১৯৭৪ সাল। ব্রিটেনে সাধারণ (হাউজ অব কমন্স) নির্বাচন সামনে। মাঠে টোরি (কনজারভেটিভ পার্টি) এবং হুইগ (লিবারাল পার্র্টি) হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে। জেমস কোর্টে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তখন সৈয়দ আবদুস সুলতান। তার কাছে দ্য টাইমসের সিনিয়র সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নিতে এসে জানতে চাইলেন, মান্যবর, আপনি কোন্ পক্ষে- লেবার না কনজারভেটিভ? পেশাদার না হয়েও প্রাজ্ঞ কূটনীতিকের মতো সৈয়দ সুলতান বললেন, ‘আই অ্যাম আফটার ব্রিটেন’। রাষ্ট্রদূত বিচক্ষণ ছিলেন যে, কোনো পার্টির পক্ষাবলম্বনের পরিবর্তে গোটা দেশ ও জাতির পক্ষ নেয়াই যুক্তিযুক্ত; তাতে সুসম্পর্কের দীপ্তি ছড়ায়, সৌহার্দ্য বাড়ায়।
এ সূত্র ধরেই বলা যায়, ‘জাতীয় সংহতি’র সরোবরেই সাফল্যের শাপলা প্রস্ফুটিত হয়, পারস্পরিক সমঝোতায় ঐকমত্যের যে ওজস্বিতা বাড়ে তা মতানৈক্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার মাসুল গুনতে গুনতে নিঃশেষ হয় জাতির আত্মশক্তি। সমন্বিত শক্তি অর্জন ও বিকাশের জন্য যে প্রতিযোগিতা সেখানে পক্ষ বিপক্ষ (যেমন-ব্রিটেনে টোরি আর হুইগ, যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান) থাকবে, সেটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি অর্জনের জন্য, বিকাশের জন্য, জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল বা বিভক্ত করার কাজে নয়। জাতীয় ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে উভয় পক্ষেরই ক্ষতি। সুতরাং সে প্রয়াস প্রচেষ্টার দ্বারা জাতীয় ঐক্যের ধারণায় চেতনা পক্ষ বিপক্ষের সর্বনাশা দ্বিধাবিভক্ত হওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। স্থানকালপাত্র ভেদে যে দেশ ও জাতিতে যতবড় সর্বনাশ সাধিত হয়েছে তার পেছনে ছিল অনৈক্যের সংক্রামিত ভাইরাস, যা প্রতিরোধের অবর্তমানে ক্রিয়াশীল থেকে গোটা জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
ভারতের মাটিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঠাঁই হয়েছিল এ দেশীয় নবাব ও রাজন্যবর্গের মধ্যেকার আন্তঃকলহের সুযোগ নিয়ে। আবার এ দেশ ছাড়ার সময় ভারতে ব্রিটিশ সরকার তাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল ভাইরাসে আক্রান্ত ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ চেতনার কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়ে যায় ভারতবর্ষের তিন প্রধান অঞ্চল- সম্পদ ও সৌন্দর্যের আধার, অকুতোভয় দেশ ও জাতি পাঞ্জাব, বাংলা আর কাশ্মিরকে দ্বিখণ্ডিত করে দীর্ঘস্থায়ী আন্তঃবিবাদ বাড়ানোর বিবরে রেখে যায়। ১৯৪৫ সালে ভারত বিভাগের যে নীলনকশা এঁকেছিলেন উইনস্টন চার্চিল (১৮৭৪-১৯৬৫), র্যাডক্লিফ সাহেব ১৯৪৭ সালে তার চৌহদ্দি, খতিয়ান পরচা জারি করেন মাত্র। ক্রমশ গবেষণায় এটা বেরিয়ে আসছে যে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, নিকৃষ্ট কূটচালে দক্ষ চার্চিল সাহেবকে ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সময় নোবেল কমিটি যা বলেছিলেন তা কতটা অসার ছিল। নোবেল কমিটির সাইটেশনে ছিল তাকে সাহিত্যে নোবেল খেতাব দেয়া হয়, Ôfor his mastery of historical and biographical description as well as for brilliant oratory in defending exalted human values.’ ইতিহাসের বিবরণ ও ব্যক্তিত্বের জীবনচরিত রচনায় তার মুনশিয়ানা এবং মানবিক মূল্যবোধের উচ্চ আকাক্সক্ষার সপক্ষে তার যে বাগ্মিতা তা সময়ের অবসরে অসার প্রমাণিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের ১০ মে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত Churchill’s unmerited Nobel for Literature শীর্ষক নিবন্ধে Bruce Ross- Smith উল্লেখ করেন, His hatred of the peoples of the Indian subcontinent is a matter of record. As historian David Reynolds has detailed, the six volumes of Churchills history of the second world war were built upon selective memory forged out of ego, not least the “great man’s” fleeing memory of the 1943 bengal famine, in which more than 3.5 million people perished, to large extent as a direct consequence of Churchill’s policies and actions’.
ইতোমধ্যে ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিনিচয়ের মধ্যে বিভক্তিকরণের স্বরূপ ও পরিনাম। ভারতবর্ষের বিভক্তিকরণের রাজনৈতিক পরিনাম যা-ই দৃশ্যমান হোক না কেন এর মানবিক বিপর্যয়ের কান্না থামেনি এখনো বরং বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার উদগ্র বাসনাবশত ইতিহাসের খলনায়করা লক্ষ কোটি মানুষকে অবদমিত করতে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে, চাটুকরের ভাষায় যা ‘দুরন্ত সাহসের পরিচয়’। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রকারান্তরে কিছু তারা, সব মানুষের আত্মত্যাগকে অবমূল্যায়ন করতেই পক্ষ-বিপক্ষের বিভেদের দেয়ালের ভেতর আশ্রয় নেয় নিরাপদভাবে নিজেকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না কারো, ইতবসরে মানবিক মূল্যবোধের সমূহ ক্ষতি যা তা হয়ে যায়। সে ক্ষতি আর পূরণ হয় না।
বিশ্বের মানচিত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী আমজনতার আজন্মলালিত স্বপ্ন ও সাধ, আত্মমর্যাদা বিকাশের অধিকার লাভের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত সুদীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অনন্য ঐক্য গঠনের মাধ্যমে আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবার, স্বাধীন আশায় পথ চলার এবং আপন বুদ্ধিমতে চলবার ক্ষমতা লাভ করে।
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু তা কেউ কাউকে এমনিতে দেয় না, কিংবা তা সহজপ্রাপ্যও, তা আদায় করে নিতে হয়। আবার অর্জন করার মতো সেই স্বাধীনতা রক্ষা করাও কঠিন। কেননা স্বাধীনতার শত্রুর অভাব নেই। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচতে চায় কে? আবার সুযোগ পেলে অন্যকে নিজের অধীনে রাখতে চায় না কে? বেশি দামে কেনা কম দামে স্বাধীনতা বিক্রির নজির যে নেই তা তো নয়। আপাত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের জনগণ শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, ইতিহাসের বহু পটপরিবর্তনে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে তারা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করে তাদের আজন্মলালিত স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে অশেষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জন তার যথা বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের যৌক্তিকতা ভিন্ন অর্থেই পর্যবসিত হতে পারে।
ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষে এ দেশে আগমন ঘটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পারি দিয়ে আসা ইংরেজদের। তাদের আগে মগ ও পর্তুগিজরাও অবশ্য এসেছিল এ দেশে। প্রতিদ্ব›দ্বী বিবেচনায় এরা পরস্পরের শত্র“ভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। অত্যাচারী মগ ও পর্তুগিজদের দমনে ব্যর্থপ্রায় সমকালীন শাসকবর্গের সাহায্যে এগিয়ে আসে নৌযুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী ইংরাজ বণিক। ক্রমে তারা অনুগ্রহভাজন হয়ে ওঠে সমকালীন বিলাসপ্রিয় উদাসীন শাসকবর্গের আর সেই উদাসীনতার সুযোগেই রাজপ্রাসাদ-অভ্যন্তরে কূটনৈতিক প্রবেশলাভ ঘটে ইংরেজদের। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁকে হাত করে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে। পরবর্তীতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বাংলা বিহার উড়িষ্যার এবং ক্রমে ভারতবর্ষের প্রায় গোটা অঞ্চলের।
মীর কাসিম খান, টিপু সুলতান প্রমুখ সমকালীন স্বাধীনচেতা রাজন্যবর্গ স্থানীয়ভাবে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চাঙ্গা করেও ব্যর্থ হন- বলাবাহুল্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু সেখান থেকেই। বিদেশ বিভূঁইয়ে সাহায্য ও সহানুভূতি পাওয়ার জন্য সম্প্রদায়গত বিভাজন সৃষ্টি করতে আনুকূল্য প্রদর্শনার্থে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তন করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই নীতির ফলে এ দেশীয় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে পৃথক পৃথক অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয় এবং ব্রিটিশ শাসকের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বৃহৎ দু’টি সম্প্রদায়। হিন্দু জমিদাররা ইংরেজদের আনুগত্য পেতে থাকে, পক্ষান্তরে রাজ্য হারিয়ে মনমরা মুসলমান সম্প্রদায় (যার অধিকাংশ পরিণত হয় রায়ত কৃষকে) দিন দিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেও ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ বেশ কাজ করে, আরো দ্বিধাবিভক্তিতে আচ্ছন্ন হয় উভয় সম্প্রদায়। এরপর স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখের শিক্ষা ও সমাজসংস্কারবাদী কর্মপ্রচেষ্টার ফলে মুসলমান সম্প্রদায় ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষার আলোক পেয়ে ক্রমান্বয়ে চক্ষুষ্মান হতে থাকে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস। ভারত বর্ষের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম হিসেবে হিন্দুদের পরিচালিত ও ভাবাদর্শ নির্মাণকারী এই প্লাটফর্ম স্বসম্প্রদায়ের সত্যই কোনো কল্যাণে আসবে না দেখে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম লীগ’ নামে আরেকটি রাজনৈতিক সংগঠন।
বৃহৎ ভারতবর্ষের ব্যাপারে না গিয়ে শুধু এই বাংলাদেশ বিষয়ে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে প্রধান ঘটনা স্থপতি হিসেবে কাজ করেছে তা হলো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এমন দ্বিধাবিভক্তির প্রেক্ষাপটে প্রতিদ্ব›দ্বী মনোভাব থেকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পূর্ববাংলার নেতা শের-ই-বাংলা ‘উপমহাদেশের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে ‘রাষ্ট্রসমূহ’ গঠনের প্রস্তাব করেন। এতদসত্তে¡ও ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনে ‘রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রস্তাবকে’ উপচিয়ে, বিশ্বাসঘাতকতায়, পূর্ব বঙ্গবাসীদের পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সহস্রাধিক মাইল ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে একীভূত হয় এবং পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এটা যে পূর্ববঙ্গের প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি ছিল না বরং উপনিবেশবাদের হস্তান্তর মাত্র তা পূর্ববঙ্গবাসী ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করতে পারেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়, যখন বোঝা যায় তাদের মাতৃভাষা ও আবহমান সংস্কৃতির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত আসছে। তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং তাদের বিভ্রান্তি কেটে যায়।
তারা বুঝতে পারে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয়নি। তারা সচেতনতার পরিচয় দেয় ১৯৫৪-এর নির্বাচনে, ১৯৬২’র ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে। এতদিনে পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্তবাদী চক্রের আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়। পূর্বপাকিস্তানকে একসময় তারা ব্যবহার করেছিল ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের স্বার্থে, সেই আন্দোলনের অন্যতম উদগাতা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিরা। একইভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরোধও তেমনি তাদের প্রথমে স্বাধিকার এবং পরে স্বাধীনতার আন্দোলনে উজ্জীবিত করে। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ। সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর তার বিজয় সুনিশ্চিত হয়। তাই এই বিজয় দিবস ৯ মাসের কিংবা ২৫ বছরের সংগ্রামের বিজয় নয় পূর্ববঙ্গবাসীর স্বাধীন মনোবৃত্তির, সুদীর্ঘকালের শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষার বিজয়। এটি ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনের ঘোষণা বাস্তবায়ন এবং সুদীর্ঘকালের ‘বিশ্বাসঘাতকা ও বিভ্রান্তির’ অবসানের পর বিজয়।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান



