ধন্যবাদ জানাই পরিবেশ উপদেষ্টাকে। তিনি মধুপুরের শালবন রক্ষার কথা বলে দেশের মানুষকে সাহস জুগিয়েছেন। পরিবেশ প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনে যারা কাজ করেন তাদের উদ্দীপিত ও উজ্জীবিত করেছেন। একই সাথে মধুপুর শালবনের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথাও বলেছেন। শালবন শুধু প্রকৃতির অলঙ্কারই নয়; শালবন ধারণ করে আছে যুগের পর যুগ ধরে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা আমাদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক জীবনাচারের অংশ। ক্ষমতার অলিন্দ থেকে এভাবে প্রকৃতি, পরিবেশ, ঐতিহ্য ধরে রাখার চিন্তা-স্বতঃই জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করে পরিবেশ সংরক্ষণ ও সুরক্ষায়।
শুধু মধুপুরের শালবন নয়; সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ ধরনের শতবর্ষী বৃক্ষের বনভূমিগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে অবহেলায় অথবা বনখেকোদের লোলুপ থাবায়। সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে এসব বনাশ্রয়ী পশুপাখি জীবজন্তু তাদের প্রাকৃতিক আবাস হারিয়ে। আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, খাদ্যের খোঁজে বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে হানা দিয়েছে। আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর আগে এমনটি শোনা যায়নি। বনজঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি ও জীবজন্তুর খাবারের প্রাচুর্য থাকায় তাদের লোকালয়ে হানা দেয়ার কথা তখন শোনা যায়নি। এখন এক দিকে নির্বিচারে বনজঙ্গল ধ্বংস এবং শিকারিদের হাতে নিরন্তর পশুপাখি নিধনের ফলে বনাঞ্চল বিরানের সাথে সাথে আশঙ্কাজনকভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পশুপাখি ও জীবজন্তুর প্রজাতি ও বৈচিত্র্য। হুমকিতে পড়েছে এসব প্রাণিকুলের নিরাপত্তা। সচেতনতার অভাবে আমরা এভাবেই ধ্বংস করছি প্রকৃতি ও পরিবেশ, ধ্বংস করছি জীববৈচিত্র্য। অথচ এসব আমাদের সুস্থ জীবনযাপনের উপাদান। এদের পরিবেশ টিকে থাকলে টিকে থাকবে আমাদের জীবনের অভিযাত্রা।
আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অন্যতম পীঠস্থান সিলেটের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এর মধ্য দিয়েই গেছে রেললাইন, রয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা। প্রতি বছরই বিদ্যুতায়িত হয়ে এবং ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হচ্ছে এই বনের অধিবাসী জীববৈচিত্র্যের অধিবাসীরা। রেলের আওয়াজ ও গতির কম্পনে বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যত্যয় ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য। কালের বিবর্তনে পরিবেশের অভাবে তারা হারিয়ে যায় চিরতরে।
পার্বত্যাঞ্চলে বন পুড়িয়ে চাষের প্রচলন হাজার বছরের। ইদানীং বন ধ্বংস করে চা, তামাক ইত্যাদি চাষের কারণেও বন্য পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন। এ ক্ষেত্রে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের পাশে হাতিমারা চা বাগানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের চা বাগানের প্রয়োজনে গাছ কেটে আগুন দেয়ায় পুড়েছে হনুমান, মায়াহরিণ, বিপন্ন কাঠবিড়াল ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এ জন্য কাউকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। অথচ গত ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছেন, অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা যাবে না। গাছ কাটার আগে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলায় উপজেলাসংলগ্ন শালবন সঙ্কুুচিত হতে হতে কয়েক একরে এসে দাঁড়িয়েছে। একসময়ের গহিন জঙ্গল এখন খেলার মাঠ, চলাচলের সড়ক। মাঝে মাঝে বাড়িঘর। সবই ঘটেছে বন মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চোখের সামনে। হারিয়ে গেছে খোঁচাবাড়ী হাট থেকে ঠাকুরগাঁও বিজিবি এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত মূল্যবান সেগুন বন। বনের জমি দখল হতে হতে প্রস্থে কয়েক হাতে এসে দাঁড়িয়েছে জায়গায় জায়গায়। এখানেও সেগুনগাছসহ ভূমি দখল করে তৈরি হয়েছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও বিভিন্ন স্থাপনা। এর ভেতরেই সগৌরবে অবস্থান এবং অফিস করছেন বন অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
পরিবেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করা হয়েছে মাটির। ক্রমবর্ধমান খাবারের জোগান দিতে গিয়ে জমির গুণাগুণ বিচার না করেই বিভিন্ন ধরনের সারের অবাধ প্রয়োগে মাটি তার স্বকীয়তা হারিয়েছে, হারিয়েছে উর্বরাশক্তি ও স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। মাটিতে বসবাস করা ফড়িং, ব্যাঙ এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, কীটপতঙ্গ, পাখি হারিয়ে গেছে রাসায়নিক সারের বিষক্রিয়ায়। মাটির স্বাভাবিক উর্বরাশক্তির প্রাকৃতিক ইঞ্জিনিয়ার কেঁচো হারিয়ে গেছে। ব্যাঙের কোনো আবাস খুঁজে পাওয়া ভার। অথচ মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা পরিবেশ ও প্রকৃতির অন্যতম প্রধান সহায়ক। ইদানীং উন্নয়নের দোহাই দিয়ে, শিল্পায়নের প্রয়োজনে বনাঞ্চল উজাড় করা হচ্ছে। সাভার, চন্দ্রা, গাজীপুর, কালিয়াকৈর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এসব এলাকার বনভূমির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া এখন কষ্টকর। হাওরের কথা এখন কবিতা বা ছড়ার উপজীব্য। বাস্তবে খুঁজে পাওয়া ভার। সারা দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারটি বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। যারা হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অনুমোদন দিয়ে থাকেন তারা এসব ব্যাপারে আদৌ ওয়াকিবহাল কি না এটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। মাটির ওপর অত্যাচারে পুকুর, ডোবা, বিল, নদীর পানি শুকিয়ে হারিয়েছে পানির স্তর। ফলে কৃষিকাজসহ পানিনির্ভর অন্যান্য দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রমও আজ হুমকির মুখে। মাত্র ক’বছর আগেও ঢাকায় বিশেষ করে পুরান ঢাকা, মিরপুর, গুলশান, বনানী এলাকায় দেখা যেত ঝাঁকে ঝাঁকে বানর। গাছপালা এবং আহারের স্বল্পতায় তারা হারিয়ে গেছে। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপনের জন্য জরুরি প্রয়োজন সুস্থ প্রাকৃতিক পরিবেশ। এ ক্ষেত্রে এক দিকে যেমন দায় রয়েছে জনসাধারণের, তেমনি দায়িত্বের গুরুভার রয়েছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ওপর। উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও নাগরিক সচেতনতা নিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হবে কবে, কখন?
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ