যে সেনাবাহিনী না থাকলে হয়তো বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না সেই সেনাবাহিনীর সূচনাকারীদের অন্যতম ছিলেন মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি। মাত্র ৪২ বছরের জীবনে দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে তিনি ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। এমন সময়ে তার আবির্ভাব ঘটেছিল যখন বাংলার মানুষ ছিল চরমভাবে অবহেলিত। ব্রিটিশ ভারতে বাংলা ও আসামের অবহেলিত মুসলমানদের অধিকার আদায়ে ও সামরিক বাহিনীতে নিজেদের অংশীদারত্ব বাড়ানোর জন্য যেসব বাঙালি অফিসার সচেষ্ট ছিলেন মেজর আবদুল গণি তাদের একজন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক হিসেবে তিনি ‘বঙ্গশার্দুল’ ও ‘টাইগার গণি’ নামেই বেশি পরিচিত।
ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন জাতি বা তাদের এলাকার নামে সামরিক রেজিমেন্ট ছিল। কেবল বাঙালিদের কোনো রেজিমেন্ট ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি মুসলমানদেরকে নিয়ে কিছু বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করা হলেও যুদ্ধ শেষে সেগুলো ভেঙে দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া বাঙালি সৈনিকের পাশাপাশি কমিশনড অফিসারদের মধ্যে মেজর আবদুল গণি (১৯১৫-৫৭) ছিলেন অন্যতম। ব্রিটিশ শাসনকালে তার চেষ্টা সফল না হলেও পাকিস্তান হওয়ার সূচনালগ্নেই প্রতিষ্ঠিত হয় তার স্বপ্নের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন- প্রথম ইস্ট বেঙ্গল।
১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আবদুল গণি। বাবা মোহাম্মদ সরাফত আলী ছিলেন কৃষিজীবী ও মা জোবেদা খাতুন গৃহিণী। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী তাকে মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। চট্টগ্রামে ইসলামিয়া হাই মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে মহানবী সা:-এর ‘হিলফুল ফুজুল’-এর অনুকরণে গড়ে তোলেন ‘সবুজ কোর্তা’ নামে সমাজসেবামূলক সমিতি। ‘সবুজ কোর্তা’ স্বেচ্ছাসেবকরা অল্প সময়ের ব্যবধানে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রামে আন্তঃজেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এম এ গণির নেতৃত্বে সবুজ কোর্তার কুচকাওয়াজে তিনি ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন।
গণির ছাত্রজীবন কেটেছে আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার অমায়িক আচরণ, শিষ্টাচার, সাহসিকতা, সমাজসেবা, পরোপকারী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে আর্থিক অভাবের সময় এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের মহকুমা প্রশাসক হামিদ হাসান নোমানী, যিনি ছিলেন অবাঙালি মানবহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। গণির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেন তিনি। গণিকে তিনি চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে ভর্তি করে নিজ বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন। জনাব নোমানীর খুলনায় বদলি হলে গণিকেও তিনি খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৯৩৬ সালে এ স্কুল থেকেই এন্ট্রাস, ১৯৩৮ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪০ সালে বিএ পাস করেন। পরে তিনি কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডে অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে এম এ গণি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ভারতীয় পাইওনিয়ার কোরে কমিশন লাভ করেন।
শুরু থেকেই গণি ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, নির্ভীক, বিনয়ী, কৌশলী ও কর্মতৎপর অফিসার। তিনি ১৯৪২ সালে লেফটেন্যান্ট, ১৯৪৩ সালে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। এ সময় বার্মার আরাকানে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনে পাঠানো হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে জাপানিদের দ্বারা অবরুদ্ধ এক হাজার ২০০ ব্রিটিশ সৈন্যকে উদ্ধারে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে ক্যাপ্টেন গণিকে ভারতের ঝালনায় কোর সেন্টারে বদলি করা হয়। তখন থেকে তিনি বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠনের কথা ভাবছিলেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের বিশাখাপত্তম, হায়দরাবাদ, সেকান্দারাবাদ ও মুম্বাইতে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির দায়িত্ব পালন করেন। এখানে তিনি দু’টি পাইওনিয়ার কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ব্রিটিশ জেনারেল মেসারভি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। তিনি ক্যাপ্টেন গণিকে চিনতেন মহাযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য। সে সুবাদে গণি জেনারেল স্যার মেসারভিকে একটি পত্র লিখেন। এতে তিনি বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠনের অনুরোধ জানান। পত্রের সাথে তিনি সব তথ্য ও যুক্তি পেশ করে ২০ পৃষ্ঠার একটি স্মারকলিপিও পেশ করেন। মেসারভি এ প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন। পত্রের উত্তরে তিনি জানান, ‘আমি আশা করি বিশ্বকে তোমরা দেখাতে পারবে বাঙালি মুসলমান সৈনিকরা অন্য সৈনিকদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’ ঝালনার কোর সেন্টারের অধিনায়ক লে. কর্নেল মারিয়াটি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠনের বিষয়ে ক্যাপ্টেন গণিকে পরামর্শ ও উৎসাহ দেন। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন গণির অধীন পাইওনিয়ার কোম্পানি দু’টি বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে গঠিত ছিল বলে এগুলো পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ১৯৪৭ সালে ক্যাপ্টেন গণির নেতৃত্বে কোম্পানি দু’টি বিশেষ ট্রেনে মুম্বাই থেকে ঢাকায় আনা হয়।
ঢাকায় আসার পর ক্যাপ্টেন গণি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠনে তৎপরতা শুরু করেন। অবশেষে বাংলার বাঙালি মুসলমানদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এবং ক্যাপ্টেন গণির আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করতে শুরু করে। বাঙালি মুসলমানদের জন্য ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ নামে রেজিমেন্ট গঠন করা হয়।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লে. কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসনকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক নিয্ক্তু করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় বাঙালি মুসলমানদের বহু প্রতীক্ষিত সে মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়। এ ঐতিহাসিক দিনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ‘প্রথম ইস্ট বেঙ্গল’। পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, মন্ত্রিপরিষদের সব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আইউব খান, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা। ‘সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা’র আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যাত্রা শুরু করে এ বাহিনী।
অনুষ্ঠানের চা-চক্রে এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার অবতারণা হয়। ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান সবার উদ্দেশে বলেন, ‘ঋৎড়স হড়ি ড়হ-ড়িৎফং ইবহমধষর ঝড়ষফরবৎং রিষষ ংঢ়বধশ রহ টৎফঁ, হড়ঃ রহ ইবহমধষর.’ এ কথার প্রতিবাদ করে ক্যাপ্টেন গণি সবার সামনে আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘ঊীপঁংব সব ঝরৎ, ডব ইবহমধষর ংড়ষফরবৎং রিষষ হবাবৎ ংঢ়বধশ রহ টৎফঁ, নঁঃ রহ ড়ঁৎ সড়ঃযবৎ ঃড়হমঁব ইবহমধষর.’ জবাবে আইয়ুব খান ‘ঝযঁঃ ঁঢ়. ঝরঃ ফড়হি’ বলে ক্যাপ্টেন গণিকে থামিয়ে দেন। এ দুঃসাহসী ভূমিকার জন্য এ সময় থেকেই তাকে ‘টাইগার গণি’ আখ্যা দেয়া হয়। এরকম স্পষ্টবাদিতার উদাহরণ আজকের দিনে বিরল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালেই প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং মেজর গণি হলেন এ অদৃশ্য আন্দোলনের মহানায়ক। ইস্ট বেঙ্গল থেকে তাকে বদলি করা হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড, দিনাজপুরে। সর্বশেষ তাকে ১৪ ডিভিশন হেড কোয়ার্টার, ঢাকায় বদলি করা হয়। যথাযথ মূল্যায়ন ও পদোন্নতি না হওয়ায় ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে তিনি রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। পদত্যাগ গৃহীত হয় এবং তাকে অবসর দেয়া হয়। অবসরকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন গণিকে তার অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অবসরোত্তর ‘মেজর’ পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
রাজনৈতিক জীবন : মেজর গণি দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নিজেকে কাজে লাগানোর জন্য রাজনীতিতে আসেন। তিনি ছিলেন ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে সুশিক্ষিত। আরবি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। অসংখ্য মানুষ বক্তব্য শুনে তার ভক্তে পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের ২২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। তার সামগ্রিক চেষ্টা ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ। পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তার বক্তব্য এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, প্রত্যেক সদস্য ও স্পিকার মনোযোগ দিয়ে তা শুনতেন। তিনি সরকারের কাছে ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা, দেশের সব যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার দাবি জানান। তিনি ‘ইসলাম লীগ’ নামে একটি প্রকৃত ইসলামী দল গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তবে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ১৯৫৭ সালের ১২ নভেম্বর বিদেশের মাটিতে তার মৃত্যু হয়। তার লাশ দেশে আনার পর যথাযথ সামরিক মর্যাদায় কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে দাফন করা হয়।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কাজ করার তীব্র স্পৃহা, নির্ভীক ও তেজস্বী মনোভাব ও সর্বোপরি শক্তিশালী ঈমানি শক্তি থাকলে স্বল্প সময়েও যে অসাধ্য সাধন করা যায়, মেজর গণি এর উদাহরণ। তিনি সামরিক বাহিনীতে উচ্চপদে আসীন হতে না পারলেও তার মাধ্যমে যে অসাধারণ ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সাধিত হয়েছিল তা বাঙালি মুসলমানের জন্য ছিল অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের। বাংলাদেশ যত দিন টিকে থাকবে মেজর আবদুল গণি তত দিন জাতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।
লেখক : নিরাপত্তা-বিশ্লেষক



