শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে দেশের ধর্মীয় আদর্শের রাজনৈতিক শক্তি। স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, ইসলামপন্থী দলগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। পতিত শেখ হাসিনার ইচ্ছা পূরণে দলটির শীর্ষ পাঁচ নেতাকে বিচারিক হত্যা করা হয়েছে। সেই সাথে চার নেতা করাগারে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আর গুম-খুন এবং ক্রসফায়ারে দলটির বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে। তাই এ কথা নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলা হবে না যে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে জামায়াত নেতাকর্মীদের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। অবশ্য দেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকেও কম মূল্য দিতে হয়নি। তাদেরও বহু নেতাকর্মী শেখ হাসিনার জিঘাংসার শিকার হয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। তবে এ কথা সবাই একবাক্যে কবুল করে নেবেন যে, দল হিসেবে জামায়াতকে নির্মূল করতে শেখ হাসিনা উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আর তিনি জঘন্য এই অপকর্ম আঞ্জাম দিয়েছেন ভারতের সুপরামর্শে!
দিল্লি সবসময় মনে করে, বাংলাদেশে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক ইসলাম। যেহেতু ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামী দল পরিচালনা করে এবং দেশের বড় ইসলামী দল। একই সাথে সুসংগঠিত। তাই সাউথ ব্লক বিগত সাড়ে ১৫ বছর শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে জামায়াত-শিবিরকে নির্মূলে অগ্রসর হয়। এরই অংশ হিসেবে জামায়াতের ওপর নেমে আসে শেখ হাসিনার খড়গ। ফলে দলটিকে একেবারে নিষিদ্ধের পর্যায়ে ঠেলে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্দো-মার্কিন যৌথ সমর্থন পান শেখ হাসিনার সরকার। নাইন-ইলেভেন-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ কৌশলগত অংশীজন হয় ভারত। এতে করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামকে সমূলে উৎপাটনের মওকা পেয়ে যায় দিল্লি। এটি ছিল ভারতের জন্য সোনায় সোহাগা।
ওয়াশিংটন-দিল্লির যৌথ প্রয়োজনায় ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলে ওয়ান-ইলেভেন ঘটানো হয়। এ ঘটনা সফলভাবে মঞ্চায়নে এ দেশীয় দোসর হিসেবে তথাকথিত সুশীলসমাজ এবং গণমাধ্যমের প্রভাবশালী একটি অংশ ওই যাত্রাপথের পথিক হয়। সবার মনে থাকার কথা, ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সরকার তাদের প্রচেষ্টার ফসল। লক্ষণীয় বিষয় হলো- রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ, প্রথম আলো-ডেইলি স্টার, সুশীলসমাজ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের রাজনীতে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিনের সরকার কায়েম করে। টানা দুই বছর নানা ছলাকলা করে অবশেষে ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দেয়। পরিণামে বাংলাদেশের মানুষ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হন। বিপুল রক্তের বিনিময়ে অবশেষে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনার অপশাসনের অবসান ঘটে। গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনার তখতে-তাউস উল্টে গেলে দেশের মানুষ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার স্বাদ পান।
গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে দেশে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে এ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষের আদর্শিক চেতনা যারা ধারণ করেন, সেই রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। মূলত বাংলাদেশে এই রাজনৈতিক ধারাটিই হওয়ার কথা মূলধারার রাজনীতি। মানে দাঁড়াচ্ছে সর্বভারতীয় সংস্কৃতি ও আধিপত্য থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার একমাত্র অবলম্বন ইসলামকে আঁকড়ে ধরে এ দেশের বিশ্বাসী জনগণ বাঁচার মতো বাঁচতে চায়। যাপিত জীবনে বিশ্বাসের আলোকে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে টিকে থাকতে চায়। ইসলাম অবলম্বন করে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্য থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে প্রত্যাশী বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ। যার মাধ্যমে ভারতের পৌত্তলিক সংস্কৃতি থেকে স্পষ্টভাবে বাংলাদেশকে আলাদা করা যায়। এটিই এখন রাজনীতির অভিমুখ। কাজটি সুনিপুণভাবে করতে পারে এ দেশের রাজনৈতিক ইসলাম।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ভারতীয় আধিপত্যের ঘোর বিরোধী। সঙ্গত কারণে তারা দিল্লির প্রতি সহানুভূতিশীল এদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে আর প্রশ্রয় দিতে নারাজ। তাই দেখা যাচ্ছে, আমাদের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশের মানুষ ইসলামপন্থীদের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ এর প্রমাণ। কিন্তু দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের এই প্রবণতায় সাবেক বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদমাধ্যমের গাত্রদাহ উৎকটভাবে চোখে পড়ছে। তারা তাদের মনের জ্বালা আর ঢেকে রাখতে পারছেন না।
বামপন্থী তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরের কথাই ধরা যাক। তিনি দেশের মানুষের বর্তমান রাজনৈতিক ঝোঁক প্রবণতাকে দেখছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী দেশে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান হিসেবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সভার আয়োজন করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। এ সভায় বদরুদ্দীন উমর বলেন, ৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী হয়েছে। এখন দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে। তাদের একটা উত্থান হয়েছে এখন। ছাত্রদের নেতৃত্বে যে পার্টি হয়েছে সে পার্টির বক্তব্যে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ নিয়ে কোনো কথা নেই। তারা ভাবছে ধর্মকে ব্যবহার করবে। সে জন্য তাদের সাথে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। (প্রথম আলো প্রিন্ট ভার্সন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫)
মজার ব্যাপার হলো- ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর বাম তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর একই সভায় বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপিকে সবচেয়ে প্রগতিশীল মনে হচ্ছে তার কাছে।
সাবেক বামপন্থী ও ‘বিতর্কিত’ বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারও বলেছেন, ‘বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তিকেও আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ফ্যাসিস্ট শক্তির হাত থেকে রক্ষা যেমন রাজনৈতিক কর্তব্য, তেমনি ধর্মকেও ফ্যাসিস্ট শক্তির বকল থেকে উদ্ধার করাও একই রাজনৈতিক কর্তব্য’। (প্রথম আলো, ৩ জুলাই ২০২৫) লক্ষণীয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী নামের সেক্যুলার ফ্যাসিবাদীদের পতনের পর এখন ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদ রুখতে বদ্ধপরিকর ফরহাদ মজহার। তার এই বক্তব্যের আমরা যে বুঝ নিতে চাই তা হলোÑ আসলে তিনি রাজনৈতিক ইসলাম রুখতে চান।
ইরানি বিপ্লবে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ইসলামের রূহানিয়াত দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। এখানে রূহানিয়াতকে ইসলামের রাজনৈতিক কর্তাসত্তা হিসেবে দেখেছেন ফুকো। এমনকি পশ্চিমা শাসনব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে রাজনৈতিক ইসলামকে দেখেছেন তিনি। একদা এ দেশের ইসলামপন্থীদের সুহৃদ ফরহাদ মজহার কেন যে রাজনৈতিক ইসলাম, ফুকোর ভাষায় ইসলামের রূহানিয়াতকে রুখে দিতে চান তা এক অপার রহস্য!
আরেক সাবেক বামপন্থী এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বর্তমানে রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান দেখে উদ্বিগ্ন। প্রথম আলোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
পত্রিকাটির বিশেষ প্রতিনিধি সেলিম জাহিদের প্রশ্ন ছিল : ‘ধরুন, নির্বাচন সময় মতো মাঠে গড়াল। দেশের দু’টি বড় দলের একটি আওয়ামী লীগ নেই। দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মাঠে বড় দল শুধু বিএনপি। এ অবস্থায় নির্বাচনটা একপেশে হয়ে যাবে না?
মির্জা ফখরুল : কেন? বিএনপির বিরোধী একটি বিশাল গ্রুপ তো আছে। জামায়াতে ইসলামী আছে, এনসিপি আছে, নতুন জাতীয় নেতা চরমোনাই পীর সাহেব আছেন। সমস্যা কোথায়? তারা আসবেন, জনগণ ভোট দিলে তারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন। তারা যদি সরকারও গঠন করেন, তাহলে আমি তো মেনে নেবো।
প্রথম আলো : এখন পর্যন্ত তো ওই দলগুলোর কোনোটিই কিন্তু (নির্বাচনে) প্রমাণিত বড় দল নয়।
মির্জা ফখরুল : জামায়াতে ইসলামী তো পার্লামেন্টে ছিল। তাই না? যাই হোক, যারা আসছেন, তাদের অ্যালায়েন্স হবে, বড় হবে, আরো বড় হবে।
প্রথম আলো : তাহলে কি আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হতে যাচ্ছে? বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বিষয়টি আলোচনায় এনেছেন। আপনি কি দেখেন?
মির্জা ফখরুল : আমিও দেখছি। সে জন্য আমি উদ্বিগ্ন। আমি বাংলাদেশকে সবসময় একটি সত্যিকার অর্থে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই এবং এখানে গণতন্ত্র হবে সবচেয়ে বড় বিষয়। সেই জায়গায় যদি এখন এমন এমন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়, যারা গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে করে না। আবার তারা নিজেরা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় মতবাদকে, এটি নিঃসন্দেহে অ্যালার্মিং সিচুয়েশন। কিছু কিছু দলের মধ্যে এমনও কথা আছে, মহিলাদের তারা কিছুতেই সামনে আনতে চায় না। মহিলাদের তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, তারা সামাজিক ক্ষমতায়নও করতে চায় না। এসব দলের যদি উত্থান হয় এই দেশে, তাহলে তো পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। (প্রথম আলো, শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫)
একটু খেয়াল করলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, প্রথম আলো মির্জা ফখরুলের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আসলে কী বের করে আনতে চায়। তবে সিরিয়াস পাঠক না হলে পত্রিকাটির মতলব অস্পষ্ট থেকে যাবে। আমাদের মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কেন ইসলামপন্থী, পত্রিকাটির ভাষায় দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে পূর্ণ হবে। এটিই পত্রিকাটির অন্তর্জ্বালা। সাবেক বামপন্থী হিসেবে মির্জা ফখরুলের হৃদয়েও সে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। তাতে তিনি কাতর। পাশাপাশি বাংলাদেশে বিগত ফ্যাসিবাদী জমানায় নানাভাবে সুবিধাভোগী সুশীলসমাজের মুখপত্র, যা কিনা আরেক সাবেক কমিউনিস্ট মতিউর রহমান সম্পাদিত প্রথম আলোরও মর্মবেদনা। মির্জা ফখরুলের সাক্ষাৎকার নেয়ার নামে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছে, তাতে পাঠক হিসেবে আমাদের তাই মনে হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, যারা মূলধারার রাজনীতিকে দক্ষিণপন্থী হিসেবে উল্লেখ করছেন, তাদের ভাবনা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। তবে এ কথাও ঠিক, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশবাসীকে কী করতে হবে এবং কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে বিষয়ে রাজনীতিসচেতন জনগোষ্ঠী নিশ্চয় সতর্ক হবে। এই রাজনীতির ধারক জনগোষ্ঠী আত্মমর্যাদাশীল আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করতে সক্ষম হবে বলে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে মনে হচ্ছে।
 


