দক্ষিণ এশিয়ায় নির্বাচনী কারচুপি, প্রশাসনিক পক্ষপাত আর ভোটার তালিকা নিয়ন্ত্রণ নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে এগুলো পরিচিত এক বাস্তবতা। কিন্তু যে দেশ গণতন্ত্রের ‘মডেল’ দাবি করে; সেই ভারতের বিহার নির্বাচন-২০২৫ এর ফল ঘোষণায় অসঙ্গতি ও রাজনৈতিক নাটক দক্ষিণ এশীয় গণতন্ত্রের গভীর সঙ্কট আবারো প্রকাশ করেছে।
এক্ষেত্রে বিহারের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্যও সতর্কবার্তা। কারণ, দুই দেশের নির্বাচনী দুর্বলতার ধরন একই চরিত্রের : ভোটার তালিকা নিয়ন্ত্রণ, গণনা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাব এবং ফল ঘোষণায় রাজনৈতিক চাপ।
ঘোষিত ফল
ঘোষিত ফল অনুসারে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট-এনডিএ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ২৪৩টি আসনের মধ্যে ২০২টিতে জয় পেয়েছে। রাজ্যে সরকার গঠনে কোনো দল অথবা জোটের প্রয়োজন ১২২টি আসনের।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব ক’টি আসনের ফল ঘোষণার পর পাওয়া চিত্র অনুসারে- ৮৯টি আসনে জয় পেয়ে বিজেপি বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দলটির শরিক মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের নেতৃত্বাধীন জনতা দল ইউনাইটেড ৮৫টি আসনে জিতেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ানের নেতৃত্বাধীন লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস গোষ্ঠী) ১৯টি আসন পেয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জিতেন রাম মাঝির নেতৃত্বাধীন হিন্দুস্তানী আওয়াম মোর্চা (সেকুলার) পাঁচটি আসন পেয়েছে। অন্য দিকে উপেন্দ্র কুশওয়াহার নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চা চারটি আসনে জয়লাভ করেছে। এ দিকে আরজেডি নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিহার বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ৩৫টি আসনে জয়লাভ করেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় জনতা দল আরজেডি পেয়েছে ২৫টি দল ও কংগ্রেস ছয়টি। এ ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া, মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট লিবারেশন দু’টি, সিপিআইএম ও ইন্ডিয়ান ইনক্লুসিভ পার্টি একটি করে আসন জিতেছে। আসাদউদ্দিন ওয়াইসির নেতৃত্বাধীন এআইএমআইএম পাঁচটি ও বহুজন সমাজ পার্টি একটি আসন পেয়েছে।
গণনা ধীর করা, ইভিএম প্রবেশ ও সিসিটিভি অন্ধকার
বিরোধী দল আরজেডি সবচেয়ে বেশি যেটি তুলে ধরেছে, তা হলো- কিছু কেন্দ্রের গণনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধীর করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, প্রাথমিক পর্যায়ে এনডিএকে এগিয়ে রাখার জন্য কয়েকটি সেন্টারে গণনা বিরতি বা অনিয়মিত ধীরগতি তৈরি করা হয়। যদিও নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবে ভোট গণনার মনস্তাত্তি¡ক প্রভাব যে গভীর ছাপ ফেলে তা সবার জানা। গণনার গতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে তা সরাসরি রাজনৈতিক বর্ণনাকে প্রভাবিত করতে পারে।
কয়েকটি কেন্দ্রের সিসিটিভি ফিড হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, অথবা অঘোষিত ইভিএম ট্রাক কেন্দ্রের ভেতরে ঢোকার অভিযোগ- এগুলো এমন বিষয় যা প্রশাসনের এক সুস্পষ্ট দুর্বলতা চিহ্নিত করে : নিরাপত্তা আছে, কিন্তু স্বচ্ছতা নেই। সিসিটিভি বন্ধ হওয়া মানে শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়- মানসিক আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এটি নির্বাচনের ‘কালো সময়’-কে মনে করিয়ে দেয়।
আরজেডি দাবি করেছে, কিছু কাউন্টিং সেন্টারে গণনা ধীর করার পরিকল্পনা করা হয়েছে- বিশেষ করে সেই আসনগুলোতে যেখানে তাদের লিড ছিল বা ভোটের মার্জিন সঙ্কীর্ণ ছিল। কিছু আসনে সিসিটিভি ক্যামেরা অকার্যকর থাকা, কিংবা গণনা-কেন্দ্রে অতিরিক্ত ইভিএম বহনকারী গাড়ি ঢোকার অভিযোগ জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি নির্বাচন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতার ওপর সন্দেহ জাগায়। যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা থাকলেও এই ‘অদৃশ্য মুহূর্তগুলো’ই রাজনৈতিক অসময়ে ষড়যন্ত্র তত্তে¡র জন্ম দেয়।
বাংলাদেশে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ এমনকি স্থানীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও দ্বিধাহীনভাবে প্রমাণ করে যে- স্বচ্ছতার অভাব সবসময় ক্ষমতাসীনদের লাভবান করে।
এসআইআর সংশোধন : গণতন্ত্রের নীরব শুদ্ধি অভিযান?
এ নির্বাচনের সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশ্ন- স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন (এসআইআর) প্রক্রিয়া। অভিযোগ হলো- সংখ্যালঘু, দরিদ্র, অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপক হারে ভোটাধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। চমকপ্রদ তথ্য হলো- কিছু আসনে এনডিএর জয়ের মার্জিন এবং ভোটার অপসারণের সংখ্যা প্রায় সমান। বিশেষভাবে, কংগ্রেসের একটি বিশ্লেষণ বলছে যে, ১২৮টি আসনে এনডিএর জয় এমনভাবে এসেছে; যেখানে ‘ভোটার বাদ দেয়া’ এবং জয়ের মার্জিনের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। তারা এ তথ্যকে ‘স্টেজ-ম্যানেজড নির্বাচন’ বলেছে। এটি ভোটার তালিকা নিয়ন্ত্রণকে সরাসরি রাজনৈতিক হাতিয়ার করে তোলে।
আবার, কিছু ভোটার তালিকা এন্ট্রিতে ‘ডুবিয়াস অ্যাড্রেস’ (যেমন একাধিক ভোটার একই হাউজ নম্বরে নিবন্ধিত) সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছে। হরিয়ানা রাজস্থান থেকে ট্রাক ভর্তি করে এসে বিহারে ভোট দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। যদিও ইসিআই বলছে, সব রাজনৈতিক দলের এজেন্টই তালিকা সংশোধনে যুক্ত ছিলেন, তবু যে অভিযোগ উঠেছে তা ভোটার তালিকার ওপর আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। আর এ আস্থা কমে গেলে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা নিয়ন্ত্রণ, ‘হালনাগাদ’ অভিযানের নামে ভোটার বাদ পড়া- এসব নতুন নয়। বিহার দেখাচ্ছে, প্রক্রিয়াটি এখন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচনী সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
বিশ্লেষণ : অভিযোগের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা
গুরুত্ব : এসব অভিযোগ নির্বাচনপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার জন্য গুরুতর। যদি গণনা ধীরে হয় বা সুক্ষভাবে ম্যানিপুলেট করা হয়, তাহলে জনমতের সঠিক প্রতিফলন নাও হতে পারে। ভোটার তালিকা থেকে ‘অপসারণ’ বা ভোটার মুছে ফেলা মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার বিঘ্নিত করে।
প্রমাণ ও যাচাই : যদিও বহু অভিযোগ উঠেছে, অনেক ক্ষেত্রে তা প্রমাণ ও নির্ভরযোগ্য যাচাই এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু অভিযোগ কমিশন দ্বারা অস্বীকার করা হয়েছে। অপইন্ডিয়া এর কিছু প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ বা তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ আছে, কিন্তু পুরো বিষয়টি এখনো উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ণ যাচাইয়ের দাবি রাখে।
ঝুঁকি : যদি এসব সমস্যা সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি ভবিষ্যতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মানুষের আস্থা কমাতে পারে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু, গরিব বা প্রান্তিক-ভোটারদের প্রতি ভীতি বা অবিশ্বাস বাড়তে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে।
সব মিলিয়ে বিহারের এ নির্বাচন ভারতের জন্য এক সতর্কবার্তা। স্বচ্ছতা, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, ভোটার তালিকা রক্ষণাবেক্ষণ ও গণনা-কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ-সব জায়গাতে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। যে সমাজে ভোটের ফলের চেয়ে ভোটের বিশ্বস্ততা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সে সমাজে গণতন্ত্র শুধু দুর্বল নয়, ঝুঁকির মুখোমুখি।
বাংলাদেশ ২০০৮ বনাম বিহার ২০২৫
২০০৮ বাংলাদেশ : বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনটি ছিল একটি বিশেষ পরিবেশে যখন ক্ষমতায় ছিল সেনা সমর্থিত ‘ওয়ান-ইলেভেন সরকার’। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনী বইয়ের বক্তব্য অনুসারে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদের ছয় দিনের ভারত সফরের সময় পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার বিষয়ে সমঝোতা হয়। পরের ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ সমঝোতার প্রতিফলন ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়।
এ সমঝোতার অংশ হিসাবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে একটি সূক্ষè ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা হয়। যেখানে চারটি কারসাজিমূলক পদক্ষেপ নেয়ার বিষয় উল্লেখ করা হয়। প্রথমত. নির্বাচনী এলাকা পুনর্বিন্যাস করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জেতার মতো অনুক‚লভাবে বিন্যস্ত করা হয়- ফলে অনেক আসনে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত. ভোটার তালিকা প্রণয়ন বা সংশোধনের সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আওয়ামী সমর্থককে ভোটার হিসেবে সংযোজন করা হয়; যাদের হয়তো ভোটের বয়স হয়নি অথবা এ নামে কোনো মানুষের অস্তিত্বই নেই; তাদের অবৈধভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় অথবা আওয়ামী লীগের পক্ষে জাল ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তৃতীয়ত. সারা দেশের এক তৃতীয়াংশ এমন আসন চিহ্নিত করা হয় (বেশির ভাগ নগর অঞ্চলে) যেখানে অল্প ভোটের ব্যবধানে সাধারণভাবে প্রার্থীর জয় নিশ্চিত হয়। এসব আসনে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়। এসব বাক্স ভোট গণনার সময় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যার কারণে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্রে শত ভাগের বেশি ভোট প্রদত্তের রেকর্ড হয়। একই সাথে বাস্তব ভোটার অংশগ্রহণের চেয়ে অনেক বেশি ভোট প্রদানের রেকর্ড স্থাপিত হয়। চতুর্থত. শেষ ধাপে কিছু আসনে ফল পাল্টে দেয়া হয়।
এই ষড়যন্ত্রের সাথে শেখ হাসিনার তদানীন্তন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামসহ কয়েকজন আমলা ও সেনাকর্মকর্তা নিবিড়ভাবে কাজ করেন। এ নির্বাচনের সাথে যুক্ত একজন আলোচিত সেনাকর্মকর্তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপেও এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটি বড় জোট গঠন করেছিল। সেই সাথে তাদের সামনে ভোটবিহীনতা বা বড় রাজনৈতিক বাধা কম ছিল; যার ফলে অপব্যবহারের অভিযোগ থাকলেও পর্যবেক্ষকরা তুলনামূলকভাবে ‘স্বাধীন ও সুষ্ঠু’ ভোট হিসেবে এর প্রশংসা করেছিলেন।
বিহার ২০২৫ : বিহার বিধানসভা নির্বাচন ২০২৫ ছিল একটি রাজ্যস্তরের নির্বাচন, যা ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক বিশেষ গুরুত্ব রাখে। কারণ, বিহার জনসংখ্যা ও রাজনৈতিক শক্তি উভয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যেসব প্রধান রাজনৈতিক জোট আছে, তাতে সরকারি জোট এনডিএ এবং বিরোধী ইন্ডিয়া জোট রয়েছে।
বিহারে ভোটের আগে ভোটার তালিকাকে বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৪৮ লাখ ভোটার বাদ দেয়া হয়েছে। এসব ভোটার যেসব এলাকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে সেসবের প্রায় সব আসনে এনডিএ প্রার্থী জয়ী হয়েছে। এর আগের নির্বাচনে এসব আসনে কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে বিরোধী প্রার্থীদের জয়ী হতে দেখা গেছে।
ভোটারদের সুবিধায় বিহারে কিছু আধুনিক ব্যবস্থাও যেমন- মোবাইল ফোন ডিপোজিট কাউন্টার বুথে এবং প্রার্থীর ছবিসহ ইলেকট্রনিক ভোট- গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো ভোট কারসাজির টুলস বানানোর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিশ্রুতিমূলক ভোট বিষয়েও উন্নয়নমূলক ইস্যু যেমন চাকরি, ‘অবকাঠামো’, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি গুরুত্ব পেয়েছে।
বাংলাদেশ ২০০৮ নির্বাচনের মতো বিহারেও ভোটদাতা অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত উঁচু। বাংলাদেশে ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে; যা আগের গ্রহণযোগ্য যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে বেশি। একইভাবে বিহারের এ নির্বাচনে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ ভোট বেড়ে দ্বিতীয় ধাপে ৬৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। অংশগ্রহণের দৃষ্টিকোণ থেকে, উভয় নির্বাচনে ভোটার উৎসাহ ছিল তবে ধারণা চেয়েও ভোট দেওয়ার হার ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি। রাজস্থান-হরিয়ানা থেকে ট্রাকে ট্রাকে ভোটার এসে বিহারে ভোট দিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
ফল ও রাজনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল জয় পায় : ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৩টিতে (প্রত্যক্ষ ভোট আসন) জয় পেয়ে সরকার গঠন করে। ফল এমন ছিল যে, তাতে একটি একক শক্তিশালী জোট তৈরি হয়ে যায়, যা পরবর্তী রাজনীতিতে তাদের প্রাধান্য বাড়ায়। এর পরের তিন মেয়াদে কার্যত বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হয়নি।
বিহারে ২০২৫ সালে এনডিএ একটি বড় বিজয় পেয়েছে। বিশেষভাবে, বিজেপি এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে প্রথমবারের মতো বিহার বিধানসভায় একক সর্বাধিক আসনের অধিকারী হলো। প্রতিদ্ব›দ্বী জোট ইন্ডিয়া পারফরম্যান্সে তলানীতে চলে যায়। যদিও এখন নানা ধরনের কারসাজির ভয়ানক চিত্র বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। এই অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগের পরিকল্পনা করছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার।
আর বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশ ২০০৮ এবং বিহার ২০২৫ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশীর পছন্দ রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার কথা আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ২০ নভেম্বর ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের আমন্ত্রণে ভারত সফরে যাচ্ছেন। এ সফরের প্রতি নজর রয়েছে অনেকের।
বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় সঙ্কেত
বিহারের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সামনে তিনটি স্পষ্ট সঙ্কেত উঠে আসে : ভোটার তালিকা হচ্ছে রাজনৈতিক অস্ত্র। যে দল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে, ভোটার তালিকা তাদের পক্ষে কার্যকর হাতিয়ার হয়ে ওঠে। গণনা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা না থাকলে পুরো নির্বাচন অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। সিসিটিভি, কাউন্টিং রুম, বুথ তথ্য- সবই প্রতীকী, যদি এগুলো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে না থাকে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায় এখন আঞ্চলিক বাস্তবতা। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান- সব দেশে একই প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় বিদ্যমান। নির্বাচনে কাজে লাগানোর প্রবণতাও রয়েছে।
ভারতের সা¤প্রতিক বিহার বিধানসভা নির্বাচন ভোট গণনা ও ফল ঘোষণার প্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ-অভিযোগের এ দ্ব›দ্ব ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক নতুন দুর্বলতা সামনে এনেছে- যা স্পষ্টত আস্থার সঙ্কট।
বিহার নির্বাচন কেবল একটি আঞ্চলিক ঘটনা নয়। এটি দক্ষিণ এশীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে একটি আয়না- যেখানে আস্থাহীনতা, প্রশাসনিক পক্ষপাত, দুর্বল নির্বাচনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘন কুয়াশার মতো জমে আছে। যদি আমরা সত্যিই গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চাই, তাহলে শুধু ভোট নয়- ভোটের প্রক্রিয়া, ডাটা, নিরীক্ষা ও প্রযুক্তি- সবকিছু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। নচেৎ দক্ষিণ এশীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারে। বাংলাদেশও ফের প্রবেশ করতে পারে এক ঘুটঘুটে অন্ধকার সুরঙ্গে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নয়া দিগন্ত



