আমার আব্বা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিদর্শক। তার সাথে প্রফেসর সৈয়দ আলী আশ্রাফের পিতা এবং সৈয়দ আলী আহসান এবং সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিমের পিতা চাকরি করতেন। এ সুবাদে আব্বা গত শতাব্দীর ’২০-এর দশকের প্রথম থেকে ’৫০-এর দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় নোয়াখালীতে ছিলেন। সেই সুবাদে নোয়াখালী শহরের জন্ম ও ক্রমবিবর্তনের তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আমার আম্মার কাছ থেকে যতটুকু দেখেছিলেন তা আমাদের বলেছেন।
তিনি প্রথমে বলেছিলেন, আদি নোয়াখালীর জন্মকথা, সোনাপুরের পরেও দু’টি রেলস্টেশন ছিল। কালের গর্ভে এগুলোর চিহ্ন মুছে গেছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে- তিনি নোয়াখালী শহরের পার্শ্ববর্তী, মেঘনার শাখা নদী জালছিঁড়ার উত্থান-পতন দেখেছিলেন। বালুখোরদের কবলে পড়ে নদীটি হারিয়ে গেছে। বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। তার নানা নোয়াখালীর জজ। তার মায়ের মৃত্যুর পর তিনি নানার আশ্রয়ে লালিত পালিত হন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘নোয়াখালীর মতো এত বিশ্রী নদী আর দেখিনি’। সকালে একরকম, বিকেলে একরকম নদী দেখেছেন তিনি। পরে বুদ্ধদেব বসু ঢাকার পুরানা পল্টনে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি হিসেবে আবিভর্‚ত হন। রবীন্দ্র ভক্ত হিসেবেও পরিগণিত হয়েছিলেন। তিনি কল্লোল গোষ্ঠীর সুদীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখের সাথে উল্লেখযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হন। আমার মা যখন নোয়াখালী জেলার আদি শহরের কথা উল্লেখ করতেন; তখন মন্তিয়ার ঘোনা ও কালীতারা- এ দু’টি স্থানের নাম বারবার বলতেন।
কালীতারার আব্দুর রাজ্জাক মৌলভি আব্বার অধীনে মাস্টার ছিলেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান সাদাত হোসেন তার এক লেখায় মন্তিয়ার ঘোনা থেকে এসে কালীতারায় তাদের পরিবার বসতি স্থাপন করার কথা উল্লেখ করেছেন। মা উল্লেখ করতেন চিরিং মাছের কথা, এ মাছের দু’টি জাত ছিল- ফুল চিরিং ও বাইলা চিরিং। আমাদের বাসায় অতীতে একজন কাজের লোক ছিল, তিনি ঘরের মেঝের পাটাতন তুলে বড়শি দিয়ে নানা রকম মাছ ধরতেন।
আম্মা আদি নোয়াখালী টাউনের উল্লেখ করতে গিয়ে সামুদ্রিক কোরাল মাছের উল্লেখ করতেন। এখন ঢাকার বাজারে অনেক দামে বিক্রি হয়। আর সমুদ্র সরে গেছে অনেক দক্ষিণে। ১৯৮৫ সালে বুড়িরচর ঘূর্ণিঝড়ের পরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখি নোয়াখালী শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে। পানির লবণাক্ততা অনেক কমে গেছে। আগে লোনা পানি মুখে তোলা যেত না। এমনকি ডাবের পানিও লবণাক্ত থাকত। আম্মা বলতেন, পানি থেকে বাঁচার জন্য মেঝেতে কাঠের পাঠাতন দিতে হতো। জোয়ার-ভাটার সাথে কাপড় শুকানোর সম্পর্ক ছিল। ‘জোয়ার আসছে, জোয়ার আসছে’ শুনে কাপড় ঢুকাতে হতো ঘরে। জোয়ারের পানিতে উঠানে একহাঁটু পানি জমে যেত। আম্মা বলতেন, খ্রিষ্টান মেয়েরা চালচলনে অগ্রগামী ছিল। ওদের একজন আমাদের বড় বোনকে পড়াতেন। নাম আগাথা গঞ্জালভেস। খ্রিষ্টান মেয়েরা সে আমলে সাইকেল চালাতেন। আগাথা গঞ্জালভেসের নাম শুনে ব্রিটিশ রহস্য লেখিকা আগাথা ক্রিস্টির কথা মনে পড়ে যায়। আজো সেখানে পর্তুগিজ খ্রিষ্টানদের বংশধররা বাস করছেন। ওদের ভাষার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় জনজীবনে। ‘গঞ্জালভেস’ পর্তুগিজ শব্দ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার সাথে পড়ত ওই এলাকার টেরেন্স পিনারিও। সে রেডিওতে খবর পড়ত। নটর ডেম কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান থাকাকালীন ২০০৭ সালে মারা গেছে। সে সাধারণ হিন্দু থেকে খ্রিষ্টান হয়, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার আর্চ বিশপ তাকে নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন।
তার নামে পর্তুগিজ ভাষার প্রভাব স্পষ্ট। আম্মা বলতেন, রেনুমিয়া কন্ট্রাক্টরের কথা। কন্ট্রাক্টরের দুই ছেলে বিয়ে করেছিলেন আমাদের এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তির দুই মেয়েকে। আম্মা আব্দুল মালেক উকিলের কথা বলতেন। তিনি আমার সবচেয়ে বড় ভাইয়ের সাথে পড়াশোনা করতেন। ‘মালেক উকিল’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। তাদের সাধারণ বংশে উকিল হওয়া বড় ব্যাপার ছিল, তাই নামের মধ্যে ‘উকিল’ ছিল। তখন মুসলমানদের মধ্যে সচরাচর উকিল হতেন না। হিন্দুদের মধ্যে উকিল ছিল। মুসলমানদের মধ্যে ‘মোক্তার’ হতে পারতেন। মালেক উকিল মাঝে মধ্যে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘খোকার মা কি রান্না করেছেন?’ অর্থাৎ, আমার মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। মালেক উকিল নোয়াখালী থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্পিকার ছিলেন। নোয়াখালীর জন্য তার অবদান যথেষ্ট। ১৯৮৭ সালে তার ইন্তেকালের আগে তার মেয়ের সাথে কথা হয়েছিল। আমাদের বাসার রান্নার তিনি প্রশংসা করতেন।
নোয়াখালী শহর সোনাপুর থেকে ছয় মাইল উত্তরে মাইজদীতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে আমার জন্ম অ্যাডভোকেট জহুরুল হকের বাসায়। আম্মা প্রায় সময় কাজের ফাঁকে, রান্নার ফাঁকে স্মৃতিচারণ করতেন। তিনি প্রায় বলতেন আব্বার একটি বড় প্যান্টের কথা। তিনি ওই প্যান্ট পরতেন মাথা না ধরার জন্য। অর্থাৎ মাথাব্যথা না হওয়ার জন্য। তখন নৌকায় করে ট্যুরে যেতেন স›দ্বীপসহ বিভিন্ন থানায়। স›দ্বীপ ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত নোয়াখালীর অধীনে ছিল। তখন রামগতি একটি দ্বীপ ছিল। আর চরবাটা একটি দ্বীপ ছিল। আব্বার হোমিওপ্যাথির বিরাট বাক্স তার মৃত্যুর পরে আমরা খেয়ে সাবাড় করেছি। এলোপ্যাথিক ওষুধের বাক্সও শেষ করেছি।
আম্মার কথা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আজকের নোয়াখালী শহরের লোকেরাও বিশ্বাস করবেন না এ কথা যে, সমুদ্রের কাছাকাছি ছিল নোয়াখালী। এরপর নোয়াখালী থেকে এসে পড়লাম ফেনীতে ট্রেনযোগে। এখানে আমার শৈশব থেকে জীবনের বৃহৎ অংশ কেটেছে।



