ইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ বিক্ষোভ চলছে গত ২৫ আগস্ট থেকে। সংসদ সদস্যদের বিতর্কিত আবাসন ভাতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও খাদ্য ব্যয়বৃদ্ধি, গণহারে কর্মী ছাঁটাই, সম্পত্তি-কর বৃদ্ধি, পুলিশের হাতে মোটরসাইকেল ট্যাক্সিচালক আফফান কুরনিয়াওয়ানের মৃত্যু বিক্ষোভের মূল কারণ। অল্প সময়ের ভেতর জাকার্তা, বানদুং, সুরাবায়া, মাকাসার এবং ইয়োগিয়াকার্তাসহ ৫০টিরও বেশি শহরে বিক্ষোভ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। যে প্রাথমিক দাবি নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা এখন অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রশাসনিক সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন দাবি নিয়ে নতুন গোষ্ঠী আন্দোলনে শামিল হচ্ছে। চাকরিচ্যুত সবাইকে নিয়োগ, এমনকি রমজানের সময় ইফতারের ইনসেনটিভ বাড়ানোর দাবিও যোগ হয়েছে সর্বশেষ।
বিক্ষোভে প্রচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। সহিংসতায় কমপক্ষে আটজন মারা গেছে, শত শত আহত হয়েছে এবং তিন হাজারেরও বেশি লোক গ্রেফতার হয়েছে।
সমালোচকরা মনে করছেন এই সঙ্কট ২৮ কোটি মানুষের দেশে গভীর হতাশার প্রতিফলন, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ন্যায়সঙ্গত সুবিধায় রূপান্তরিত হয়নি এবং রাজনৈতিক অভিজাতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রাবোওকে ঘটনার হোতা বলে জনগণ মনে করছে।
প্রেসিডেন্টের পুরো নাম প্রাবোও সুবিয়ান্তো জোজোহাদিকুসুমো। ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর তিনি জোকো উইদোদোর স্থলাভিষিক্ত হন। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতি হন। প্রাবোও সুবিয়ান্তো বিয়ের সূত্রে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি সুহার্তোর পরিবারের আত্মীয়। তার এক পুত্রসন্তান রয়েছে, নাম দিদিত হেডিপ্রাসেটিও। তিনি সামরিক বাহিনীর একজন সাবেক জেনারেল। পূর্ব তিমুর এবং পশ্চিম পাপুয়ায় অভিযানে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেখানে সামরিক বাহিনী যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তবে প্রাবোওর বিরুদ্ধে কখনো মামলা না হলেও, এই অভিযোগে কিছু সময়ের জন্য তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর তিনি ব্যবসা ও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি দুইবার রাষ্ট্রপতি পদে ব্যর্থ হন এবং ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আছেন ১০ মাস হলো। নির্বাচিত হওয়ার আগে ওয়াদা করেছিলেন, সাধারণ ইন্দোনেশিয়ানদের জীবন মান উন্নয়ন করবেন। তিনি তা করতে পারেননি। ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতির সমস্ত স্তর পদ্ধতিগত ব্যাপক দুর্নীতি দ্বারা চালিত। তিনি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যেখানে ইন্দোনেশিয়ার আর্থিক পরিস্থিতি যতটা হওয়া উচিত ছিল তার চেয়ে বেশি অস্থিতিশীল হয়েছে। অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
চলমান বিক্ষোভ-প্রতিবাদকে সমালোচকরা তিনটি ডাইমেনশনে মিশ্রিত করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষোভ হিসাবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও যুব বেকারত্বের হার ১৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খাদ্য ও শিক্ষার মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং গণ-ছাঁটাই নাগরিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ২০২৬ সালের বাজেটে আঞ্চলিক তহবিল কাটছাঁটের মধ্যে পার্লামেন্ট সদস্যদের জন্য প্রস্তাবিত ৫০ মিলিয়ন রিঙ্গিত (প্রায় ৩,০৫৭ ডলার) মাসিক আবাসন ভাতা বৃদ্ধি ছিল-জাকার্তার ন্যূনতম মজুরির প্রায় দশগুণ- যা ২০২৬ সালের বাজেটে আঞ্চলিক তহবিল কাটছাঁট করা, যা স্থানীয় কর বাড়াতে বাধ্য করেছে। বাজেটে প্রতিরক্ষা ব্যয় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রপতি প্রাবোও সুবিয়ান্তোর বিনামূল্যে স্কুল খাবার কর্মসূচির জন্য তহবিল প্রায় দ্বিগুণ করে ২০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার করা হয়েছে। যা সমালোচকরা বলেন যে জরুরি চাহিদা থেকে অর্থ সরিয়ে ওই সংস্থান করা হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যা ঘটেছে তা হলো, আইন প্রণেতাদের অসংবেদনশীল মন্তব্য জন-উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। সংসদ সদস্য আহমাদ সাহরোনি ‘বিশ্বের সবচেয়ে বোকা মানুষ’ উপাধি পেয়েছেন। মাসিক ১০০ মিলিয়ন রুপিয়াহ (৬,১৫০ ডলার) আয় করা সংসদ সদস্যদের জন্য বিলাসবহুল ভাতাসহ অভিজাত উদারতার দুর্নীতি জনরোষের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। পুলিশের বর্বরতাও জনগণকে ক্ষুব্ধ করে। ২৮ আগস্ট বিক্ষোভের সময় পুলিশের গাড়িচাপায় একজন মোটরসাইকেল চালকের হত্যার ঘটনায় পুলিশ সংস্কার এবং জাতীয় পুলিশ প্রধান লিস্টিও সিগিত প্রাবোওর পদত্যাগের দাবি ওঠে। গণমানুষের ওপর পুলিশের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ হিসাবে চিহ্নিত হয়।
এই বিষয়গুলো দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোগত চাপ তুলে ধরে, যার মধ্যে রয়েছে সম্পদের ব্যবধান এবং ২০২৪ সালে দায়িত্ব গ্রহণকারী রাষ্ট্রপতি প্রাবোওর অধীনে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টি।
২৫ আগস্ট বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে বিক্ষোভকারীদের অগ্নিসংযোগ অন্যদিকে পুলিশের নির্বিচার গ্রেফতার চলতে থাকে। প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, সংসদ ভবনে আগুন জ্বলছে এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়িয়ে তুলেছে। জনরোষে সরকারের কিছু প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
দিন দিন বিক্ষোভের পরিধি ও তার চরিত্র বদলের কারণে রাষ্ট্রপতি প্রাবোওর প্রশাসন কিছু কিছু ছাড় দিতে শুরু করেছে এবং অনেক স্থানে নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে ক্র্যাকডাউন কার্যক্রম নিয়েছে। এতে কোথাও বিক্ষোভ থামলেও নতুনভাবে অন্য স্থানে বিক্ষোভ শুরু হচ্ছে। সরকার অতিসম্প্রতি যেসব বিষয় যোজনা করেছে তার ভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়াও ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে জনরোষ প্রশমিত হয়। এর অনেক পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এসবের প্রশংসা না করে পারবে না। যেমন, ৩১ আগস্ট প্রাবোও কিছু আইনপ্রণেতার সুযোগ-সুবিধা বাতিল করেন, তাদের বিদেশ ভ্রমণের ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করেন এবং ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রত্যাহার করেন। তিনি পুলিশি পদক্ষেপের নিন্দা করেছেন, তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জিবরান রাকাবুমিং রাকা ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে যান এবং মোটরসাইকেল ট্যাক্সিচালকদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর সাথে মিলিত হন। বিঘ্ন ও দুর্ভোগ কমাতে জাকার্তা এক সপ্তাহের জন্য বিনামূল্যে গণপরিবহন সুবিধার ঘোষণা করেছে। পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং মেরিনদের মোতায়েন থেকে ভারী অস্ত্র তুলে নিয়ে অনুমোদিত অ-প্রাণঘাতী প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুর সাথে জড়িত সাত কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাবোও চীনের সামরিক কুচকাওয়াজের সফর বাতিল করেন এবং পরে স্থিতিশীল অবস্থার ইঙ্গিত দিয়ে এসসিও সম্মেলনের কিছু অংশে যোগ দেন।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে রুপিয়াহ দুর্বল হয়েছে, ব্যাংক ইন্দোনেশিয়াকে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নেটিজনরা। এই সঙ্কট ছাত্র, শ্রমিক গোষ্ঠী এবং নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলো দাঙ্গাকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হিসাবে তুলে ধরছে। মালয়েশিয়া, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ হচ্ছে, যা এই বিক্ষোভে প্রবাসীদের সমর্থনের প্রতিফলন। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত প্রাচীর সৃষ্টি হয়েছে।
এই বিক্ষোভ ও অরাজকতা আন্তর্জাতিক শিবিরেও সাড়া তুলেছে। জাতিসঙ্ঘ সংলাপ ও অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ সতকর্তা জারি করেছে। সিআইএ’র সম্পৃক্ততার মতো বাইরের হস্তক্ষেপ নিয়ে এক্স-এর জল্পনা-কল্পনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিস্থিতি ইন্দোনেশিয়ায় মঞ্চস্থ হতে চলেছে মর্মে প্রতিধ্বনি করছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো অধিকার গোষ্ঠীগুলো সরকারের সমালোচনা করেছে। কর্তৃপক্ষের বিক্ষোভকে রাষ্ট্রদ্রোহ বা সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়ে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের তদন্তের দাবি জানিয়েছে। সিভিকাস, শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা, নির্বিচারে গ্রেফতার এবং বেআইনি হত্যার বিষয়ে জবাবদিহির দাবি জানিয়েছে। যদিও বিক্ষোভ প্রশমিত হয়েছে, কিন্তু অন্তর্নিহিত অসন্তোষ রয়ে গেছে। যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, অস্থিরতার মূলে রয়েছে ‘দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোগত চাপ।’
প্রাবোওর দ্রুত ছাড় উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে। তবে বৈষম্য এবং পুলিশের জবাবদিহির মতো মূল বিষয়গুলো মোকাবেলায় ব্যর্থতা সহিংসতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
কিছু সূত্র এই আন্দোলনকে ‘বিপ্লবী অভ্যুত্থান’ হিসাবে বর্ণনা করে, যদিও অন্যরা জাকার্তার কিছু অংশে স্বাভাবিকতা ফিরে আসার সাথে সাথে এটি থিতিয়ে পড়ছে বলে মনে করে।
বৃহত্তর সামাজিক পর্যায়ে দ্রুত সমাধানের আশার পাশাপাশি সংহতির আহ্বান আছে। যদি এর সুরাহা না হয়, তাহলে প্রাবোও প্রশাসনের ওপর আস্থা নষ্ট হতে পারে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
মূলত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ও শান্তির আহ্বান কার্যকর হয়নি এবং সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্র পুরনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দখলে রয়েছে, যারা সাধারণ মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। এই অবস্থায় শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ ও জনগণের প্রতি সম্মান ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা অপরিহার্য।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার