এম এ মাসুম
১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ২৪ শতাংশ স্থানীয় শেয়ার ও ৭৬ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের মিশ্রণে। দেশের প্রচলিত সব ব্যাংকব্যবস্থার মধ্যে ইসলামী ব্যাংককে নতুন করে করপোরেট কাঠামোর আওতায় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কর্মী নিয়োগ, বিনিয়োগ প্রদান, অভ্যন্তরীণ পরিচালনা এবং একটি স্বাধীন শরিয়াহ বোর্ড গঠন করা হয়। ব্যাংকটি ইসলামী শরিয়াহর বিধিমতো অর্থায়নের নানা মডেল অনুসরণ করে দেশ-বিদেশে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ অবৈধভাবে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সরিয়ে দেয়। একই সাথে ব্যাংকটিতে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। ফলে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার হোল্ডিং হ্রাস পেয়ে মাত্র ১৩ শতাংশে নেমে আসে। এস আলম গ্রুপের হাতে থাকা ৮২ শতাংশ শেয়ারের মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালন ও নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে, যা ব্যাংকের স্বাধীনতা, সুশাসন তথা জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস ভেঙে পড়ে। এ ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি (আইবিবিপিএলসি) কাজ করে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক দেশের প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। গত ৪৪ বছর ধরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রম ও আন্তরিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে এ ব্যাংক দেশের সর্বস্তরের জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে সচেষ্টা আছে। কিন্তু ২০১৬ থেকে আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ব্যাংকটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্বৃত্তের হাতে চলে যায়। উল্লিখিত সময়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাংকটি আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিগত সরকারের সময়ে ইসলামী ব্যাংক ঘিরে সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের ফলে যে আস্থার ফাটল তৈরি হয়েছিল, নতুন সরকারের অধীনে আবার গ্রাহকের বিশ্বাসের ভিত দৃঢ় হচ্ছে। এ প্রবণতা শুধু একটি ব্যাংকের সাফল্যগাথা নয়; বরং ব্যাংকব্যবস্থায় আস্থার মানচিত্রে নতুন এক মোড়। আগের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু শরিয়াহ ব্যাংক দখলে নিয়ে অর্থ পাচারের যে মহোৎসব শুরু হয়েছিল সরকার বদলের পর সে অনিয়ম বন্ধ হয়েছে, আস্থা ফিরেছে। নানা ধরনের অপপ্রচার, গুজব ও সাবেক দখলদারদের প্রেতাত্মারা ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র করলেও এদেশের সাধারণ জনগণ এর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন, ভালোবাসা জানিয়েছেন ও অবিচল আস্থা রেখেছেন। বিগত সরকারের সময় ব্যাংকটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে নগদ জমা সংরক্ষণ অনুপাত (সিআরআর) হিসাবে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি ছিল যা বর্তমানে ইতিবাচক অবস্থায় ফিরেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব বকেয়া পরিশোধ করে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
গত সাড়ে সাত মাসে (২৭ আগস্ট ২০২৪ থেকে ১৬ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত) ব্যাংকটিতে নতুন গ্রাহক বেড়েছে ১৮ লাখ ২৬ হাজার ৬৫২ জন। নতুন আমানত এসেছে ২৪ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতে যখন গতিহীনতা বিরাজমান, তখন এই প্রবৃদ্ধি শুধু ব্যতিক্রম নয়; বরং নজিরবিহীন। হিসাব খুলেছে সবচেয়ে বেশি মুদারাবা টার্ম ডিপোজিটে তিন লাখ ৭০ হাজার ৭৮২টি, নতুন এমটিডিআরএ অ্যাকাউন্টে জমেছে ১৭ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। মুদারাবা সঞ্চয়ী, স্পেশাল সেভিংস, হজ, বিয়ে ও শিক্ষার্থী হিসাবেও জমা পড়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান নেটওয়ার্ক ও কার্যক্রম অনেক বিস্তৃত হয়েছে। দেশে ব্যাংকটির ৪০০টি শাখা, ২৬৫ উপশাখা, দুই হাজার ৭৮৩টি এজেন্ট আউটলেট এবং তিন হাজার ৪০টি এটিএম ও সিআরএম বুথ রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংকের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি বছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট চালানো ৩০টি ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করেছে ৪৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক এককভাবে ২১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে শীর্ষে অবস্থান করছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির নতুন আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে এক লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকার আমানতের মাইলফলক অতিক্রম করে ব্যাংক খাতে শীর্ষে অবস্থান করছে। ব্যাংকটিতে গত এক বছরে ৩২ লাখ নতুন গ্রাহকের আগমন ঘটায় মোট আড়াই কোটি গ্রাহকের এক বিশাল পরিবারে পরিণত হয়েছে। সুশাসন ও গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসায় ব্যাংক এই সাফল্য অর্জন করেছে।
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার অন্যতম নায়ক প্রবাসী কর্মীরা, যারা বৈদেশিক আয়ের দ্বিতীয় শীর্ষ উৎস। আর প্রবাসীদের আস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠানের নাম ইসলামী ব্যাংক। সরকার পরিবর্তনের পর প্রবাসীরা আবার সেই আস্থা ও ভালোবাসার প্রতিফলন দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ১১ মাসে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে দুই হাজার ৯৫৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক এককভাবে ৫৫৩ কোটি টাকা রেমিট্যান্স আহরণ করে ব্যাংক খাতে শীর্ষে অবস্থান করছে।
ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রেও ব্যাংকটি এগিয়ে। শুধু সেলফিন অ্যাপের ব্যবহারকারী ৪৭ লাখ ছাড়িয়েছে। ব্যাংকটি ডিজিটাল লেনদেন ও তথ্য সুরক্ষায় উন্নত ও বহুমাত্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে। প্রতিটি লেনদেন সর্বাধুনিক এনক্রিপশন প্রযুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত রাখছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানস¤পন্ন ডাটা সেন্টার, নিরবচ্ছিন্ন ব্যাকআপ ব্যবস্থা এবং কর্মীদের নিয়মিত সাইবার সচেতনতা প্রশিক্ষণ নিরাপত্তা কাঠামো আরো মজবুত করেছে। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো আক্রমণ যেমন- ফিশিং, র্যানসমওয়্যার ও সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আক্রমণ প্রতিরোধে আধুনিক ও বহুমাত্রিক নিরাপত্তা পদক্ষেপ করেছে।
মূলত অর্থের ‘ড্রেনেজ’ বন্ধ হওয়ার পর গত বছরের অক্টোবর থেকে ব্যাংকের অবস্থা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি। মূলত এস আলম গ্রুপ ব্যাংকের বোর্ড নিয়ন্ত্রণে এনে নিজেদের নামে ও প্রক্সি বা ছায়া কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল ঋণ নেয়, যার বড় অংশ পরবর্তীতে খেলাপি হয়। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা ও কর্মকর্তা-কর্মাচরীরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিগত সময়ের বেপরোয়া লুণ্ঠনে সৃষ্ট ক্ষতি ব্যাংকটির উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এস আলম গ্রুপের হাতে থাকা সব শেয়ারের মালিকানা প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করছেন। আশা করি, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করবে। প্রকৃত মালিকদের হাতে ব্যাংকের মালিকানা ফিরিয়ে দিলে ইসলামী ব্যাংক দ্রুত সময়ের মধ্যে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। সেই সাথে বিশ্বের অন্যতম ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়। এর ফলে একটি কল্যাণমুখী ব্যাংক হিসেবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, পিএলসি।
লেখক : ব্যাংকার


