ছাত্র সংসদ নির্বাচন : সক্রিয় দুষ্টচক্র

চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা। মূলত ছাত্রসংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করার উদ্দেশ্যেই এগুলো ঘটানো হয়েছে। এই দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। দেশপ্রেমিক ছাত্রসংগঠনগুলোকে এর ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক সজাগ থাকতে হবে।

আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডাকসু’ নির্বাচন আজ ৯ সেপ্টেম্বর। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলো নির্বাচনে ব্যাঘাত ঘটানোর অপচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।

‘ডাকসু’ নির্বাচনের প্রচার এবং উৎসবের আমেজ যখন তুঙ্গে তখন হঠাৎ দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে একটি প্যানেলের ‘জিএস’ প্রার্থীর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী’ প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি এস এম ফরহাদের বিরুদ্ধে ‘অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪’ নামের প্যানেলের প্রার্থী বি এম ফাহমিদা উচ্চ আদালতে রিট করেন। অভিযোগ ছিল, এস এম ফরহাদ নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের পদবিধারী নেতা ছিলেন। তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ না করে ছাত্রশিবিরের পদ গ্রহণ করেছেন এবং নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে আদালত পুরো নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছিলেন, যদিও পরে চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের এ আদেশ স্থগিত করেন। হয়তো বা সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা উচ্চ আদালতের ঘোষণার প্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে শিক্ষার্থীদের মনের কথা বুঝতে সক্ষম হন। স্মরণ করা যেতে পারে, বছরখানেক আগে উচ্চ আদালত কর্তৃক ‘তারুণ্য’ উসকে দেয়া একটি রায়ের প্রেক্ষিতে ভয়াবহ অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটেছিল। মনে রাখতে হবে, আজকের পৃথিবী, সমাজ, শিক্ষার্থীরা আশি বা নব্বই দশকের চেয়ে আলাদা। আজকের গণমাধ্যম অনেক দ্রুত এবং ‘রিয়েলটাইম’ তথ্যপ্রবাহ সারাক্ষণ ঘটাতে থাকে। কাজেই আজকের তরুণরা সহজে তথ্য বিশ্লেষণ করে সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এবং প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। আওয়ামী শাসনের গত ১৬ বছরে কেউ ছাত্রশিবির করলে তাকে হত্যা করার লাইসেন্স পর্যন্ত ছাত্রলীগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়া হয়েছিল। অভিযোগের বিষয়ে ফরহাদ গত একটি বছর অসংখ্যবার বিভিন্ন মিডিয়ায়, সমাবেশে স্পষ্ট করেছেন। দাবি করেছেন তিনি এবং ছাত্রলীগের কমিটির তালিকায় দেখানো এস এম ফরহাদ এক ব্যক্তি নন। তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণও হাজির করেছেন। তারপরও এটি নিয়ে নির্বাচনের ঠিক কয়েকদিন আগে মামলা করার বিষয়টি নির্বাচন বানচাল করার প্রয়াস ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন অফিসে ভাঙচুর করে তালা দেয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অপদস্থ করা হয়। একটি ছাত্রসংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির নেতৃত্বে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তারা প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ভোটার তালিকায় সংযুক্ত করার দাবিতে এমনটি করেছেন। প্রথমত: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ভোটার না করেই নির্বাচনের শিডিউল দিলেন? দ্বিতীয়ত: এই দাবিতে নির্বাচন অফিস ভাঙচুর করা বা আবেদনপত্র সংগ্রহে বাধা দেয়া কি সমাধান হতে পারে? এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ফলে প্রশাসন শিডিউল মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় আছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, প্রথম বর্ষকে ভোটার তালিকায় না নেয়া এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ভাঙচুর করার মধ্যে কি কোনো দুরভিসন্ধি ছিল?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ভাড়া বাসায় থাকা জনৈকা ছাত্রীকে নিয়ে এলাকাবাসী বনাম ছাত্রদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। ছাত্র-শিক্ষকসহ দুই শ’র বেশি আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে যৌথবাহিনী মোতায়েন এবং ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এ ঘটনায় বাইরের আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাহলে কি পতিত ফ্যাসিবাদীরা সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে যেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন না হতে পারে?

ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি বিভাগের মধ্যে দ্ব›েদ্বর জেরে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের আক্রমণের অভিযোগ ওঠে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং হল খালি করার আদেশ দেয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় জেলা প্রশাসক এবং এসপির উপস্থিতিতে এমন ঘটনা কিভাবে ঘটল?

দেশের মানুষ গত ষোলো বছরের বেশি সময় ধরে নির্বাচন দেখে নাই। এই নির্বাচন এমন একটি উৎসব যেখানে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই একযোগে যুক্ত হন এবং উপভোগ করেন। শিক্ষার্থীরা তো নয়ই বরং আজকের বয়োবৃদ্ধ নাগরিকদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নির্বাচনী পরিবেশ দেখার সুযোগ কমই হয়েছে। বহু আগে অবশ্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছিল। সেগুলো ছিল দলীয় সরকারের অধীনে। কিন্তু নির্দলীয় সরকারের অধীনে কখনো কোনো ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি। সব মিলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে এমন এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে যা গণতন্ত্রের সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে।

এই নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা গেলে তার দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পড়বে। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচন সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলে পরবর্তীতে সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। পুরো জাতি এতে আবার দেশগঠনের স্পৃহা নিয়ে জেগে উঠবে। ঐতিহ্যগতভাবেই দেশের সকল ক্রান্তিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হলে মূলত বিজয়ী হবে ‘জুলাই বিপ্লব’ বা ফ্যাসিবাদ হটানোর ‘গণ-অভ্যুত্থান’। ডাকসু নির্বাচনের সফলতা আগামী জাতীয় নির্বাচনকেও সফলতার দিকে এগিয়ে দেবে। আর বাংলাদেশে সফল নির্বাচন মানেই আধিপত্যবাদীদের নাক গলানোর সকল পথ বন্ধ হওয়া! এতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ গড়ার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

আজকের বাস্তবতা এটাই যে, এসব নির্বাচনে ইসলাম ভাবাপন্নদের ভালো করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে ইসলামী ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের কথা তরুণদের সামনে উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছে। গত ষোলো বছরের ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দোসর চিহ্নিত মিডিয়ার দ্বারা ইসলামী ছাত্রসংগঠনের ছাত্রদেরকে দানবীয় করে তোলার বয়ান মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ীদের চেতনার পক্ষ-বিপক্ষের ন্যারেটিভের অসারতা প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে।

এমন বাস্তবতায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে দেশে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের ফিরে আসার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। আধিপত্যবাদী ভারত তাদের মধু খাওয়ার চাকটি চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। অন্যদিকে বামপন্থীরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। চিহ্নিত মিডিয়া হাউজগুলোর মুখোস খসে পড়ে তাদের চরিত্র উন্মোচিত হয়ে যাবে!

যারা সুষ্ঠু ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হিসেবে দেখছে তারাই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এসব নির্বাচন পণ্ড করার। আর এসব কুচক্রীদের এজেন্ট বা অপারেটর হিসেবে অনেকেই কাজ করছে। এদের কেউ বুঝে আর কেউ বা না বুঝেই কুচক্রীদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে।

চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা। মূলত ছাত্রসংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করার উদ্দেশ্যেই এগুলো ঘটানো হয়েছে। এই দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। দেশপ্রেমিক ছাত্রসংগঠনগুলোকে এর ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক সজাগ থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশবিরোধী এই চক্রান্ত নস্যাৎ করতে হবে। তাদের সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠনের জয়-পরাজয়ের প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সুসম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে বাইরের কারো ইন্ধন রয়েছে কি না তা অবশ্যই চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক