হুমকির মুখে শিক্ষা

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কথাটি একসময় আপ্তবাক্য হিসেবে গণ্য হলেও এখন নিছকই বাত কি বাত! এই মেরুদণ্ড যেন দুর্বল হয়ে ধসে পড়ে, তেমনি আয়োজন দেখা যাচ্ছে চারদিকে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আদর্শ ও যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী। প্রয়োজন ভৌত অবকাঠামো। মূলত সব অভিভাবকই নিজ নিজ সন্তানকে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখেন, যে স্বপ্ন রচনা করেন; তার আনুষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরির মহান দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত থাকেন। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরির দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরাই। নিখাদ দেশপ্রেম, আদর্শ চরিত্র সংবলিত ভবিষ্যৎ নাগরিক ও নেতৃত্ব বিকশিত হয় শিক্ষকদের হাত ধরেই। অনাগত ভবিষ্যতেও তারা এই দায়িত্ব পালন করে যাবেন নিঃসন্দেহে।

শিক্ষকরাই শিশুদের স্বপ্ন দেখতে শেখান। ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন শিশুর মনে এঁকে দেন। তাদের হাতে ধীরে ধীরে ডানা মেলতে থাকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। প্রস্ফুটিত হতে থাকে ভবিষ্যতের চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক-ব্যারিস্টার এবং দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য আমলা শ্রেণী। বিচার বিভাগ, আইনসভা ও জনপ্রশাসন চালানোর মাধ্যমে দেশকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয় জনশক্তি তৈরি হয় শিক্ষকের হাতে। এ জন্য শিক্ষকদের বলা হয় দেশ গড়ার কারিগর।

একজন কারিগর যেমন তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় পরম মমতায় এক টুকরো কাঠকে কারুকাজশোভিত শিল্পকর্মে পরিণত করেন, তেমনি একজন শিক্ষক একটি অবোধ, মাসুম শিশুকে পরম মমতায়-ভবিষ্যতের দেশের একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করেন মৌলিক মানবীয় গুণাবলির সমন্বয়ে। মানুষ তৈরির এই পর্যায়ে কোনো অসম্পূর্ণতা থাকলে তার হাতে মানুষ হয়তো তৈরি হবে, সুনাগরিক নয়। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে মা-বাবার মতোই দেখে থাকে, শ্রদ্ধা করে। অনুকরণপ্রিয় শিশুমন অবচেতনে তার প্রিয় শিক্ষকের আদর্শই গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার চেয়ে একজন শিক্ষক শিশুকে প্রভাবিত করেন অনেক বেশি।

সবারই ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অনেক চাহিদা আছে, অসম্পূর্ণতা আছে, এটি অস্বীকার করা যায় না। শিক্ষকদের জীবনেও আছে। এই অসুবিধাগুলো দূরীকরণের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথ ও উপায় রয়েছে। তাদের জীবনের কষ্টগুলোকে, অসম্পূর্ণতাগুলো আমরা স্বীকার করি। তাদের ব্যথায় আমরা সবাই সহানুভ‚তিশীল। তাদের কষ্ট ও বেদনায় সহমর্মী। কিন্তু পরীক্ষার আগ মুহূর্তে শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে পরীক্ষা বন্ধ করে কোটি কোটি শিশুর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়ে শিক্ষকদের এভাবে রাস্তায় নেমে আসার কোনো নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনিতেই চব্বিশের আন্দোলনে শিক্ষায় অপরিমেয় ক্ষতি, স্বল্প পাঠনের সিলেবাসে পরীক্ষা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রভ‚ত ক্ষতি করেছে; তার ওপর শিক্ষকদের এহেন আন্দোলনের যৌক্তিকতা মেনে নেয়া যায় না।

পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে এহেন কর্মপন্থা প্রায় দুই কোটি ছাত্র-ছাত্রীর জীবন এক দিকে যেমন অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে, অন্য দিকে এতে দায়িত্বহীনতার দিকটি খোলামেলাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এর ফলে সাধারণ জাতীয় সিলেবাসের ছাত্র-ছাত্রীরাও উৎসাহিত হয়ে উঠবে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে। এতে স্বজাতীয় সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা হারিয়ে যেতে বাধ্য। এ দেশের জাতিসত্তাকে ভুলে গিয়ে তারা এক ভিন্ন চেতনার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। শিক্ষকদের এহেন কর্মকাণ্ড তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ও মমত্বকে হারিয়ে ফেলবে নিঃসন্দেহে। একই সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যেভাবে সবাই নিজ দায়িত্বে ফেলে ‘চল সখী যমুনায় যাই’ ভ‚মিকায় নেমেছে, তাতে মনে হয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেন স্বাভাবিক কোনো কাজকর্ম করতে না পারে এ জন্য সরকারকে ব্যস্ত রাখাই এসবের উদ্দেশ্য। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানও এ ব্যাপারে অস্পষ্ট। তাদের ভাবখানা যেন, যত কিছু দেনা-পাওনা এই সরকারই সমাধান করে যাক। এতে ক্ষমতা নেয়ার পর দায়িত্ব নিতে হবে না।

প্রায় দুই কোটি ছাত্র-ছাত্রীকে জিম্মি করে শিক্ষকরা মাঠে নেমেছেন শুধু নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য। নির্বাচিত সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নন তারা। স্কুলে শিক্ষার পরিবেশের অভাব, শিক্ষা উপকরণের অভাব, এসব নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ শোনা যায় না। এ ব্যাপারে জাতীয় নেতাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও বাস্তবায়নের রোডম্যাপ থাকা জরুরি, যেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।

এটি সত্য যে, আন্দোলনরত শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ভরসা করতে না পারার কারণে এই আন্দোলনে নেমেছেন। নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে দরকষাকষিতে নেমেছেন। এটি জাতীয় নেতাদের প্রতি তাদের এক ধরনের অনাস্থারই প্রকাশ বলা যায়। জাতীয় নেতাদের ব্যাপারটি ভেবে দেখা উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জিম্মি করে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত করার চেষ্টা শুরুতেই কঠোরভাবে দমন করা উচিত। স্মরণীয়, এসব শিক্ষকের অধিকাংশই ফ্যাসিস্ট সরকারের কার্যকালে নিয়োগপ্রাপ্ত তাদের দলীয় ক্যাডার। প্রয়োজনে যথাযথভাবে তাদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া যাচাই করা যেতে পারে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

[email protected]