জুলাই ঘোষণাপত্র ও জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি বাধ্যবাধকতা

বস্তুত সংস্কারের পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী স্বৈরাচারের পতনের এক বছর পূর্তিতে গত ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এর মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক দলিল প্রকাশিত হলো। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজ বিশেষ করে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছিল। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের অনুষ্ঠানে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র সংগঠনের নেতারা ও সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করে। বৃষ্টিভেজা বিকেলে ছাতামাথায় অথবা কাকভেজা হয়ে হাজার হাজার মানুষ ধৈর্য ও মনোযোগসহকারে জুলাই ঘোষণাপত্র শুনেছেন। অনুষ্ঠানের পূর্ণতার ক্ষেত্রে একটি অভাব লক্ষ করা গেছে। সেটি হলো- জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম শীর্ষ নেতা সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহসহ কয়েকজনের অনুপস্থিতি। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, তারা ওই দিন কক্সবাজারে গেছেন এবং সেখানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে বৈঠক করছেন। পরে অবশ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে, ওই বৈঠকের খবরটি সঠিক নয়। সেটি যা-ই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে- এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে তারা কেন কক্সবাজার গেলেন। তাদের কেউ বলেছেন, বেড়াতে গেছেন; আবার কেউ বলেছেন, ঘোষণাপত্রের ভাষ্য তাদের আকাক্সক্ষা পূরণ করেনি বলে তারা সেখানে উপস্থিত থাকেননি। দ্বিতীয় বক্তব্যটি অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। আবার এরূপ প্রশ্নও শোনা যায়, কেউ হয়তো তাদের অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য করেছেন। আসল ঘটনা হয়তো কখনো প্রকাশিত হবে না।

প্রধান উপদেষ্টা প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও শক্তির উপস্থিতিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন বিধায় এটি মনে করার কারণ হতে পারে, সবাই ঘোষণাপত্রের সাথে পুরোপুরি একমত। প্রকৃত বাস্তবতা কি তাই? অনুষ্ঠানের পরপর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই ঘোষণাপত্রে দেশের মানুষের আকাক্সক্ষার তেমন কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। জাতীয় নাগরিক পার্টিও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। হেফাজতে ইসলাম জুলাই ঘোষণাপত্রে ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে নৃশংস গণহত্যার বিচারের কোনো প্রতিশ্রুতির উল্লেখ না থাকায় হতাশা ও বিস্ময় প্রকাশ করে। ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, ঘোষণাপত্রে সাংবিধানিক সংস্কারকে পরবর্তী জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত করার মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। খেলাফত মজলিসের আমির মামনুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার পাঠ করা ঘোষণাপত্র, ঘোষণার আয়োজন ও একটিমাত্র দলের সাথে আলাপের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা- সবকিছু প্রমাণ করে, ইসলামপন্থীদের মতামত, আত্মত্যাগ ও সাংগঠনিক ভূমিকা অবজ্ঞা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ১৯৪৭ সালে আজাদি, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বর গণহত্যা, পিলখানা ট্র্যাজেডির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। উল্লেখ করা যেতে পারে, বিএনপি জুলাই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। বিভিন্ন দলের বক্তব্য থেকে এটি অনুমান করা যায়, সরকার বিএনপির সাথে একটি সমঝোতা করে জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের দায়িত্ব পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছে।

বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করা যেতে পারে। জুলাই ঘোষণাপত্রের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ যুক্তসঙ্গত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।’ এরূপ ঘোষণায় বিএনপি বেজায় খুশি হতে পারে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির বক্তব্য হচ্ছে- জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই জাতীয় সনদ উভয়টিতে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলো একটি আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে হবে এবং তা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাস্তবায়ন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কিভাবে সম্ভব?

জুলাই ঘোষণাপত্র ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দলের দাবি অনুযায়ী, সরকার তাতে কোনো সংশোধনী বা সংযোজনী আনবে কি না তা পরিষ্কার নয়। সামনে রয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ যা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এটিও একই কারণে বিলম্বিত হচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদে উল্লিখিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে আরো আলোচনা চলবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা শেষ করে তাদের মতামত নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবেন এবং একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।

ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী ঐকমত্য কমিশনে লিখিত মতামত দিয়ে বলেছে, সরকার একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার জারি করতে পারে, অথবা একটি অধ্যাদেশ জারি করতে পারে, অথবা গণভোট আয়োজন করে সংস্কার বিষয়ে জনগণের রায় নিতে পারে। জাতীয় নাগরিক পার্টি আরো আগেই বলেছে, সংবিধান নতুন করে রচনায় গণপরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন হতে হবে।

এখন দেখা যাক, বাস্তবতা কী বলে। কথা হচ্ছে- বিদ্যমান সংবিধান বহাল রেখে সংশোধনী আনতে হলে পরবর্তী জাতীয় সংসদের ওপর নির্ভর করতে হবে এবং সেখানে সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। আর যদি সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান পুনর্লিখন করতে হয় তাহলে গণপরিষদ বা গণভোট লাগবে। একমাত্র এনসিপি ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল গণপরিষদ গঠনের দাবি করেনি। সে ক্ষেত্রে গণপরিষদ গঠনের সম্ভাবনা কম বলে মনে হয়। গণভোটের আয়োজন করার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জনগণ সংবিধান প্রণয়ন বা সংশোধনের ক্ষমতা রাখে। সুষ্ঠু গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি কোনো বিষয়ে রায় দেয় সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত করতে হবে। অবশ্য বাংলাদেশে অতীতের গণভোট নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে। তবে তখন যাই হোক না কেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতার সাথে ভোট বা গণভোটের আয়োজন করবে বলে সবাই আশা করেন। কিন্তু গণভোটে একটি আশঙ্কাও রয়েছে, সেটি হচ্ছে- বিএনপি যদি গণভোটের বিরোধিতা করে তাহলে গণভোটের রায় নেতিবাচকও হতে পারে।

অপর দিকে সরকার যদি একটি অধ্যাদেশ জারি করে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করে, সে ক্ষেত্রে পরবর্তী জাতীয় সংসদে তা পেশ করতে হবে অনুমোদনের জন্য। সেখানেও ঝুঁকি রয়েছে, পরবর্তী সরকার যদি তা অনুমোদন না করে। এ ছাড়া যেকোনো আইন বা অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে যেকোনো সংক্ষুব্ধ নাগরিক আদালতে মামলা করতে পারেন। মামলার রায় যদি অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে যায় তা হলে সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।

আইন বিশেষজ্ঞদের কারো অভিমত হচ্ছে- সবদিক বিবেচনা করে, সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে পরামর্শ চাইতে পারে। সেই ভিত্তিতে বর্তমান সরকার একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করতে পারে। সেটি অপেক্ষাকৃত কার্যকর ও টেকসই হতে পারে।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করতে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন শিগগিরই আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকে বসবে বলে জানিয়েছে। দেখা যাক, দেশের জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে সার্বিক ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় কি না।

ইতোমধ্যে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন ও আরো কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানের বিপক্ষে যারা মানুষ হত্যা, নির্যাতন ও আহত করেছে তাদের দ্রুত বিচার দৃশ্যমান হওয়ার দাবি করে আসছে। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সব ব্যবস্থা অনুসরণ করা হচ্ছে। ফলে একটু সময় লাগবে। তবে আগামী ডিসেম্বরের আগে গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের বিচার দৃশ্যমান হবে বলে আশা করা যায়। সরকার ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়েছে। আরো বাড়ানো হলে বিচারপ্রক্রিয়া আরো গতি লাভ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যুক্তিসঙ্গতভাবে যতটুকু সময় লাগবে তা মেনে চলা উচিত। এ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে যাতে কোনো প্রকার প্রশ্ন তোলা না যায় সে জন্য সব প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা উচিত। যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে বিচার সম্পন্ন দেখতে চায়, তাদের ধারণা, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তারা জুলাই জাতীয় সনদে যেসব সুপারিশ রয়েছে তা বাস্তায়নও বর্তমান সরকারের আমলে দেখতে চায়। বস্তুত সনদের সব সুপারিশ সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয়। বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যা সরকার যেকোনো সময়ে অধ্যাদেশ জারি বা বিধি প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করতে পারে। এ ছাড়া আরো কিছু সুপারিশ রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থা প্রশাসনিক আদেশ জারি করে বাস্তবায়ন করতে পারে। ইতোমধ্যে কমিশন থেকে স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য শতাধিক সুপারিশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। তার মধ্যে বেশ কিছু ইতোমধ্যে বাস্তবায়নও হয়ে গেছে। সরকার চাইলে দ্রুতগতিতে আরো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দিতে পারে। বলাই বাহুল্য, সব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে দিতে পারে। যেমন- জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সরকারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত ওয়েব পোর্টাল তৈরির সুপারিশ করেছে। এটি তৈরি করতে বেশ সময় লাগবে। কিন্তু সরকার চাইলে এর বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ শুরু করতে পারে।

বস্তুত সংস্কারের পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব