বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান : সম্পর্কের নতুন ভাবনা

বাংলাদেশের প্রয়োজন বন্ধু, প্রভু নয়। টিকে থাকার জন্য ও উন্নতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ, বহুমাত্রিক কূটনীতি অপরিহার্য। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের সেতু গড়ে তোলা, ভারতের পুরনো শর্ত ছাড়াই সে যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

১৯৪৭ সালের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের চিরশত্রু। যুদ্ধ, সীমান্তবিরোধ ও অবিশ্বাসে সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মও এই বিরোধের ছায়ায় ঘটেছিল। ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে অনেকেই উপলব্ধি করেছে, ভারত এ যুদ্ধে নিজের কৌশলগত স্বার্থও বাস্তবায়ন করেছে।

আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, যা কাউকে ‘বস’ হিসেবে মানতে প্রস্তুত নয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও ভারত বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে আসছে এবং বিশেষ করে গত ১৬ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনে ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সময় এসেছে পুরনো বয়ান ও শর্তের বাইরে গিয়ে সম্পর্কগুলোকে নতুন করে ভাবার।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ১৯৪৭-৭১

পাকিস্তানের জন্ম হয় দু’টি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অংশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। শুরু থেকেই বৈষম্য ও অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), বাংলা ভাষাকে অস্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালির ক্ষোভ বাড়ে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। অর্থের বেশির ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো। রাজনৈতিক বঞ্চনা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। শরণার্থী সঙ্কট ও সামরিক দমন-পীড়নের সুযোগ নিয়ে ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। ফলে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ, যা বাঙালির গৌরব হলেও ভারতের কৌশলগত জয়ও ছিল।

স্বাধীনতার পর ভারত : মিত্র থেকে প্রভুত্বের চেষ্টায়

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ভারত শুরু থেকেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে। সীমান্তে গুলি, কাঁটাতারের বেড়া তোলা ও জোরপূর্বক প্রভাব বিস্তার। ভারত ট্রানজিট সুবিধা পেলেও পারস্পরিক সুবিধা সীমিত। গত ১৬ বছরে ভারত ঢাকার ওপর সর্বোচ্চ কূটনীতিক প্রভাব বজায় রেখেছে, ফলে স্বাধীন ও বৈচিত্র্যময় পররাষ্ট্রনীতি গড়ে উঠতে পারেনি।

কিন্তু ১৯৭১ সালের চেতনা ছিল আসল সার্বভৌমত্বের লড়াই, যা কোনো শক্তির কাছে নতজানু হওয়ার জন্য নয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের ভুল এবং আবার কাছে আসার সম্ভাবনা

এটি সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে বৈষম্যের শিকার করেছিল, যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তবুও ইতিহাস দেখায়, রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরশত্রুতার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম ভয়াবহ যুদ্ধের পরও এখন সহযোগী। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পরমাণু বোমার ক্ষতের পরও ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারত ও চীন যুদ্ধ ও সীমান্ত সঙ্ঘাতের পরও বাণিজ্য চালাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কেন ১৯৭১-এর দেয়ালে আটকে থাকবে?

ভারতীয় বয়ান ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব

পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অন্যতম বড় অন্তরায় ভারতের দীর্ঘ দিনের প্রচারিত বয়ান : পাকিস্তান একাত্তরের ঘটনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা না চাইলে পুনর্মিলন সম্ভব নয়। কয়েক দশক ধরে নয়াদিল্লি বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের আলোচনাকে এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছে যাতে ঢাকা ইসলামাবাদের কাছ থেকে স্পষ্ট অপরাধ স্বীকার আদায় না করা পর্যন্ত এগোতে না পারে। কিন্তু এই অবস্থান আসলে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ নয়।

এতে কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ও নির্ধারক অধ্যায়। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল, বর্বরতা সংঘটিত হয়েছিল, আর আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম পঁষসরহধঃব করে স্বাধীনতায় পৌঁছায়। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা হয়তো প্রতীকী পুনর্মিলনের একটি ইঙ্গিত হতে পারে; কিন্তু এটিকে যদি আলোচনার একমাত্র পূর্বশর্ত করা হয়, তবে বাংলাদেশ নিজেকে একটি স্থবির ঐতিহাসিক মুহূর্তে আটকে ফেলবে এবং বর্তমান সময়ে বাস্তববাদী কূটনীতি চালানোর পথে বাধা তৈরি হবে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আগের প্রতিদ্ব›দ্বীদের নতুন করে কাছে আসা বা মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সবসময় আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার ওপর নির্ভর করে না।

ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হলো সার্বভৌমত্বের নীতি। বাংলাদেশের কূটনীতি কোনোভাবেই বাইরের শর্তে, তা ভারত হোক বা অন্য কোনো শক্তি, বাধা থাকতে পারে না। ভারত প্রায়ই একাত্তরে তার ভূমিকাকে বাংলাদেশের ‘ঋণ’ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে; কিন্তু এ ধরনের মানসিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলভিত্তিকে ক্ষুণœ করে। ঢাকার পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ, কৌশলগত প্রয়োজন এবং জনগণের আকাক্সক্ষায় পরিচালিত, কোনো প্রতিবেশীর বয়ানে বা শর্তে নয়।

পাকিস্তানের সাথে পুনর্মিলন মানে একাত্তরকে ভুলে যাওয়া নয়; বরং এর মানে হলো অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, তবে তার কাছে জিম্মি হয়ে না থাকা। সমান মর্যাদায় ইসলামাবাদের সাথে যোগাযোগ, বাণিজ্য, সংযোগ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আরো দৃঢ় করবে এবং একই সাথে ভারতের প্রভাবও কমাবে।

সর্বোপরি, ভারতের ক্ষমা প্রার্থনার দাবি আসলে তাদের বয়ান, আমাদের নয়। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের শর্ত নির্ধারণ করার পূর্ণ অধিকার বাংলাদেশেরই আছে, যা হবে বাস্তববাদী, ভারসাম্যপূর্ণ এবং বন্ধু চাই, প্রভু নয় এই নীতিতে প্রতিষ্ঠিত।

কেন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরি

পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে :

কৌশলগত ভারসাম্য : ভারতনির্ভরতা কমবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা : পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতা বাংলাদেশকে সাশ্রয়ী সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, কৌশলগত ভারসাম্য এবং প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতিতে বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা : পাকিস্তান একটি ২৪ কোটি মানুষের বাজার, বাংলাদেশী পণ্যের বড় বাজার হতে পারে।

মুসলিম বিশ্বের সংযোগ : পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশকে ওআইসি ও মুসলিম দুনিয়ায় শক্তিশালী অবস্থান দেবে।

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা : সম্পর্ক পুনর্গঠন দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে।

অগ্রযাত্রার পথ : ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি

বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি স্থানে অবস্থিত। এক দিকে ভারত মহাসাগর, অন্য দিকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো- ভারত, চীন ও পাকিস্তান। এর সাথে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদনির্ভর সম্পর্ক বিদ্যমান। এ কারণে বাংলাদেশের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি কোনো বিলাসিতা নয়; বরং একটি অপরিহার্য কৌশল।

ভারতের সাথে সম্পর্ক, সহযোগিতা; কিন্তু নির্ভরশীলতা নয় : বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে অপরিহার্য করে তোলে। পানিবণ্টন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা- সব ক্ষেত্রেই ভারতের সাথে সমন্বয় প্রয়োজন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশকে ভারতের শর্তাধীন বা প্রভাবাধীন হতে হবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা আমাদের কূটনৈতিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে। তাই ভারতের সাথে সম্পর্ক হবে সম্মানের ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতা, একতরফা প্রভাব মেনে নিয়ে নয়।

পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক : নতুন অধ্যায়ের সূচনা : একাত্তরের ইতিহাস আমাদের জাতীয় চেতনার ভিত্তি হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি স্থায়ী শত্রুতার ফ্রেমে আটকে রাখা সমীচীন নয়। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন মানে অতীত ভোলা নয়; বরং নতুন বাস্তবতায় সহযোগিতার পথ খোঁজা। ভারতীয় শর্ত বা বয়ান মেনে নয়, বাংলাদেশের নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থে পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে, যেখানে বাণিজ্য, কূটনীতি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রধান অগ্রাধিকার পাবে।

চীন, মুসলিম দুনিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক : বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন রফতানি, বিনিয়োগ ও শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীল। চীন আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় অংশীদার, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কোটি শ্রমিক কর্মরত, আর পশ্চিমা দুনিয়া আমাদের সবচেয়ে বড় রফতানিবাজার। তাই কেবল এক দেশের ওপর নির্ভরশীল না থেকে চীন, মুসলিম বিশ্ব ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সাথে বহুমুখী সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারসাম্যপূর্ণ হবে এবং কোনো একটি দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য : সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- পররাষ্ট্রনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ। কোনো প্রতিবেশীর চাপ, কোনো বৈশ্বিক শক্তির কৌশল- এসবের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের দেখতে হবে : আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিভাবে ত্বরান্বিত হবে, আমাদের সার্বভৌমত্ব কিভাবে রক্ষা পাবে এবং আমাদের জনগণের কল্যাণ কিভাবে নিশ্চিত হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ভারত-পাকিস্তান দ্ব›েদ্বর ভেতর দিয়ে; কিন্তু ৫৪ বছরেরও বেশি সময় পর আমাদের উচিত সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা। ইতিহাস বলে, যুদ্ধের পরও দেশগুলো মিত্র হতে পারে, যদি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশের প্রয়োজন বন্ধু, প্রভু নয়। টিকে থাকার জন্য ও উন্নতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ, বহুমাত্রিক কূটনীতি অপরিহার্য। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের সেতু গড়ে তোলা, ভারতের পুরনো শর্ত ছাড়াই সে যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক