রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের দায় ও সুযোগ

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জুলাই চেতনার বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে কমিশনে আলোচিত সবগুলো ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান জানান দিতে হবে- এটিই জাতির প্রত্যাশা।

অধ্যাপক ড. এম. আবদুল আজিজ

চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় সন্ধিক্ষণ। এ অভ্যুত্থান কেবল একটি সরকারের পতন ঘটায়নি; বরং দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সংস্কারের আকাক্সক্ষাকে এক ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ ম্যান্ডেট ধারণ করে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২৩ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট গঠিত হয়; যারা সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন রাষ্ট্রের নতুন ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে প্রণীত হয় রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা- জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ, দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

জুলাই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও আদর্শিকভাবে স্বীকৃতি দেয়; মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস ও শহীদদের সম্মান জানায় এবং ভবিষ্যতের জন্য মৌলিক আকাক্সক্ষা ও অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত করে। অন্য দিকে, জুলাই সনদ সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের একটি পথরেখা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে এ সনদ প্রণয়ন করা। সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে গণ-অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেয়া জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন নিশ্চিত করা- এ ছিল কমিশনের মূল দায়বদ্ধতা।

কমিশনের যাত্রা মোটেও মসৃণ ছিল না। চূড়ান্ত খসড়া তৈরির আগে ২৯টি দলের কাছে প্রাথমিক প্রস্তাবনা পাঠানো হয়, যার মধ্যে ২৬টি দল মতামত প্রদান করে। পরে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সাড়া নিঃসন্দেহে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে এক ব্যাপক আলোচনা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় সংহতির ইঙ্গিত বহন করে। ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকে নিয়ে তৈরি জুলাই সনদের ৮৪টি মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্তে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ছিল ক্ষমতার ভারসাম্য ও দলীয় স্বার্থের জটিল লড়াই; যদিও ৯টিতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়গুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল- প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ, সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার স্বাধীনতা প্রদান, অর্থবিল, আস্থা ভোট এবং সংবিধান সংশোধনী বিল ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের এই আংশিক সংশোধন সংসদকে দলীয় শৃঙ্খলের কঠোরতা থেকে মুক্ত করে আলোচনামুখী সংসদ প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেয়। একই সাথে সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার- এ চার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলের কাছে দেয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়, যা নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদের নজরদারি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করেছে।

অন্য দিকে সাংবিধানিক নিয়োগে নির্বাহী প্রভাব কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবটি রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির কারণে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। বিএনপি সরাসরি শর্ত দেয়, সংবিধানে এ ধরনের কোনো কাউন্সিল গঠন করার বিধান রাখা যাবে না, যা ক্ষমতার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার প্রবণতা স্পষ্ট করে; তা ছাড়া পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকা, দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার মতো বিষয়েও দলটির ভিন্নমত রয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠন, ন্যূনতম বিচারক সংখ্যা নির্ধারণ, বিচারপতির যোগ্যতা ও অবসরের বয়স বাড়ানো- এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হলেও এনসিসি প্রসঙ্গে ব্যর্থতা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখে।

নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহা ছিল সবচেয়ে স্পষ্ট। নারী অধিকারকর্মীরা সংরক্ষিত ১০০ আসনে সরাসরি ভোটের দাবি জানালেও দলগুলো এ প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করে। কমিশনের মধ্যে কোনো নারী প্রতিনিধি না থাকা ছিল একটি বড় দুর্বলতা। শেষ পর্যন্ত ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখা হয় এবং পরবর্তী নির্বাচনে ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের সিদ্ধান্ত হয়, যা নারী নেতৃত্ব বিকাশে সীমিত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নে জনগণের সম্মতি নিতে গণভোট করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কমিশন (ইসি) জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি জুলাই সনদে জনগণের সমর্থন যাচাইয়ে হ্যাঁ-না ভোট গ্রহণ করবে। তবে গণভোট কী জাতীয় নির্বাচনের সাথে একই দিনে হবে, নাকি তার আগে হবে; গণভোটের আগে জুলাই সনদ নিয়ে সংবিধান আদেশ জারি করা হবে কি না, এসব বিষয়ে এখনো রাজনৈতিক মতভিন্নতা রয়ে গেছে। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কয়েক পর্বের আলোচনা, রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথে ধারাবাহিকভাবে দফায় দফায় বৈঠক, বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ মতামত গ্রহণ, কিছু দলের সাথে একাধিক বৈঠক ও জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের বেশির ভাগ বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া- এটি বড় অর্জন।

ম্যান্ডেট থেকে বাস্তবে উত্তরণে করণীয়

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জন্য এক অভূতপূর্ব ‘ডেমোক্র্যাটিক উইন্ডো’ খুলে দিয়েছে। কিন্তু সংস্কারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দল- দু’পক্ষকে ঐতিহাসিক দায়িত্বে দৃঢ় হতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা হচ্ছে :

১. উচ্চকক্ষ গঠন ও পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটি যৌক্তিক দাবি। তবে এ মুহূর্তে উচ্চকক্ষ গঠন না করে বিকল্প হিসেবে বর্তমান সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ করা যেতে পারে। অতিরিক্ত ১০০ আসন থাকবে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে দলীয়ভাবে মনোনীতদের জন্য- যেখানে সিভিল সোসাইটির সদস্য, নারী প্রতিনিধি ও আলেম-ওলামা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। এতে করে আসনভিত্তিক নির্বাচিত এবং পিআরের মাধ্যমে মনোনীতদের যুক্তিতর্ক একই মঞ্চে হবে এবং ব্যালেন্সড আন্ডারস্ট্যান্ডিং (ভারসাম্যপূর্ণ বোঝাপড়া) সম্ভব হবে। এ ছাড়া এর মধ্য দিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমবে, বিপুল অর্থের অপচয় রোধ হবে এবং সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

২. সংবিধান সংশোধনে উপরিউক্ত ৪৫০ জনের তিন-চতুর্থাংশ ভোটের বিধান রাখতে হবে, যাতে সরকারি দল এককভাবে ইচ্ছেমতো সংশোধন করতে না পারে। এতে করে এক কক্ষে এক দলীয় আধিপত্য প্রতিরোধের সুযোগ তৈরি হবে এবং উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তাও একই কক্ষে পূরণ সম্ভব হবে।

৩. ইউপি চেয়ারম্যানের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি ও ইউপি মেম্বারের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি শর্তযুক্ত করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে নয়; বরং নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আয়োজন করা উচিত, যাতে তৃণমূলে নেতৃত্ব বিকশিত হয় এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। অতএব, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সাথে একই সময়ে বর্তমান সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে সারা দেশে একযোগে না করে তিন দিন বা সপ্তাহব্যাপী নির্বাচন সম্পন্ন করা যেতে পারে।

৪. সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ ও দায়িত্ব পালন প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ করতে সরকারি দল, বিরোধী দল ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন এনসিসি কাউন্সিল গঠন করার ধারণা ভালো ছিল। সেখানে ন্যূনপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে যাতে ক্ষমতায় ভারসাম্য আসে বা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়। এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ, পিএসসি, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এবং স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও দায়িত্বে পালনে পক্ষপাতমূলক এবং বৈষম্যমূলক আচরণ রোধ হবে। রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে এ কাউন্সিলের দায়িত্ব হবে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা।

৫. সংরক্ষিত আসন না বাড়িয়ে সাধারণ আসনে নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, যাতে মূলধারায় নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়। কোটা পদ্ধতি দিয়ে আসলে প্রকৃতি ক্ষমতায়ন কখনো সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সব নির্বাচনে ৫ থেকে ১০ শতাংশ নারীর মনোনয়ন নিশ্চিত করবে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে দলীয় আসন বরাদ্দেও নারীর অন্তর্ভুক্তি বিবেচনায় নিতে হবে।

৬. এখন পর্যন্ত যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য ঝুলিয়ে না রেখে অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের নিজস্ব এখতিয়ার বলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিতে হবে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ব্যাপক সমর্থন ও ম্যান্ডেন্ট নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

৭. সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আর বিলম্ব সমীচীন নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের ব্যবস্থা করা- যাতে করে সুপারিশগুলো কার্যকর করতে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর নৈতিক ও আইনগত চাপ থাকে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী জাতীয় সংসদের দ্বৈত ভূমিকা কাম্য- যারা একই সাথে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সভা ও নিয়মিত জাতীয় সংসদের ভূমিকা পালন করবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিষদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে।

সংস্কার কমিশন ও ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক বৈঠক ও আলোচনার বিষয়বস্তু গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়- রাজনৈতিক এলিটরা জনগণের ম্যান্ডেটকে সাময়িক স্বস্তি হিসেবে দেখবেন, নাকি চিরস্থায়ী গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন। এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য- যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি শুধু নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে এবং সংস্কার বাস্তবায়ন না করে, তাহলে এর মাশুল তাদের দিতে হবে।’ তবে আশার দিক হলো- রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্নমত থাকা সত্তে¡ও অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আলোচনায় অংশ নিয়েছে ও নিজেদের দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছে; এখন বল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কোর্টে। অতএব, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জুলাই চেতনার বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে কমিশনে আলোচিত সবগুলো ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান জানান দিতে হবে- এটিই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : প্রেসিডেন্ট, সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ বাংলাদেশ (সিপিএসবি) ও সেন্টার ফর সিভিলাইজেশনাল ডায়ালগ

বাংলাদেশ (সিসিডিবি)