শিক্ষক, আমি শ্রেষ্ঠ সবার

শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা এবং সমাজ ও দেশকে চেনা। নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিধির মধ্যে দায়বদ্ধতা ও দায়বোধ নিয়ে বড় হওয়া। চিন্তার পরিধি বাড়ানো। জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হওয়া। মেধার পরিপুষ্টি সাধন করে নিজেকে দেশের যোগ্য ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। যার মাধ্যমে একটি সৃজনশীল সমাজ ও জাতি গড়ে উঠতে পারে, গড়ে উঠতে পারে সমৃদ্ধ জাতি ও দেশ। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে কর্মযোগী জনগোষ্ঠী, ঐতিহ্যমণ্ডিত জীবনাচার, মানবিক মূল্যবোধে সিঞ্চিত ও উজ্জীবিত জীবনী শক্তিসম্পন্ন জাতি গড়তে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

গভীর দেশপ্রেমের আলোয় দায়বদ্ধ নাগরিক কখনোই জাতির অমঙ্গল করতে পারে না। পারে না দেশের সম্পদ পাচার করে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে। তারা জাতির অগ্রসৈনিক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে গৌরববোধ করেন। নিজেকে অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ করার সাথে সাথে নিজের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির চেতনায় কাজ করতে উৎসাহী হন।

শিক্ষা মানুষকে নৈতিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নৈতিক মূল্যবোধে দেহ ও আত্মার পরিপুষ্টি সাধন করে। মোটকথা, শারীরিক ও মানসিক চেতনার উন্নয়ন, দায়বোধ ও দেশপ্রেমের চেতনায় জাতিসত্তার বিকাশ শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্য। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ভিত্তিতে সহযোগী মনোভাব গড়ে ওঠা সম্ভব শুধু সুষ্ঠু শিক্ষার মাধ্যমে। সাথে সাথে পারস্পরিক কল্যাণকামিতা, স্বাস্থ্যসচেতনতা, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সৃষ্টিও শিক্ষার উদ্দেশ্য। সমৃদ্ধ আলোকিত নৈতিক চেতনাবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশপ্রেম ও একক জাতিসত্তার বিকাশের জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা।

এ ধরনের জাতি গঠনে শিক্ষকই হচ্ছেন মূল নির্ধারক। তারা শিক্ষার্থীদের ভেতর নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটান। চেতনার সঞ্চার করেন জাতিসত্তার ধারণা, চেতনা, দায় ও দায়িত্ববোধের। জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টির মাধ্যমে সুনাগরিক তৈরি করেন। একটি উন্নত ও প্রগতিশীল জাতি তৈরির ক্ষেত্রে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করেন। শিক্ষার্থীদের মানসিকতা এবং শৃঙ্খলাবোধ তৈরির, সার্বিক মূল্যবোধ ও জাতিসত্তাবোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই মূল হাতিয়ার। তাদের নিরলস শিক্ষাদান, সহজ-সরল ও আদর্শিক জীবনাচার শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে আদর্শ জীবনের প্রতি। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শুধু ভালো মানুষই হতে শেখান না পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন; যারা দেশ ও জাতির গণ্ডি পেরিয়ে সমস্ত মানবজাতিকে নেতৃত্ব দেন, আলোর পথ দেখান। একজন আদর্শ শিক্ষক ছাড়া জাতির সার্বিক উন্নতি এবং দিকনির্দেশনা পাওয়া কঠিন।

শিক্ষাঙ্গনে শিশুর প্রথম পদার্পণের দিন থেকে তার মধ্যে বিকাশমান সততা, মানবিকতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবিক মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা ও জ্ঞানচর্চার অভ্যাসের সাথে সাথে সৃষ্টি, বিশ্ব রহস্য, জীবনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য অনুধাবনের ক্ষমতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ এবং জাতি গঠনের মূল ভিত্তি তৈরির মহান দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষক। যারা দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেন তারাও একদিন একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের কাছেই জীবনের পাঠ নিয়েছেন। তাদের জীবনের মূল ভিত্তি তৈরির মৌলিক কারিগর হচ্ছেন শিক্ষকরা।

আল্লাহ তায়ালা শিক্ষকদের বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলামী জীবনাচারে শিক্ষকরা বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র। মহানবী মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘যাদের কাছ থেকে তোমরা জ্ঞানার্জন করো তাদের সম্মান করো।’ পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসে, চেতনায় শিক্ষককে দেয়া হয়েছে যথাযোগ্য মার্যাদা। ইউনেস্কো ও আইএলও শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা রক্ষা সনদ প্রণয়ন করে শিক্ষকতাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে, সমাজে তাদের অবদানের মূল্যায়ন করেছে।

আমাদের দেশে শিক্ষকের অবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক। পাশ্চাত্য সভ্যতার পটভ‚মিতে শিক্ষকতাকে যখন নাগরিক জীবনে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে, শ্রদ্ধাবোধে মণ্ডিত করা হয়েছে; তখন আমাদের দেশে আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজকে অবহেলার পাত্রে পরিণত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ মেধাবীরা ক্রমেই এ পেশায় আসতে উৎসাহ হারাচ্ছে। ক্ষমতার বিস্তৃত বলয়, আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার জন্য মেধাবীরা ঝুঁকে পড়ছে বিসিএস নামক সোনার হরিণের দিকে। মাত্র ক’দিন আগে অনুষ্ঠিত বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার চিত্র দেখলে এর সত্যতা প্রতিভাত হয়। দুঃখে, ক্ষোভে, লজ্জায়, গ্লানিবোধে মাথা নিচু হয়ে আসে যখন দেখা যায়, মানুষ গড়ার কারিগরদের স্ট্যাটাসের জন্য। যখন দেখি স্বাভাবিক জীবন যাপনের নিশ্চয়তার জন্য শিক্ষকদেরকে তাদেরই এক সময়ের ছাত্রদের কাছে ধরনা দিতে হয়, পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হয়, পদদলিত হতে হয়।

অবস্থা যাই হোক না কেন, শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মান, মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করার অনুরোধ জানাই। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী যেন গর্বভরে আত্মবিশ্বাসে বলতে পারেন, ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার’।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

[email protected]