সম্প্রতি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও স্পর্শকাতর স্থাপনায় পাঁচ দিনের ব্যবধানে ভয়াবহ তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত ১৪ অক্টোবর সকালে রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে। এতে ১৬ জন মানুষ প্রাণ হারান। ধ্বংস হয় সম্পদ, স্থাপনা। পুড়ে ছাই হয়েছে কারখানার মালিক, কর্মচারী ও নিহতদের পরিবারগুলোর স্বপ্ন।
এর একদিন পর চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপ নামের একটি কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের পাশাপাশি অংশ নেয় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিট, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এর একদিন পর ১৮ অক্টোবর দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর জায়গা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুনের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে, প্রায় কোয়ার্টার কিলোমিটারজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে ৩৭টি ইউনিটকে প্রায় ২৭ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। আগুন নেভাতে গিয়ে আহত হন আনসার সদস্যসহ ৩৫ জন। আগুনের তীব্রতা এবং কালো ধোঁয়ার কারণে ২৩টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অন্য বিমানবন্দরে অবতরণে বাধ্য হয়।
আগুনে মূল্যবান তৈরী পোশাক ও ওষুধের কাঁচামাল, স্যাম্পল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা বেশ কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিমানবন্দরের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থানে আগুন এত দ্রুত কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল। কিংবা আগুন নিয়ন্ত্রণে এত সময় লাগল কেন? আগুন লাগার সাথে সাথে অ্যাভিয়েশনের নিজস্ব দমকল ইউনিট কেন আগুন নেভাতে পারল না। বিমানবন্দর একটি কেপিআইভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যেখানে সার্বক্ষণিক মনিটরিং থাকার কথা, আগুন লাগার শুরুতে বিমানবন্দরের ভেতরের নিজস্ব ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব ইউনিটের ব্যর্থতায় কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি আছে কি না এমন অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর গেটে আধাঘণ্টার মতো অনুমতির জন্য আটকে রাখা নিয়েও।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের এই তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড জনমনে নানান উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই ঘটনাগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মানতে রাজি নন। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকেই এর মধ্যে নাশকতার মাধ্যমে জনমনে পরিকল্পিতভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ করেছেন। অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে, যাতে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়। একই সাথে দেশের অর্থনৈতিক ও শিল্প-কলকারখানায় স্থবিরতা সৃষ্টির হীনউদ্দেশ্যে মহল বিশেষ পরিকল্পিতভাবে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে বলে অনেকের অনুমান।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও ঘটনাগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত কি না তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার হিসেবে এই বিমানবন্দর শুধু যাত্রী পরিবহনের কেন্দ্র নয়, বরং বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।
বিমানবন্দরের মতো এমন একটি কৌশলগত স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও নিরাপত্তা ঘাটতির স্পষ্ট প্রমাণ। বিমানবন্দরের ঘটনায় যদি গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা বা নাশকতার উপাদান থেকে থাকে, তবে তার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া সময়ের দাবি।
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বিগ্ন নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিঘিœত করার সুযোগ দেয়া হবে না।
এ দিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিভাবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এমন প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ব্যবসায়ীদের কারখানা কেউ যদি জ্বালিয়ে দেয় এবং রাষ্ট্র কোনো সেক্টরে নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে কিভাবে রাষ্ট্র একটা জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে? গত ১৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ নাজুক অবস্থানে আছে, এই অবস্থায় কিভাবে ক্রেডিবল নির্বাচন হবে?
অন্য দিকে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব:) ইকবাল করিম ভূঁইয়া গত ২১ অক্টোবর নিজের ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে আগামী পাঁচ বছরে আমরা কোথায় যাচ্ছি এমন প্রশ্ন তুলে বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আরো ১-২ বছর থাকবে। তারপর নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতা আরোহণের সম্ভাবনা। বিএনপি পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারবে কি না তা নির্ভর করবে কিছুটা ভারতের কৌশলগত অবস্থানের ওপর এবং কিছুটা আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ও শক্তি সঞ্চয়ের ওপর। যদি বিএনপি তার বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত সহিংসতাবিরোধী আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয় তবে ১/১১-র পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
পোস্টটিতে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে আরো বলেছেন, অদক্ষতা, আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণে অথবা ছাত্রচাপের মুখে সংস্কার-মিশনে হাত দিলে, নির্বাচন না হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকবে। তখন দুর্বল মন্ত্রীরা বদলাবে এবং ড. ইউনূসকে প্রেসিডেন্ট করে ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠিত হবে। সংবিধান বদলের ক্ষীণ গুঞ্জন উচ্চারিত হলে আগামী পাঁচ বছর যাবে গণপরিষদের নির্বাচন, সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটে। যাই ঘটুক, এই পাঁচটি বছর দেশকে বাস করতে হবে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতার ভেতর দিয়ে। পঙ্গু অর্থনীতি দরিদ্রদের আরো বিপদে ফেলবে এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ ক্রমাগত পেছাতে থাকবে।
সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমরা বুঝতে পারি তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে দেশ-বিদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে থাকেন এবং এনসিপি গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক দল। অনেকেই মনে করেন এই দলটির প্রতি ক্ষমতায় থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আশীর্বাদ রয়েছে। কাজেই সাবেক সেনাপ্রধান ও এনসিপি নেতৃবৃন্দ যখন পাবলিকলি কোনো কথা বলে তা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। অগ্নিকাণ্ডের পরপরই দুই গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের দুই নেতা যখন নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কারণ থাকতে পারে না। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় এসব ঘটনার পেছনে দুরভিসন্ধি থাকতে পারে, যা গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে হলে হাতে খুব বেশি সময় নেই। নির্বাচন সামনে রেখে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা বিদেশী বিনিয়োগ ও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি স্লথ করে দেয়। কাজেই দেশের তৈরী পোশাক শিল্প ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষাকল্পে একই সাথে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা সমুন্নত রাখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত অবিলম্বে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং তথ্যনির্ভর তদন্ত নিশ্চিত করা। সিসিটিভি ফুটেজ, নিরাপত্তা ত্রুটি, ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা। যাতে জনমনে যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান ঘটে।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট



