অধ্যাপক ড. শেখ নাজমুল হুদা ও ড. শেরশাহ সৈয়দ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০-১৫ শতাংশ গর্ভবতীর বেলায় সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রয়োজন হতে পারে। তাহলে ৮৫-৯০ শতাংশ গর্ভবতীর জন্য স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্মদান করা স্বাভাবিক। বিস্ময়কর হলো, বাংলাদেশের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে এখন প্রায় ৯০ শতাংশ সন্তান জন্মগ্রহণ করে সিজারের মাধ্যমে। প্রাতিষ্ঠানিক সিজারিয়ান সেকশনের এ হার সম্ভবত পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে যে খুব অল্পসংখ্যক সন্তান স্বাভাবিক প্রসবে হয়ে থাকে এর পেছনে কারণ হলো- ওই শিশুগুলো ডাক্তার অস্ত্রোপচার কক্ষে প্রবেশের আগে স্বাভাবিক জন্মগ্রহণ করে বলে। তখন চিকিৎসকদের করার আর কিছু থাকে না।
বাংলাদেশে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের এত উচ্চ হারের কারণ কী? গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য কারণগুলো প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা এখন সময়ের দাবি।
প্রশ্ন হলো- ৯০ শতাংশ গর্ভবতী যাদের স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়ার কথা তাদের জন্য সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান কি স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় নিরাপদ? প্রশ্নটি অনেক গর্ভবতীর ও তাদের পরিবারের। মেডিক্যাল কলেজের গণ্ডি পেরোনোর ৩০ বছর পরে সে দিন একটি মেডিক্যাল কলেজের এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। দেখলাম, মেডিক্যাল কলেজের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সময় মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৫-২০ শতাংশের মতো। এখন তা কোনো কোনো মেডিক্যাল কলেজে ৬০-৭০ শতাংশ। পঞ্চম বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রী এবং নতুন ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলাম, যাদের প্রসবের মাধ্যমে ডেলিভারি সম্ভব তাদের জন্য সিজার কি অধিকতর নিরাপদ; মা ও শিশুর মৃত্যুহার ও বিভিন্ন অসুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে। খেয়াল করলাম, অনেক চিকিৎসক এবং চিকিৎসাশিক্ষার্থী এ প্রশ্নে বেশ দ্বিধান্বিত। তাদের একটি বড় অংশ ভাবেন, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজার অধিকতর নিরাপদ।
১০-১৫ শতাংশ গর্ভবতীর সিজার প্রয়োজন হয় মা ও শিশুর জীবন এবং স্বাস্থ্য রক্ষায়। সে বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। তবে এর বাইরে যে ব্যাপক সংখ্যায় সিজার হয়ে থাকে তার সম্ভাব্য ফল নিয়ে অনেক গবেষণা আছে। এমন কিছু গবেষণার ফল তুলে ধরে আমি আজ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব- সিজার কি স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় নিরাপদ?
বিশ্বে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সিজার হয়ে থাকে সম্ভবত তুরস্কে। সেখানে মোট প্রসবের ৯৮ শতাংশ হয় হাসপাতালে বা ক্লিনিকে। মোট প্রসবের ৫৮ শতাংশ হয়ে থাকে সিজারের মাধ্যমে। সেই তুলনায় বাংলাদেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সন্তান জন্মদানের হার বর্তমানে ৫০ শতাংশ। বাকি ৫০ শতাংশ সন্তান জন্মগ্রহণ করে বাড়িতে। যে ৫০ শতাংশ সন্তান বাংলাদেশে হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করে তার মধ্যে সরকারি হাসপাতালের সিজারিয়ান সেকশনের হার প্রায় ৭৫ শতাংশ আর প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে সিজারিয়ান সেকশনের হার ৯০-১০০ শতাংশ। কোনো কোনো প্রাইভেট ক্লিনিক ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, সেখানে কোনো স্বাভাবিক প্রসব করানো হয় না।
সিজারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষস্থান ধরে রাখলেও উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মাতৃমৃত্যু হার কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাতৃমৃত্যু বরং পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে বেড়েছে। কেউ অবশ্য ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন মাতৃমৃত্যু হারের সেই বৃদ্ধিটা পরিসংখ্যানগতভাবে খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের নারী শিক্ষার অগ্রগতি, নারীদের কর্মে নিয়োগ ও আর্থসামাজিক অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃমৃত্যু হারের এ প্রবণতা ব্যাখ্যা করা যায় না। অনেকের মতে, সিজারের এ উচ্চহার বাংলাদেশে উচ্চ মাতৃমৃত্যুহারের একটি কারণ। কিছু গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০ শতাংশের বেশি সিজার হলে তা উচ্চ মাতৃমৃত্যুহারের নিয়ামক হতে পারে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের প্রাইভেট ক্লি¬নিকগুলোতে যেখানে এখন ৯০ শতাংশের বেশি সিজার হচ্ছে তারা এখন উচ্চ মাতৃমৃত্যু হারের একটি কারণ। সেভাবে বলা যায়, যেসব মায়ের সিজারের প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন ছিল না- তাদের মৃত্যুঝুঁকি সিজার সেকশনের বেলায় স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া যাদের একবার সিজার হয় পরবর্তী গর্ভধারণে তাদের মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বেশি হয়।
সিজারের পরে মহিলাদের জন্য স্থানচ্যুত গর্ভধারণ (একটেপিক প্রেগনেন্সি), গর্ভফুলের অস্বাভাবিক অবস্থান, মৃত সন্তান প্রসব, অকালে জন্মদান (প্রিটার্ম বার্থ) ও জরায়ু ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, এটি বহু গবেষণায় প্রমাণিত। সিজারে অনেক ওষুধ ও চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে, যা নবজাতকের মধ্যে একধরনের হরমোনগত, শারীরবৃত্তীয় ও চিকিৎসাজনিত প্রভাব সৃষ্টি করে, যার ফলে সিজারের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করা শিশুর পরবর্তী সময়ে অ্যালার্জি, অ্যাজমা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করা শিশুর শৈশবে মোটা হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে সিজারে মৃত্যু ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে থাকে। সিজারিয়ান অপারেশনের তাৎক্ষণিক ঝুঁকিগুলো সাধারণত সহজে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এ ঝুঁকিগুলোর সাথে তুলনা করে- স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির মাত্রাগুলো অনুমান করা যায়। সিজারের তাৎক্ষণিক জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে- রক্তক্ষরণ, জরায়ু ফেটে যাওয়া, অজ্ঞানজনিত জটিলতা, প্রসবজনিত শক, হৃদযন্ত্র থেমে যাওয়া (কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট) , তাৎক্ষণিক কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া (ভিনাস থর্মবোসিস), সংক্রমণ, সেলাই স্থানে জটিলতা ইত্যাদি। কানাডার মতো দেশে সন্তান প্রসবের তাৎক্ষণিক জটিলতা সিজারে ২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা স্বাভাবিকের তুলনায় তিন গুণ। দীর্ঘ মেয়াদে সিজারিয়ান অপারেশনে তলপেটে নাড়ি জড়িয়ে যাওয়া, ফিস্টুলা পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, ব্যথাযুক্ত ঋতুস্রাব, দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, যৌন বৈকল্য, বন্ধ্যত্ব, প্রস্রাব ও পায়খানা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, তলপেটে ব্যথা ইত্যাদির কারণ হয়ে থাকে।
সিজারের তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার বিষয়ে অনেক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গবেষণার ফল অনুযায়ী খুব দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, ১০-১৫ শতাংশ গর্ভবতীর জন্য সিজার প্রয়োজন শুধু সেই ১০-১৫ শতাংশের জন্য সিজার স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় নিরাপদ। বাকি যাদের স্বাভাবিক প্রসব করা সম্ভব তাদের জন্য সিজারিয়ান অপারেশন মা ও শিশুর প্রাণহানি এবং তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বহু সমস্যার কারণ।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৩ লাখের মতো সিজারিয়ান অপারেশন হয়ে থাকে। এর মধ্যে সম্ভবত ১০ লক্ষাধিক সিজার হয়ে থাকে, যাদের জন্য সিজার প্রয়োজন ছিল না। এসব মা ও তাদের শিশুরা প্রতি বছর বাংলাদেশে উচ্চ মৃত্যুঝুঁকি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন।
লেখকদ্বয় : চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি ও প্রাক্তন সভাপতি, অবস্টেট্রিক্যাল ও গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব পাকিস্তান