ইরানে আগ্রাসন মূলত সভ্যতার সঙ্ঘাত

ইরানিদের মধ্যে বিপ্লবকালে যেমন সম্মিলিত জনসংহতি ছিল, ঠিক তেমনিভাবে এখন এক সম্মিলিত শক্তির উদ্বোধন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের এই শক্তিকে দমানো চাট্টিখানি কথা নয়। যেভাবে আফগানদের দমাতে পারেনি আমেরিকা। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে পিছুটান দিতে হয়েছে মার্কিনিদের। এর আদর্শিক কারণ আর কিছু নয়- আধুনিক পশ্চিমা রাষ্ট্রব্যবস্থা যে সেকুলার আদর্শে গড়ে উঠেছে- তাতে রয়েছে বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতা। পক্ষান্তরে ইসলাম ধারণ করে আছে মানবতা

নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

ইরানে মার্কিন-ইসরাইল আগ্রাসন নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যম ব্যতিব্যস্ত। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ সঙ্ঘাত নিয়ে আমরাও প্রতিনিয়ত সর্বশেষ তথ্য পেতে উদগ্রীব।

সাদা চোখে ইরানে ইসরাইলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় তেহরানের পাল্টা হামলায় যে উত্তেজনা চলছে, তার সাথে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বোমা বর্ষণকে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কী যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইল : যে রাষ্ট্রটিকে অনেকে বলে থাকেন আমেরিকার মিডল ইস্টের গ্যারিসন সিটি, সেই ইসরাইলের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এত চিন্তিত! যুদ্ধে ইসরাইলের কাক্সিক্ষত ফল না আসায় এবার ময়দানে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হাজির হওয়া কি মিত্রকে রক্ষার অঙ্গীকার পালন! ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান দিয়ে বোমা নিক্ষেপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে এই হামলা চালানোর অনুমোদন দেন। অথচ এর আগে তিনি ১৪ দিনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর ঘোষণা দিয়ে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। তার আগেই ইরানে হামলার মানে কী? এক আঙ্গিকে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের স্বার্থ রক্ষায় ইসরাইলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায় রয়েছে। তেলআবিবের মুরুব্বি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এই দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। পাশাপাশি এটি যে তাদের আদর্শিক দায় তা-ও অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে কি?

সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে বহু ওলট-পালট হয়েছে। নিকট অতীতে ঘটেছে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন ইরাককে ধ্বংস করেছে। লিবিয়াকে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। আর সম্প্রতি সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতন বিশ্ববাসীর হৃদয়পটে জ্বলজ্বল করছে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের নিষ্ঠুর মানবতাবিরোধী গণহত্যার কথা নাইবা বললাম। এই যে এত কিছু ঘটছে, তা কি সব রাষ্ট্রীয় স্বার্থে। বিষয়টির বৈষয়িক দিক বিবেচনায় নিয়েও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান ইরানে মার্কিন-ইসরাইল হামলার ঘটনার বিশ্লেষণ আমরা করতে চাই।

কেন সব কিছু একপাশে সরিয়ে আদর্শগত দিকটি আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তার জবাব বর্তমান এ লেখায় তুলে ধরতে প্রয়াস চালাব আমরা।

স্মরণযোগ্য, খ্রিষ্টীয় দুনিয়ার সাথে মুসলিমদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত মূলত সুদূর অতীত থেকে বিদ্যমান। তাও আবার মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে। তা তুঙ্গে ওঠে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সময়কাল থেকে। সেই যে শুরু তা কখনো একেবারে বন্ধ হয়নি। মাঝে মধ্যে এই বিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বর্তমানে খ্রিষ্টীয় দুনিয়ার সাথে এই বিবাদে গাঁটছড়া বেঁধেছে জায়নবাদীরা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ওসমানীয় খেলাফতের অংশ ফিলিস্তিন ব্রিটিশরা দখলে নেয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনের ষড়যন্ত্রে এবং মার্কিন মদদে ১৯৪৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে খ্রিষ্টান-জায়নবাদীদের সম্পর্কের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়। সেই থেকে তারা একে-অপরের হাত ধরে চলছে। যা আজো অটুট। পশ্চিমা দুনিয়া বিশেষ করে ইউরোপ যখন অন্ধকারে ডুবে ছিল তখন মুসলিমরা খ্রিষ্টীয় জগতকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। স্পেন দিয়ে এর শুরু। কিন্তু পরবর্তীতে দিনে দিনে মুসলিম সমাজ আদর্শিকভাবে নিষ্ঠাবান থাকতে না পারায় তাদের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফলে ইউরোপে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। অন্য দিকে ইউরোপীয় খ্রিষ্ট সমাজ নব নব আবিষ্কারে ধর্মের অর্থাৎ গির্জার বাধার মুখে ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে সরিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়ে আসে। ফলে ইউরোপের দেশে দেশে প্রতিষ্ঠা পায় সেকুলারিজম। সেকুলারিজমের আলোকে গড়ে তোলা হয় ধর্মহীন এক সমাজব্যবস্থা। কলোনি অর্থাৎ উপনিবেশের মাধ্যমে দুনিয়ার দেশে দেশে এ মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করে ইউরোপ। যার উত্তরাধিকার এখনো আমাদের বহন করতে হচ্ছে।

১৯১৭ সালে লেনিন রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ইউরোপের পুঁজিতান্ত্রিক সেকুলারিজমের বিকল্প দুনিয়ার অনেক দেশ তা কবুল করে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গড়তে সচেষ্ট হয়। লক্ষণীয়, বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকের প্রথম দিকে যখন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে পড়ে;, তখন আবার পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়া সারা বিশ্বে ছড়ি ঘোরাতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনের কাছ থেকে বিশ্ব নেতৃত্ব হাতছাড়া হলে যুক্তরাষ্ট্র পাকাপোক্তভাবে পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়লের আসনে অভিষিক্ত হয়। অন্য দিকে, সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে কমিউনিস্ট ব্লক। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে চলে সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধ। এর যবনিকাপাত হয় সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে বিশ্বব্যবস্থা হয়ে পড়ে এককেন্দ্রিক। যার একচ্ছত্র নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকা। কিন্তু আশির দশকে বিশ্ব ইতিহাসে ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা। কী সেই ঘটনা! ১৯৭৯ সালে ঘটে ইরানি বিপ্লব। এই বিপ্লবের রুহানিয়াত হলো ইসলাম। মানে ইরানে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে বিশ্ব ইতিহাসের পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসে রাজনৈতিক ইসলাম। এই রাজনৈতিক ইসলাম অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে সেকুলার ইরাককে দিয়ে বছর আটেক পশ্চিমারা বিশেষ করে আমেরিকা প্রক্সি বা ছায়াযুদ্ধ চালায়। তাতে সুবিধা করতে না পারায় ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের অবসান হয়।

ফরাসি বুদ্ধিজীবী ও পশ্চিমা দুনিয়ার মশহুর চিন্তক মিশেল ফুকো ইরানি বিপ্লবকে দেখেছেন সেকুলারিজম অর্থাৎ বস্তুবাদী ও পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়ার বিকল্প হিসেবে। চিন্তার জগতে এই দার্শনিকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে জ্ঞান ও ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করা এবং এটি আধুনিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিভাবে এক ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়; তা দেখানোর সক্ষমতায়। মিশেল ফুকো আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর একজন দুর্নিবার সমালোচকও বটে। আধুনিক রাষ্ট্রক্ষমতা কিভাবে কাজ করে, ক্ষমতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রূপান্তর হয় ক্ষমতার এই কায়-কারবার ও কারিগরি বুঝতে ও বোঝাতে তিনি আগ্রহ বোধ করতেন।

আধুনিক রাষ্ট্র যে ইউরোপের আলোকায়নজাত চিন্তা থেকে উঠে এসেছে- তিনি তারো সমালোচক। আলোকায়নের বাইরেও যে অন্যরকম চিন্তা থাকতে পারে, এসব চিন্তাও সর্বজনীন হয়, ফেলনা নয় এসবও তিনি আমলে নিয়েছেন। তাই দেখা যায়, ফুকো ইরানি বিপ্লব অর্থাৎ রাজনৈতিক ইসলামকে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের বিকল্প শাসনব্যবস্থা হিসেবে ভেবেছেন এবং বিবেচনায় নিয়েছেন।

মিশেল ফুকো ১৯৭৮ সালে এমন একসময় ইরান সফর করেন, যখন দেশটি এক বৈপ্লবিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি ১৯৭৮-এর সেপ্টেম্বরে একবার, পরে একই বছর নভেম্বরে আরেকবার ইরান সফর করেন। ইতালির দৈনিক পত্রিকা করিয়েরে দেলা সেরা তার এই সফরের ব্যবস্থা করে। বিনিময়ে ফুকো পত্রিকাটিতে প্রবন্ধ ও কলাম লেখেন। এখানে তিনি ইরানি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন। একই সাথে বিপ্লবকে সমর্থন করেন।

আমাদের অনুমান, ইরানি বিপ্লব নিয়ে ফুকোর এমন মূল্যায়নে পাশ্চাত্য রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন তা ইসলামোফোবিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজতন্ত্রের পতনের পর পশ্চিমা দুনিয়া ইসলামের প্রতি তাদের নিশানা তাক করেছে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন তাত্ত্বিক হানটিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্বের (ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেশন) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই নাইন-ইলেভেনে আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর ইসলামের বিরুদ্ধে ‘অনন্ত যুদ্ধ প্রকল্পের’ আওতায় ইরাকে মানবতাবিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে এমন অজুহাতে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা চালায় পশ্চিম। আফগানিস্তানে দুই দশকব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনীর ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ জারি রাখা হয়। সঙ্গতকারণে প্রশ্ন তোলা যায়, ইরানের ওপর এখনকার মার্কিন-ইসরাইল আগ্রাসন তাদের পুঁজিতান্ত্রিক অনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে একটি আদর্শিক আক্রমণ। এ কথা বলার কারণ, ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা থাকলেও উত্তর কোরিয়ার নিউক্লিয়ার বোমার ব্যাপারে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য দেখা যায় না। অথচ উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ধ্বংসলীলা চালিয়ে ইরানকে আদৌ ওয়াশিংটন বশে আনতে পারবে কি না? আমাদের পর্যবেক্ষণ বলে, ইরানিদের মধ্যে বিপ্লবকালে যেমন সম্মিলিত জনসংহতি ছিল, ঠিক তেমনিভাবে এখন এক সম্মিলিত শক্তির উদ্বোধন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে এই শক্তিকে দমানো চাট্টিখানি কথা নয়। যেভাবে আফগানদের দমাতে পারেনি আমেরিকা। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে পিছুটান দিতে হয়েছে মার্কিনিদের। এর আদর্শিক কারণ আর কিছু নয়, আধুনিক পশ্চিমা রাষ্ট্রব্যবস্থা যে সেকুলার আদর্শে গড়ে উঠেছে- তাতে রয়েছে বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতা। পক্ষান্তরে ইসলাম ধারণ করে আছে মানবতা।

[email protected]