হয়ে রণেভঙ্গ দেয়। যাই হোক, হঠাৎ পান্নার ওপর কেন ভর করেছে লীগ ও অন্যরা। কারণ পান্না চেয়েছিল পতিতজনের পক্ষ নিয়ে পাশে থেকে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্য আইন কিন্তু সেটা অনুমোদন করল না। ধানমন্ডির দলের কার্যালয়ে জমায়েত হয়ে, পান্নাকে সামনে রেখে হুজ্জত হাঙ্গামা করা, বিক্ষোভ করা ভাঙচুর করা। এসব কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল পতিত ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার সূচনা করা। সেই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে স্বৈরাচারের পতনের অব্যবহিত পরপরই। সেসব কলা-কৌশল কখনো আলোর মুখ দেখেনি। তার পরও তারা থেমে যায়নি।
নতুন বয়ান ও কর্মসূচি নিয়ে লীগের কর্মীরা এখন আবার তুঙ্গে। ২০ আগস্ট ওই একই সহযোগী পত্রিকায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ খবরের শিরোনাম ছিল, ‘দিল্লিতে শেখ হাসিনার জন্য রাজনৈতিক কার্যালয়।’ এই রিপোর্টের বহুমুখী তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত একটি কথা না বললেই নয়। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিজস্ব বিষয় নিয়ে ভারতের নাক-গলানোর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের নগ্ন ও গর্হিত প্রকাশ। স্বৈরাচারী শাসক বাংলাদেশের কোটি কোটি তরুণ-জনতা, আবালবৃদ্ধবনিতার ধাওয়া খেয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এখন দিল্লির মদদে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে শিবির তৈরি করছে। সেখানে বসে এদেশের প্রতিপক্ষ হয়ে স্নায়ুযুদ্ধ, বন্দুকযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। এমন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবেলায় শুধু রাজনীতি নয় সব বলয়ের সবাইকে অতিসত্বর নিজেদের ঐক্যে গ্রন্থিত হওয়া ভিন্ন আর কোনো পথ খোলা নেই।
গণতন্ত্রে অবশ্যই দ্বিমত থাকবে। তবে কোনোক্রমেই দ্বিচারিতা নয়। দ্বিমত থাকতে পারে এ কারণেই রাষ্ট্র বিনির্মাণে পথনকশা দলভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মানবিক মূল্যবোধের প্রশ্নে এ দেশের কোনো মানুষ তিল পরিমাণ ছাড় দেবে না। রাজনৈতিক দলগুলো এই গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। এদেশের প্রতিটি মানুষ এ ভূখণ্ডের প্রতি ইঞ্চি জমিনের সুরক্ষা দিতে দেহের শেষ রক্তবিন্দু থাকাবস্থায় খামোস হবে না। পতিত লীগ যে কাউকে সাথে নিয়ে এগোলে, এদেশে ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি পা সিসা ঢালা প্রাচীরের মতো দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, ভাটি বাংলার মানুষ হাজার বছর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত ছিল কিন্তু কখনো পরাভব মেনে নেয়নি।
উল্লিখিত পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ‘র’-এর ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশকে পতিত লীগ সরকার ‘র’-এর জন্য অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল। ওই সংস্থায় লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ শত শত অনুগামীকে চাকরি দেয়া হয়েছিল। তাদের সবার নামধাম পরিচয় দৈনিক পত্রিকাটি সবিস্তারে প্রকাশ করেছে। প্রচলিত একটি কথা আছে, সশস্ত্র সেনাবাহিনী কেবল যুদ্ধ বাধলেই যুদ্ধ করে। কিন্তু সব সময় সর্বত্র দেশকে নিরাপদ রাখতে দিবা-নিশি যুদ্ধ করে যায় কেবল গোয়েন্দা বাহিনী।
বিগত দিনে দেশের স্বার্থে কখনোই (এনএসআই) কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখেনি, বরং সংস্থাটি এ দেশের একমাত্র ভারতের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছে। তার সাথে ভূমিকা রেখেছে লীগ সরকারকে সুরক্ষা দিতে। বাংলাদেশ আজীবন যাতে ভারতের তাঁবেদারি করে চলে, সেটা ছিল এবং আছে ‘র’ কর্মসূচির এক নম্বর এজেন্ডা। সরিষায় যদি ‘ভূত’ থাকে তবে সে সরিষা দিয়ে কখনোই ভূত তাড়ানো যায় না। বাংলাদেশের অবস্থা ঠিক তেমনি ছিল।
গোয়েন্দাদের অসতর্কতা তথা ব্যর্থতা, রাষ্ট্র ও জনতার কী অপরিমিত ক্ষতি করতে পারে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার কারণেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অকালে এবং নির্মমভাবে দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করে। সম্প্রতি ইরানে, সে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং সামরিক নেতাদের মুসলিম বিশ্বের প্রধানতম শত্রু ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা হত্যা করেছে। এর পরেও কি বেহুঁশ বাংলাদেশের হুঁশ ফিরবে না!
বাংলাদেশের রাজনীতিকরা এবং সরকারি-বেসরকারি নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রের পরতে পরতে যে আবর্জনা গত ১৬ বছরে জমেছে, তা পরিষ্কার করা নিয়ে কি একমত হতে পেরেছেন। অথচ এমন অব্যবস্থা নিয়ে চলা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অথচ এসব কিছুর সাথে জাতীয় সমৃদ্ধির সম্পৃক্ততা আছে। কেউ কি সেদিকে ফিরে তাকাচ্ছেন! সমস্যাগুলো কি গা-সহা হয়ে উঠেছে। প্রতিকারের কোনো প্রয়োজন কি নেই! দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না বুঝলে কী হয় আমাদের কারোরই অজানা নয়।
দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত একটি শীর্ষ খবরের শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লিগকে ফেরাতে নীলনকশা।’ উক্ত শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় গত ২৭ আগস্ট। সে খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে ফরমায়েশি ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বাজেট তৈরি করা হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে অকার্যকর করার জন্য দেশের এখানে সেখানে যত অনিয়মতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক অপচেষ্টা হচ্ছে তার পিছনে দিল্লিতে বসে থাকা নেত্রী প্রচুর অর্থ ব্যয় করছেন। হারিয়ে যাওয়া তার কর্তৃত্ব পুনরায় মুষ্টিবদ্ধ করতে তিনি বেচইন হয়ে উঠেছেন। তাতে দেশের ও দশের যা কিছুই হোক, কিছু যায় আসে না। তবে তিনি হয়তো ভুলে গেছেন সিকিমের লেন্দুপ দর্জির পরিণতি। লীগ নেতাকর্মীদের বিশে^র সব স্বৈরাচারের পরিণতির ইতিহাস থেকে পাঠ নেয়া দরকার।