কেউ দায় এড়াতে পারবে না

বহু প্রতীক্ষিত এই নির্বাচন যদি হয় অর্থহীন, তার পরিণামটা কী হবে? এ জন্য যার যতটুকু দায় জনগণের সেই দায় অনুসারে তাদের ক্ষোভ ঝাড়বে। মানুষের ১৫-১৬ বছরের কষ্ট নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হলে, ইতিহাস তার সাক্ষী হবে। সরকার নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল কেউ তার দায় এড়াতে পারবে না।

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়ার ও ভাবমর্যাদা বৃদ্ধির কতগুলো অপরিহার্য পূর্বশর্ত থাকে। তার অন্যতম হচ্ছে- শুদ্ধ রাজনীতি, ক্ষমতাসীন দলের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জনবান্ধব নীতি এবং অর্থনীতি বিকাশের বাস্তবভিত্তিক পথনকশা। এর পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন এবং বিরোধী দলের দায়িত্বশীল ভূমিকা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দল ও দলের বাইরে প্রজ্ঞাপূর্ণ বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিদের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, তাদের কালোকে সাদা বলতে বাধ্য না করা। সবাইকে সব ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন। যেকোনো ক্রান্তিকালে সবাইকে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে বৃদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। কেননা, পতিতদের অপছায়া এখনো বিরাজমান।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত ৫৩ বছরে যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের কেউই রাষ্ট্র বিনির্মাণের কার্যক্রমে কখনোই নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেনি; বরং উপেক্ষা করেছে। পূর্ববর্তীকালে, সামান্য যা কিছু নির্মিত হয়েছিল এবং যা নির্মাণাধীন ছিল, তার সবকিছু পতিত লীগ সরকার ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। একই সাথে রাষ্ট্রের যে তিন স্তম্ভ- প্রশাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ, এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ অন্য সব সংস্থা-প্রতিষ্ঠান অকার্যকর করে গেছে। অথচ এই তিন স্তম্ভ যথানিয়মে চললে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। শুদ্ধ রাজনীতির পথগুলো শুধু বন্ধ করা নয়, কণ্টকাকীর্ণ করা হয় লীগের ছত্রছায়ায়। শুদ্ধ রাজনীতির শূন্যতাকে তখন পূর্ণ করেছে পতিতদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা অপরাজনীতি। এখনো তাদের অপকর্ম শেষ হয়নি। পতিতদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বিষবাষ্পে এখনো রাষ্ট্রীয় পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে আছে। সেই বাষ্প এখন রাষ্ট্র ও জনজীবনকে তুষের আগুনের মতো জ্বালিয়ে চলেছে। গত ১৫/১৬ বছর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শুদ্ধ রাজনীতির পথ এতটা কণ্টকাকীর্ণ করা হয়েছিল, এক কথায় যাকে বলা যায় ভয়ঙ্কর এক দুঃসময় ও দুর্যোগের কাল। শুদ্ধ রাজনীতির অঙ্কুরিত হওয়ার সুযোগটা পর্যন্ত আঁতুড়ঘরেই শেষ করে দেয়া হয়েছিল।

ফলে অপরাজনীতি দ্রুত বিস্তৃত এবং বিকাশ লাভ করে। সাথে জনগণের স্বাধীনতা, স্বস্তি-শান্তি নিঃশেষ হতে থাকে। অপরাজনীতির অর্থ হচ্ছে গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থসিদ্ধি করা। গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থসিদ্ধি করা জনগণের কষ্ট দুঃখ তখন তদানীন্তন প্রশাসনের গোচরীভূত করা হলেও কখনো এর কোনো সুরাহা হয়নি। উপরোক্ত নালিশ করার কারণে রক্তচক্ষু দেখানো হয়েছে। একই সাথে দুর্বিষহ শাস্তির যত কথা শোনানো হয়েছে। লীগ জামানায় লোকসমাজের এমনটিই ছিল দিনান্তের রোজনামচা।

বিগত ১৫/১৬ বছর পতিত সরকারের অপশাসনে জনগণ শোষণের শিকারে পরিণত হয়। ইতিবাচক রাজনীতির পথকে শুধু স্তব্ধ করা হয়নি, এমনকি নানা ট্যাগ দিয়ে তারা খান্ত হয়নি, সেখানে হলাহল মিশ্রিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, জনগণকে রাজনীতিবিমুখ করে তোলা, অর্থাৎ- দেশকে বিরাজনীতিকীকরণ। যাতে ক্ষমতাসীনদের আর কোনো প্রতিপক্ষ সৃষ্টি হতে না পারে।

প্রশ্ন হতে পারে, শুদ্ধ রাজনীতির সংজ্ঞা কী? এ বিষয়ে উপরে অনেকটাই বলা হয়েছে। এখানে তাত্তি¡ক আলোচনার সুযোগ ও যৌক্তিকতা প্রমাণের কোনো প্রয়োজন নেই। মোটা দাগে শুদ্ধ রাজনীতির সহজ ব্যাখ্যা হলো- রাষ্ট্র ও জনতার কল্যাণ, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতি। জনগণকে সাথে নিয়ে সার্বিক উন্নতি-প্রগতির পথে এগিয়ে নেয়া। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য স্পেস তৈরি করা, তাদের গঠনমূলক সমালোচনার প্রতি সহিষ্ণুতা থাকা। তাদের সৎ পরামর্শগুলো বিবেচনায় নেয়া, মিডিয়াকে উচিত কথা বলার সুযোগ দেয়া।

রাজনীতিকে জনসেবার জায়গা থেকে সরিয়ে এনে বাণিজ্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে। অর্থাৎ- অপরাজনীতির খলনায়ক-নায়িকারা রাজনীতিকে এখন সেবার স্তর থেকে পেশায় নামিয়ে এনেছে। এ থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করা জরুরি। নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দেয়াসহ নাগরিকদের সব অধিকারকে খর্ব করা হয়েছিল, তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। জনতাকে তাদের হুকুম শোনার পাইক-পেয়াদা বানিয়ে রাখতে চেয়েছে, সেখানে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। এখন দেখা যেতে পারে অপরাজনীতির সাঙ্গোপাঙ্গদের স্বরূপ ও তার পরিধি কতটা বিস্তৃত ছিল।

বাস্তবতার আলোকে অনেকের কাছে এমন ধারণা বদ্ধমূল যে, দেশে অপরাজনীতিমুক্ত একটি অঞ্চল দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। বস্তুত পতিত সরকার অপরাজনীতির এক অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল গোটা বাংলাদেশকে, যার অনেকটাই এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে। অতিভোজনে যেমন পেটে বিপাক দেখা দেয় তেমনি অপরাজনীতির আধিক্য দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া রাষ্ট্র ও জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, তার জের এখনো দৃশ্যমান।

প্রশ্ন হলো- এই অপরাজনীতির খলনায়ক কারা? হ্যাঁ তারাই, যারা ক্ষণে ক্ষণে ডিগবাজি খায়, আজ এ দল, কাল সে দল করে, বৃত্তাকারে ঘোরে সন্ধ্যা-সকাল বেলা। রাজনীতির অঙ্গনে এরা কখনো স্থির থাকছে না। স্বার্থের গন্ধ পেলেই খলরাজনীতির পাত্র-মিত্রদের দল বদল করতে মুহূর্তকাল লাগে না। এদের ‘রাজনৈতিক’ কর্মসূচি হলো : নতুন নতুন সুহৃদদের সাথে মিলেমিশে আগের মতো একই অপকর্মের চর্চা করা। নতুন সুহৃদদের সাথে তাদের গলায় গলায় ভাব জমিয়ে তোলা। আগের মতো, বন-বাদাড় ভক্ষণ, ভূমি দখল, নদী-নালা ভরাট করা, পাহাড় কেটে বসত গড়া, পাথর গিলে খাওয়া। তামাম জিনিস আত্মসাৎ করে নিজেদের আখের গোছানো। ধরা খেলে, জেরা করলে তখন বলে- আমরা অমুক দলের তমুক নেতার ভাই-ব্রাদার, ডিসাইপল। তখন আর কারো জেরা করার সাহস থাকে না।

অপরাজনীতির এমন লীলাখেলার উদাহরণ ইতিহাসে খুব কম নয়। বিগত ৫২ বছর ধরে চলছে এমন নিরবচ্ছিন্ন ধারা। পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এরা শুরু করে নানা ছলচাতুরী। এখনো এদের অপছায়া লোকালয়ে খালি চোখেই দেখা যায়। এসব ডিসাইপলরাই রাজনীতিকে ‘বাণিজ্যনীতিতে’ রূপান্তর করেছে। এমনও জনশ্রুতি আছে, রাজনীতির এমন বাণিজ্যের লাভ-লোকসান নাকি ভাগবাটোয়ারা হয়। আজ সেই চ্যাপ্টার ওপেন না করাই ভালো। রাজনীতির ভিন্ন একটি চ্যাপ্টার খোলার চেষ্টা করি।

রাজনৈতিক নেতা হওয়ার এমন স্বাদ ও ঘ্রাণে এখন সৃষ্টি হচ্ছে, দলের পর দল, অসংখ্য দল। নতুন এসব দলের আণ্ডাবাচ্চারা আঁতুড়ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই সৃষ্টি করছে, নতুন নতুন দল। ঢাকা ছাড়া এসব দলের কোনো শাখা-প্রশাখা নেই, তারপরও তারা দলনেতা। নেতাসর্বস্ব দল, এসব দল মিলে মিলে সৃষ্টি হচ্ছে দলজোট। একে কখনোই বলা যাবে না রাজনীতির বা গণতন্ত্রের বিকাশ; বরং বলতে হবে রাজনীতির অর্থহীন প্রসার।

বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ যেমন- ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের বিবেচনায় উচ্চমাত্রায় উপনীত। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রে সেখানে নেই কোনো দলজোট। উভয় দেশে প্রকৃত অর্থে মাত্র প্রধান দু’টি দল। তাতে সেখানে গণতন্ত্রের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে না। এ লেখার এই অধ্যায়টুকু নিয়ে কেউ মনে করতে পারেন, ‘এন্টি ডেমোক্র্যাটিক অ্যাটিটিউড। তাদের কাছে আমাদের বিনীত জিজ্ঞাসা। দেশে এত শত দল, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশটা কোথায়? এককভাবে কোন ছোট দল রাজনীতিতে কতটুকু অবদান রাখছে। রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্যটা কী! নিশ্চয়ই নির্বাচনের যেকোনো অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে দলের নিজস্ব চিন্তাচেতনা ও আদর্শের আলোকে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দলের পক্ষে কস্মিনকালেও নিজেদের বিজয়ী করা অসম্ভব। ক্ষুদ্র দলগুলো এখন বড় দলের করুণা মাত্র হয়ে যেভাবে চলছে, তাতে ক্ষুদ্র দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে বড় দল। তারপর তাদের কী পরিণতি হয়, ইতিহাসে তারও বিবরণ লেখা আছে। এমন অর্থহীন পণ্ডশ্রমের প্রয়োজনটা কী; বরং যেকোনো বড় দলের আদর্শের সাথে মিলমিশ হয়ে সেখানে থিতু হওয়াটাই উত্তম। কেউ মনে করবেন না, এটি আপনাদের জন্য পরামর্শ। সে ধৃষ্টতা আমাদের নেই, নিছক আমাদের অনুভব অনুভূতি। দল ক্ষুদ্র হলেও সেখানে মেধাবীরা আছেন। সেই মেধা জাতির কাজে আসুক।

দেশের ১৩শ’ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ এক অর্থে নির্ধারিত। দলগুলোও নির্বাচনী দৌড়ে শরিক হতে চলেছে। আপনারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন; কিন্তু যারা আপনাদের নির্বাচিত করবেন, তারা প্রস্তুত তো! কিন্তু তাদের তো মনে নির্বাচন নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা। সবাই সেটি নিয়ে ভাবুন। ১৫-১৬ বছর যে ভোটের জন্য জনগণ অধীর হয়ে আছে, এখন কেন তাদের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনার বদলে সংশয়, ভয়। তাদের মনে কেন অতীতের অপছায়া ভাসছে। তারা ভেবেই পাচ্ছেন না, কেন রাজনীতির অঙ্গনে এত বিতর্ক। নির্বাচন নিয়ে কেন জনগণের ভোট উৎসাহে ভাটা পড়েছে। ভোটদানের প্রস্তুতি কোথায়? বহু প্রতীক্ষিত এই নির্বাচন যদি হয় অর্থহীন, তার পরিণামটা কী হবে? এ জন্য যার যতটুকু দায় জনগণের সেই দায় অনুসারে তাদের ক্ষোভ ঝাড়বে। মানুষের ১৫-১৬ বছরের কষ্ট নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হলে, ইতিহাস তার সাক্ষী হবে। সরকার নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল কেউ তার দায় এড়াতে পারবে না।