ভৈরব-বাজিতপুর জেলা দাবি, কতটা যৌক্তিক

আমাদের বিশ্বাস, এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না। বিষয়টি ভৈরব ও বাজিতপুরের জেলা বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্টদের উপলব্ধি করা উচিত।

কিশোরগঞ্জ ভেঙে নতুন একটি জেলা বাস্তবায়নের প্রয়াস দীর্ঘ দিনের। ১৩ উপজেলা নিয়ে গঠিত এ কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের দু’টি উপজেলা ভৈরব ও বাজিতপুরের বাসিন্দারা তাদের এলাকাকে জেলায় উন্নীত করার লক্ষ্যে অনেক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ইস্যুতে আন্দোলন-সংগ্রাম, মিটিং, মিছিল, মানববন্ধন, ব্লকেড কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবিদাওয়া তুলে ধরেছেন। এর অংশ হিসেবে ভৈরবকে ৬৫তম জেলা ঘোষণার দাবিতে গত ২৭ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। ভৈরবের সর্বস্তরের জনতার ব্যানারে রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে নোয়াখালী থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভৈরব রেলওয়ে জংশনে পৌঁছালে অবরোধের কবলে পড়ে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ট্রেনের ইঞ্জিনে উঠে, রেলপথে ও প্লাটফর্মে লাল কাপড় ও ব্যানার হাতে নিয়ে জেলার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের রেল যোগাযোগ। কিশোরগঞ্জগামী আন্তঃনগর এগারো সিন্ধুর এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেস, সিলেট থেকে ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী ‘তিতাস কমিউটার ট্রেন’ ও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী একটি মালবাহী ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে।

একপর্যায়ে প্রশাসন আটকে পড়া ট্রেনটি মুক্ত করে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করলে অবরোধকারীরা সহিংস হয়ে ওঠে। তারা ট্রেন লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ করে। এতে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পাথরের আঘাতে ট্রেনের অন্তত ২০ যাত্রী আহত হন। ভয়ার্ত মানুষ আর্তচিৎকার করে দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। এই ঘটনায় অজ্ঞাত ১৫০ জনের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগের দিন ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের দুর্জয় মোড়ে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এতে প্রায় দুই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকায় যোগাযোগব্যবস্থা থমকে যায়। সড়কপথের যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়েন।

বসে নেই বাজিতপুর জেলা বাস্তবায়ন কমিটিও। বাজিতপুরবাসী কিশোরগঞ্জ জেলার ছয়টি উপজেলা নিয়ে পৃথক জেলা ঘোষণার দাবিতে সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। তারা স্থানীয়ভাবে বিক্ষোভ মিছিল মানববন্ধন, মশাল মিছিলসহ নানান কর্মসূচি পালন করে আসছেন।

বাজিতপুর জেলা বাস্তবায়ন কমিটি সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাজিতপুর একটি প্রাচীন জনপদ। ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার। এ উপজেলার সড়ক ও রেলপথ এবং নৌপথসহ আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা বিদ্যমান। বাজিতপুর একটি প্রাচীন পৌরসভা। ময়মনসিংহ পৌরসভার আগে ১৮৬৯ সালে বাজিতপুর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১২ সালে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা ভাগ করে বাজিতপুরকে পৃথক মহকুমা করার সিদ্ধান্ত নেয় হয়েছিল। এ ছাড়া বাজিতপুরকে কৃষি জেলা করার লক্ষ্যে ১৯১২ সালে ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার বাজিতপুর দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠা করে। সে সময় থেকে বাজিতপুরে ভৈরবসহ পাঁচ থানার সহকারী জজ (দেওয়ানি) আদালত কার্যকর রয়েছে। ভৈরব, কুলিয়ারচর ও বাজিতপুরের পুলিশ সার্কেল (এএসপি) কার্যালয়ও বাজিতপুরে ছিল। এখানে হেলিপ্যাড, জেলখানা, খাস জমি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ জেলা হওয়ার সব উপাদান বিদ্যমান। স্বাধীনতার পর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি বাজিতপুরের অধিবাসী জহুরুল ইসলাম বাজিতপুরকে জেলা করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন বলে অনেকে দাবি করেন।

অপর দিকে ভৈরব জেলা বাস্তবায়ন কমিটির সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি, ভৈরব একটি বন্দরনগরী। ব্রিটিশ আমল থেকে ব্যবসাবাণিজ্য, যোগাযোগসহ নানা দিক দিয়ে এগিয়ে। তিন দশক ধরে ভৈরববাসী জেলার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, ২০০৯ সালে তৎকালীন সরকার জেলা ঘোষণার জন্য একটি যাচাই কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে; কিন্তু এর মধ্যে ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও জেলা বাস্তবায়ন হয়নি। কাজেই জেলার দাবি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং সেই সরকারের সময় রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মো: জিল্লুর রহমান।

তিনি ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর হাজী আসমত কলেজ মাঠে এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও ভৈরবকে জেলা করে যাবো।’ জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর তার ছেলে নাজমুল হাসান পাপন বিনা ভোট, রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে উপর্যুপরি সংসদ সদস্য হয়েছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হয়েছেন। তথাপি তিনি বাবার শেষ ইচ্ছা ভৈরবকে জেলা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা যায় না। জোরালো কোনো আন্দোলন সংগ্রামও হয়নি। তা ছাড়া একই সময়ে কাছাকাছি দুই উপজেলা যখন সমান্তরালে জেলা করার দাবি করে তখন তা বাস্তবায়ন দুরূহই বটে।

জেলা বাস্তবায়ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এর সাথে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যয়ের সম্পর্ক বিদ্যমান। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৭ বছরের স্বৈরশাসনে অবসান ঘটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের বিধ্বস্ত আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের দ্বারা সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার এবং দেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছে। এ অবস্থায় সরকারের শেষ সময়ে জেলার দাবিতে আন্দোলনকে অনেকে ভিন্নভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। আমাদের বিশ্বাস, এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না। বিষয়টি ভৈরব ও বাজিতপুরের জেলা বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্টদের উপলব্ধি করা উচিত।

লেখক : আইনজীবী