নতুন ভোটারদের প্রভাব

নতুন এই ভোটাররা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে দলের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করবেন, সে দলের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রবল।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ করে যে ভোটার তালিকা প্রস্তুত হয় তা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিধান রয়েছে। এ লক্ষ্যে একটি তারিখ নির্ধারিত করে বলে দেয়া হয় ওই তারিখে নির্ধারিত বয়সসীমা অনুযায়ী যারা যোগ্যতা অর্জন করবেন তারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির অধিকারপ্রাপ্ত হবেন।

ভোটার তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়ে যে আইনটি বিদ্যমান তা হলো- ইলেকট্রোরাল রোলস অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২। অধ্যাদেশটির ধারা ৭, ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশবিষয়ক। ধারা ৭-এ বলা হয়েছে- একটি নির্বাচনী এলাকার নিবন্ধনকারী কর্মকর্তা (রেজিস্ট্রেশন অফিসার) নির্বাচন কমিশনের তত্ত¡াবধান, পরিচালনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী উক্ত নির্বাচনী এলাকার জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত বয়সসীমা অনুযায়ী যারা যোগ্যতা অর্জন করবে তাদের নাম সংবলিত একটি খসড়া ভোটার তালিকা প্রস্তুত করবেন যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে- ক. তিনি বাংলাদেশের নাগরিক খ. তার বয়স ১৮ বছরের কম না হয় গ. কোনো যোগ্য আদালত কর্তৃক তার সম্পর্কে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা বহাল না থাকে এবং ঘ. তিনি ওই নির্বাচনী এলাকার অধিবাসী। খসড়া ভোটার তালিকা প্রস্তুতের পর বিভিন্ন দাবি ও আপত্তি নিষ্পত্তির পর নিবন্ধনকারী কর্মকর্তা চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করবেন এবং তা উক্ত নির্বাচনী এলাকার চূড়ান্ত ভোটার তালিকারূপে গণ্য হবে।

ভোটার তালিকায় নামভুক্তির যোগ্যতা বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২২ এ বলা হয়েছে- প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার ভিত্তিতে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একজন ব্যক্তি সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত কোনো নির্বাচনী এলাকায় ভোটার তালিকাভুক্ত হওয়ার অধিকারী হবেন যদি- ক. তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হন খ. তার বয়স ১৮ বছরের কম না হয় গ. কোনো যোগ্য আদালত কর্তৃক তার সম্পর্কে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা বহাল না থাকে ঘ. তিনি ওই নির্বাচনী এলাকার অধিবাসী বা আইনের দ্বারা ওই নির্বাচনী এলাকার অধিবাসী বিবেচিত হন এবং ঙ. তিনি ১৯৭২ সালের যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন কোনো অপরাধে দণ্ডিত না হয়ে থাকেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৩১ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেছে। হালনাগাদ করা ভোটার তালিকায় ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৩ জন। যাদের মধ্যে নতুন ভোটার সংখ্যা ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন। ইতঃপূর্বে ২ মার্চ ২০২৫ যে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল তাতে ভোটার সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দায়িত্ব ইসির ওপর ন্যস্ত। সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে ফেব্রুয়ারি, ২০২৬ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তবে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। ইসি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সময় পূর্ণাঙ্গ তফসিল প্রকাশ করে থাকে।

বাংলাদেশে ২০০৮ সালে যে নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলেও তাতে ভোট প্রদানের হার অন্যান্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ এ তিনটি নির্বাচনের কোনোটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না। দশম সংসদ নির্বাচনটি দেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণের পূর্বের রাত ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ভোটের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয় এবং সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক করে দেন কারা হবেন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ প্রার্থী। এ তিনটি নির্বাচনের কোনোটিতে ভোটার উপস্থিতি সার্বিক বিবেচনায় ১০ শতাংশ এর বেশি ছিল না।

উপরোক্ত তিনটি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন হওয়ায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য দলের জনসমর্থন কতটুকু ছিল তা যাচাই বা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এ নির্বাচনগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন হওয়ায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যারা সমর্থক তাদের অনেকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করেননি। এ কারণে ভোটার উপস্থিতির নিম্ন হার পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা বিজয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে যে দল ক্ষমতাসীন ছিল; সে দল পরাভূত হয়েছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন্ দলের জনসমর্থন কেমন, তার প্রকৃত চিত্র আমাদের নিকট স্পষ্ট নয়।

আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ না হলে ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হয়তো নির্বাচনী কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট হবেন না। সেই সাথে ভোট প্রদানেও আগ্রহী হবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ-সংশয় রয়েছে। এমতাবস্থায়, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এই তিন দল এবং এদের জোটভুক্ত দলগুলো নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হবে।

এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও জাতীয় পার্টি অধিষ্ঠিত ছিল। জাতীয় পার্টির জনসমর্থনে ব্যাপক হ্রাস ঘটায় আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে দলটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যদি সুযোগ পায়, তা হলেও আশানুরূপ ফল করতে যে পারবে না; এটি প্রায় নিশ্চিত। দশম সংসদ নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে তাতে বিএনপি যে জয়লাভ করে সরকার গঠন করত এমনই ধারণা পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে একাদশ বা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল কি হতো তা অনুধাবন করা দুষ্কর।

২০১৪ সালে পরবর্তী যারা নবীন ভোটার তাদের কেউ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। ফলে পুঞ্জীভূতভাবে ২০১৪ পরবর্তী অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের একটি বড় অংশ ভোট প্রদানকার্যক্রম হতে বিরত থাকেন। কিন্তু বর্তমানের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগেকার পুঞ্জীভূত ভোটারসহ বর্তমানের নবীন ভোটাররা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, তারা কখন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের পছন্দের দল বা প্রার্থীকে নির্বাচনে বিজয়ী করে সরকার পরিচালনায় সহযোগিতা করবেন।

সম্প্রতি চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিতে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে। এ বাস্তবতায় ধারণা করা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নবীন ভোটারদের একটি বড় অংশ জামায়াতে ইসলামী বা এর জোটভুক্ত দলের সমর্থনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এরশাদ সরকারের বিদায় হলে তিন জোটের রূপরেখায় কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনটিতে এরশাদ অন্তরীণ থাকাবস্থায় তার দল জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করে ৩৫টি আসন লাভে সমর্থ হয়। তখন এরশাদ স্বৈরাচার এ প্রশ্নে তার দলকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে বারিত করা হয়নি।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা আরোপ করায় তার পক্ষে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। তার দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় দলটি আসন্ন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণ করতে পারাটাও অনিশ্চিত। জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও তা জোরালো নয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে না পারলে, আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার মতো জোরালো প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ কম।

বর্তমানে নতুন ভোটারের সংখ্যা আঠারো লক্ষাধিক। তাদের একটি বড় অংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। এরা সবাই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এদের বাবা-মাসহ ভাই-বোন অনেকে ভোটার। এ নতুন ভোটারদের পরিবারের প্রতি প্রভাব অপরিসীম। নতুন এই ভোটাররা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায় ও দুর্নীতির বিপক্ষে। তারা চান নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক। সেই সাথে দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক। আর তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়- নতুন এই ভোটাররা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে দলের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করবেন, সে দলের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রবল।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক