জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ

সাংবিধানিক রূপান্তরের নতুন দিগন্ত

এ বয়ান বলছে, জনগণ তাদের গঠনমূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে একটি নতুন সাংবিধানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করছেন, যা বিদ্যমান অথচ অকার্যকর সেই সংবিধানকে সংশোধন করবে, যে সংবিধান গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একটি স্বৈরাচারী শাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল।

২০২৫ সালের ১৩ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আইনি কাঠামো কার্যকর হয়, যা বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। চূড়ান্ত সংস্করণটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আগে প্রচারিত খসড়া থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়; কেবল সামান্য কিছু সংশোধন যুক্ত হয়েছে। এ প্রবন্ধে আদেশটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং চলমান সাংবিধানিক রূপান্তর প্রচেষ্টার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বিপ্লবাত্মক চরিত্রের স্বীকৃতি

এ আদেশ বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্তের সূচনা করেছে। প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণীত কোনো আইন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, এ আদেশের ক্ষমতার উৎস কেবল জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়। প্রতীকীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও সচেতন এ পদক্ষেপের প্রক্রিয়ায় আদেশটি তার বৈধতার উৎস হিসেবে কোনো বিদ্যমান আইন বা সংবিধানকে উদ্ধৃত করেনি। এটি পূর্ববর্তী সাংবিধানিক প্রথা থেকে একটি মৌলিক বিচ্যুতি নির্দেশ করে। অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে আর নিজেকে উপস্থাপন করছে না; বরং জনগণের গঠনমূলক (সংবিধান প্রণেতা শক্তিবলে) ক্ষমতা প্রয়োগ করছে, যা যেকোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আইনি কর্তৃত্ব।

এ বিচ্যুতি, বিচার বিভাগের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারবে না। ভবিষ্যতের সাংবিধানিক মামলাগুলোতে আদেশটি প্রায় নিশ্চিতভাবে একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হবে, যা নির্দেশ করবে যে অন্তর্বর্তী সরকার রূপান্তরকালীন জনগণের সরাসরি ম্যান্ডেট প্রয়োগ করেছে। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময় পর্যন্ত সব আইন বিদ্যমান সংবিধানের ৯৩ নং অনুচ্ছেদের অধীনে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ হিসেবে প্রণীত হয়েছে। ৯৩ নং অনুচ্ছেদ সংসদ অধিবেশন না থাকলে রাষ্ট্রপতিকে অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা প্রদান করে, যা মূলত দৈনন্দিন আইনগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য নির্ধারিত, বিপ্লবী সাংবিধানিক রূপান্তরে নয়। জুলাই বিপ্লবের পরও এ অনুচ্ছেদের ব্যবহার অব্যাহত রাখায় অন্তর্বর্তী সরকার এমন ধারণা জাগিয়েছে যে, রাষ্ট্র এখনো পূর্ববর্তী সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে সম্পূর্ণভাবে আবদ্ধ। অতএব, এ আদেশ রূপান্তরকালীন আইন প্রণয়নের উৎস হিসেবে জুলাই বিপ্লবকে সরাসরি স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম দলিল। এর ফলে বিপ্লব একটি আনুষ্ঠানিক আইনি মর্যাদা অর্জন করেছে, যা আগে অনুপস্থিত ছিল। এভাবে বিপ্লবকে কেবল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে উত্তীর্ণ করে একটি স্বীকৃত সাংবিধানিক ভিত্তিতে উন্নীত করা হয়েছে। এটি কোনো ছোট ঘটনা নয়। এটি রাষ্ট্রের নিজস্ব কর্মকাণ্ডের বৈধতা বোঝার ধরনে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নির্দেশ করে। সেই সাথে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক সমঝোতার রূপরেখা নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে।

এ পরিবর্তনের পেছনের যুক্তি খুব পরিষ্কার। আদেশটি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে চায়। আর জুলাই সনদ এমন কিছু সংস্কার প্রস্তাব করেছে যা সংবিধানের মূল কাঠামোকে পরিবর্তন করবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ‘মূল কাঠামোতত্ত¡’ নিয়ে দীর্ঘদিনের বিচারব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একমাত্র কার্যকর পথ ছিল বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে জনগণের গঠনমূলক ক্ষমতার ভিত্তিতে আদেশ প্রণয়ন। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে কোনো সংশোধনী মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটিই কার্যকর পথ খোলা ছিল। সেই মোতাবেক জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করতে আদেশটি বিদ্যমান সংবিধানের কাঠামোর বাইরে গিয়ে জনগণের গঠনমূলক ক্ষমতার ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার স্পষ্ট আহ্বানের মাধ্যমে আদেশটি নাগরিক ও বিচার বিভাগের কাছে এ সঙ্কেত দিয়েছে যে, প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো কেবল সাধারণ সাংবিধানিক পরিবর্তন নয়; বরং এটি বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোর একটি মৌলিক পুনর্বিন্যাস। তথাপি একটি প্রক্রিয়াগত প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে গেছে। আদেশটিতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর রয়েছে, যিনি জুলাই বিপ্লবে অপসারিত শাসনব্যবস্থার একজন প্রতিনিধিত্বকারী। যে দলিল বিপ্লবী বৈধতার দাবি করে, তা স্বভাবত অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো প্রতিনিধির স্বাক্ষরে কার্যকর হওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল।

গণভোটের প্রশ্নসমূহ

আদেশটি আসন্ন গণভোটে জনগণের সামনে উপস্থাপিত চারটি প্রশ্নের রূপরেখা প্রদান করেছে। প্রথম প্রশ্নে ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হবে তারা জুলাই সনদের আলোকে তত্ত¡াবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠনের অনুমোদন দেন কি না। দ্বিতীয় প্রশ্নে সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন চাওয়া হবে, যার সম্মতি ভবিষ্যতের সাংবিধানিক সংশোধনীর জন্য বাধ্যতামূলক হবে। তৃতীয় প্রশ্নে জনগণের অনুমোদন প্রার্থনা করা হয়েছে সর্বসম্মতভাবে সমর্থিত ৩০টি প্রস্তাবের জন্য। এসব প্রস্তাবের পরিসর নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির বিধান থেকে শুরু করে ডেপুটি স্পিকারকে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত করার সাংবিধানিক শর্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, যা প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্বের নতুন মাত্রা নির্দেশ করে। চূড়ান্ত প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুত বিস্তৃত সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে ভোটারদের পৃথকভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নেই; বরং তাদের একক ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে পুরো প্যাকেজ অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। পৃথক বিষয়সমূহ একত্রে একটি যৌথ ভোটে আবদ্ধ করার এ কৌশল দুর্বল আইনগত খসড়া প্রণয়নের নিদর্শন এবং গণভোট প্রক্রিয়ার গণতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যৌক্তিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

চারটি ভিন্ন প্রশ্নের জন্য আলাদা আলাদা ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ উত্তরের গণনা করা, বিশেষত একটি সর্বজনীন গণভোটে যে কতটা জটিল হতে পারে, তা অনুধাবন করা যায়। কিন্তু সরকার যদি ভোটারদের কেবল একটি মাত্র ভোট দিতে বাধ্য করে, তবে যৌক্তিক পথ হতো একটি একীভূত, সমন্বিত প্রশ্ন উপস্থাপন করা। চারটি পৃথক বিষয় উপস্থাপন করে নাগরিকদের প্রতিটিতে আলাদাভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ না দেয়ার মধ্যে খুব বেশি যৌক্তিকতা নেই; বরং এটি গণভোটের নকশাগত দুর্বলতা ও প্রক্রিয়াগত সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত করে।

শেষত, কিছু বিশ্লেষক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, সাধারণ ভোটাররা গণভোটে উপস্থাপিত চারটি জটিল প্রশ্ন যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারবেন কি না। নিঃসন্দেহে এসব প্রশ্নে জটিল সাংবিধানিক পরিবর্তনের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে, যা রাজনৈতিক তত্ত¡ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর গভীর বোঝাপড়া দাবি করে। তবে সমালোচকরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষা করছেন। ১৯৭২ সালের সংবিধান নিজে অত্যন্ত কারিগরি বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছে। একই সাথে সেগুলো গৃহীত হয়েছিল এমন সময়ে, যখন দেশের সাক্ষরতার হার আজকের তুলনায় অনেক কম ছিল। গণপরিষদ জাতির প্রতিষ্ঠাতা দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে জটিলতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল; অতএব ২০২৫ সালের সাংবিধানিক সংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে ‘জটিলতা’ তত্ত¡ ব্যবহার করা কোনোক্রমেই যৌক্তিক নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন, তাদের রাজনৈতিক ঘটনাবলির জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না।

সমাপনী বক্তব্য

আদেশটি নিখুঁত নয় এবং এর বিরুদ্ধে যৌক্তিক সমালোচনার সুযোগ রয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে, এর বৃহত্তর তাৎপর্য অগ্রাহ্য করার অর্থ হলো ইতিহাসের স্পন্দনকে অস্বীকার করা। প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ পারস্পরিক মতভেদ থাকা সত্তে¡ও, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সাংবিধানিক সংস্কারের পথে অপরিহার্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আদেশটি গ্রহণ করেছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো- জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে আদেশটি জুলাই বিপ্লবের একটি নতুন এবং ক্রমবর্ধমানভাবে গ্রহণযোগ্য আইনগত বয়ান এগিয়ে নিচ্ছে। এ বয়ান বলছে, জনগণ তাদের গঠনমূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে একটি নতুন সাংবিধানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করছেন, যা বিদ্যমান অথচ অকার্যকর সেই সংবিধানকে সংশোধন করবে, যে সংবিধান গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একটি স্বৈরাচারী শাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি