ইসরাইল-ইরান যুদ্ধের বিপজ্জনক মোড়

ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, ‘অনেক দেরি হওয়ার আগেই বিশ্বকে নেতানিয়াহুকে আটকাতে হবে। বিশ্ব নেতাদের নীরবতা লজ্জাজনক। আমরা লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং ইরানের জনগণকে সমর্থন করি।’

নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ বিপজ্জনক মোড় নিতে যাচ্ছে। নেতানিয়াহু শুরু থেকেই এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনতে চাচ্ছিলেন। এ লক্ষ্যে বলেছিলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি ট্রাম্পকে হত্যার দু’দফা পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। এ ধরনের প্রমাণহীন বক্তব্য পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে না বলেই মনে করা হচ্ছিল; কিন্তু সর্বশেষ ঘটনাবলিতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, পরিস্থিতি সত্যি অবনতির দিকে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটতে পারে।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার উগ্রপন্থী সহযোগীদের শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা মিত্রদের সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে অব্যাহত আক্রমণ করে ইরানের ইসলামিক শাসনের অবসান ঘটানোর; কিন্তু প্রথম দিনের হামলা কিছুটা সফল হলেও ইরান ঘুরে দাঁড়িয়ে ইসরাইলের ওপর পাল্টা হামলা চালানোর পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ইরানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের যেমন আশঙ্কা তৈরি হয়, তেমনি ইসরাইল রাষ্ট্র ভেঙে পড়ারও শঙ্কা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জি-৭-এর বৈঠক শেষ না করেই হোয়াইট হাউজে ফিরে যান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কাউন্সিলের বিশেষ বৈঠকের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেন। সেই সাথে ইসরাইলের সাথে সুর মিলিয়ে তেহরান খালি করার নির্দেশনা জারি করেন।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইল-ইরান যুদ্ধে সরাসরি জড়িত করছেন এমন উদ্বেগ তৈরি হয় খোদ আমেরিকায়। আমেরিকান সিনেট ও প্রতিনিধি সভা আইন পরিষদের দুই কক্ষেই পৃথকভাবে বিল পেশের উদ্যোগ নেয়া হয়, যাতে ট্রাম্প কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া এ যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়াতে না পারেন। ৮ জন মার্কিন সিনেটর ইরানের সাথে ইসরাইলের যুদ্ধে যোগদান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত রাখতে এ বিল উত্থাপন করেছেন। এ বিষয়ে মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স নেতানিয়াহুর তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, ‘ইরানকে আক্রমণ করে নেতানিয়াহু এই যুদ্ধ শুরু করেছেন। তিনি ইরানের প্রধান পারমাণবিক আলোচক আলী শামখানিকে হত্যা করে ইচ্ছাকৃতভাবে মার্কিন-ইরান পারমাণবিক আলোচনা ভণ্ডুল করেন। আমেরিকাকে সামরিক বা আর্থিকভাবে নেতানিয়াহুর আরেকটি অবৈধ যুদ্ধে টেনে আনা উচিত নয়।’

একই ইস্যুতে মার্কিন কংগ্রেস সদস্য থমাস ম্যাসি যুদ্ধে মার্কিন সামরিক সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করার জন্য ‘যুদ্ধ ক্ষমতা রেজুলিউশন’ বিল উত্থাপন করছেন। আমেরিকান সিনেট ও হাউজ এমন সময় এই বিল উত্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে যখন দেশটির গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার ৬৯% সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রাম্পের বক্তব্যে মনে হয়, তিনি নেতানিয়াহুর উসকানিতেই সাড়া দিচ্ছেন। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যা করলে ‘সঙ্ঘাতের অবসান হবে’। বলেছেন, ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে ‘পূর্ণ বিজয়ের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা থেকে তিনি সরে আসেননি বলেও ঘোষণা করেছেন।

এর পরই ট্রাম্প দুই ধরনের বার্তা দিয়েছেন। এক দিকে তেহরান খালি করার জন্য ইরানিদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে নেতানিয়াহুর প্রতিধ্বনি করেছেন। অন্য দিকে এই সপ্তাহে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি ও ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার চাপ দিয়েছেন। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতির ধরন অনেকখানি আত্মসমর্পণমূলক হওয়ায় তেহরানের তাতে কোনোভাবেই সম্মত হওয়ার কথা নয়। ইসরাইলের একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করা এবং ইরানি নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নির্মূল করার আয়োজন যে অনেক গভীর সেটি ইরানি নেতৃত্ব উপলব্ধি করছেন বলে মনে হয়। ইরানি রাহবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক ভাষণে দেশের জন্য তিনি শাহাদতবরণ করলেও ইসলামী বিপ্লব এবং ইরানি জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার এজেন্ডা এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

ইসরাইল-আমেরিকার এই বিপজ্জনক উদ্যোগের সময় কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ বৈঠকে ইসরাইলের ন্যক্কারজনক ইরান হামলাকে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে সমর্থন জানানো হয়েছে। আক্রান্ত ইরানের পরমাণুশক্তি অর্জনের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে। যদিও এর বিপরীতে তুরস্ক, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ শীর্ষ মুসলিম দেশ ও ওআইসি ইরানে ইসরাইলি হামলার নিন্দা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে বিপজ্জনক উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে চীন সতর্ক করে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, ‘অনেক দেরি হওয়ার আগেই বিশ্বকে নেতানিয়াহুকে আটকাতে হবে। বিশ্ব নেতাদের নীরবতা লজ্জাজনক। আমরা লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং ইরানের জনগণকে সমর্থন করি।’

দ্রুত যুদ্ধ শেষ নাও হতে পারে

ইরানে ইসরাইলের সর্বাত্মক সামরিক হামলায় সৃষ্ট সঙ্ঘাত সূচনা সপ্তাহে শেষ হবে বলে মনে হয় না। নেতানিয়াহু যুদ্ধ শুরুর পর বলেছিলেন, দুই সপ্তাহ এটি চলবে। ইরানের পাল্টা আক্রমণে বিপর্যস্ত না হলে এ যুদ্ধ আরো সামনে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর রয়েছে বলে মনে হয়। ইসরাইলের ইরান আক্রমণে পরোক্ষভাবে যে যুক্তরাষ্ট্র সবধরনের সহায়তা করেছে এবং যুদ্ধ শুরুর অনুমোদন দিয়েছে তা এখন আর গোপন নেই। ট্রাম্পই বলেছেন, তিনি চাইলে ইরান ও ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য করতে পারেন। আবার তিনি বলছেন, কখনো যুদ্ধ দিয়েই অনেক কিছুর সমাধান করতে হয়।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিশেষভাবে প্রয়োজন। নেতানিয়াহু সবশেষ মন্তব্যে তার নতুন লক্ষ্য ইরানে বর্তমান শাসকদের বিদায় করে নতুন শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। এ লক্ষ্যে ইরানিদের প্রতি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর ক্ষমতাচ্যুত রাজা রেজা শাহ পাহলভির ছেলে রেজা পাহলভিকে নেতানিয়াহু ইসরাইলে ডেকে নিয়েছেন। পাকিস্তানে বালুচ বিদ্রোহীদের স্বাধীনতার জন্য উসকে দিচ্ছেন। কুর্দি অঞ্চলের ইরানিদেরও বিদ্রোহের জন্য উসকানি দিচ্ছেন।

এরই মধ্যে তেহরানে একটি গোপন ড্রোন তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেছে ইরানি পুলিশ। এ কারখানায় মোসাদের তত্ত্বাবধানে ইরানে নাশকতা সৃষ্টির জন্য ড্রোন তৈরি করা হতো। ইসরাইল যুদ্ধের প্রথম দিনে ছয় জেনারেল এবং সমসংখ্যক পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যার পিনপয়েন্ট টার্গেট ইরানি ভূখণ্ড থেকেই করা হয়েছিল। যুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে বিভিন্ন সামরিক ও সরকারি স্থাপনায় আঘাত হানতে বিমানের পরিবর্তে ড্রোন ব্যবহার করা হয়। ইরানি ভূখণ্ডের ভেতরে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর চরদের দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

আগ্রাসন ও প্রতিবিপ্লবী অন্তর্ঘাত

ইরানে বর্তমান ইসলামী বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কয়েকটি পক্ষ সক্রিয়, যাদের কার্যক্রমে এসব শক্তি বাইরে থেকে ইন্ধন দিয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি শক্তি রয়েছে পাহলভি রাজাদের অনুগত ইরানি, দ্বিতীয় পক্ষটি হলো মুজাহিদীনে খালক বা কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থিত ইরানি, যারা শুরু থেকেই ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতা চালিয়ে আসছিল। তৃতীয় পক্ষটি হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, যার একটি অংশ পূর্বে সিস্তান প্রদেশের বালুচ এবং অন্য অংশ পশ্চিমাঞ্চলের কুর্দিরা। এ তিনটি পক্ষকে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা অব্যাহতভাবে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে বর্তমান শাসনের পরিবর্তনের জন্য।

এর আগে ইসরাইল বলেছে, এক বছর ধরে তারা ইরানে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তাদের এই পরিকল্পনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত রেখেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের সার্জিক্যাল অপারেশনের পর ইসরাইল গাজা ও হামাসকে প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে উপত্যকাটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এরপর তারা টার্গেট করে লেবাননের হিজবুল্লাহ গ্রুপকে। তারপর ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ হুথিদের ওপর মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের সহায়তায় আঘাত করে। তারপর সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন-পরবর্তী অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে দেশটির সামরিক সক্ষমতাকে একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পরমাণু চুক্তির আলোচনা চলাকালেই সর্বাত্মক বিমান হামলা চালিয়ে বসে।

ইসরাইল দুই সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তাপুষ্ট হয়ে ইরানের সামরিক সক্ষমতার পতন ঘটিয়ে নতুন শক্তির ক্ষমতা দখলের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে বলে আশা করেছিল। এ লক্ষ্যে ইরানের রাডার সিস্টেম ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অকার্যকর করে সর্বাত্মক বিমান হামলা চালায়। সেনা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা করে। এক দিনের মধ্যেই ইরান ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা আঘাত হানতে পারবে- এটি ইসরাইলের ধারণায় ছিল না।

ইসরাইল আশা করেছিল, তার ও মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় রাজধানী তেহরানকে অচল করে দেবে। আর সরকারবিরোধীরা রাস্তায় নেমে যাবে। সেনাবাহিনীতে থাকা এজেন্টদের মাধ্যমে বিদ্রোহ ঘটাবে। এ লক্ষ্যে বছরের পর বছর ধরে দেশটি ইরানি সশস্ত্রবাহিনী, ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী, আল কুদস ফোর্স এবং গোয়েন্দা পরিষেবার মধ্যে গভীর অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এবার সেই চক্রকে একসাথে সক্রিয় করে।

পাল্টা আঘাতে বিধ্বস্ত ইসরাইল

যুদ্ধ শুরুর তিন দিনে ইসরাইলের এই অভিযানে ইরানের প্রচুর ক্ষতি হলেও তেহরানের পাল্টা আঘাতে তেল আবিব বিপর্যস্ত হয়েছে। রাজধানী তেল আবিব, হাইফা বন্দর, নেগেভ বিমানঘাঁটি ও পরমাণু কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সংবেদনশীল স্থাপনার গভীরে ইরানি আঘাত নেতানিয়াহু ও তার যুদ্ধ পরিষদকে নতুন হিসাবনিকাশে বসিয়েছে।

ইরান এ প্রত্যাঘাত যদি আরো কয়েক দিন অব্যাহত রাখতে পারে তাহলে ইসরাইল এবারকার মতো তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিরতি টেনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু করতে পারে। মিত্রদের দিয়ে যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইল তখনই যাবে যখন মনে করবে যে, এ যাত্রায় ইরানে শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডা পূরণ করা সম্ভব নয়। আবার একই সাথে ইসরাইলের অস্তিত্বের সামনে হুমকি তৈরি হবে।

ইসরাইলের পরিকল্পনার মূলে রয়েছে বৃহত্তর ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা। এ লক্ষ্য অর্জনে গত আড়াই দশকের বেশি সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বড় দেশগুলোকে দুর্বল করা হয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে দিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে ৯ বছর সেই যুদ্ধ চালিয়ে রাখা হয়েছে। এতে দুই দেশই দুর্বল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর কুয়েত দখলের উনকানি দিয়ে ইরাককে দুর্বল করার ব্যবস্থা করা হয়। সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে সেটি সম্পন্ন হয়। এরপর আরব বসন্তের মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়া হয়।

মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন ও হত্যার পর লিবিয়াকে কার্যত তিনভাবে বিভক্ত করা হয়। গৃহবিবাদে বিপর্যস্ত হয় ইয়েমেন ও সিরিয়া। আর সেই সাথে আরবের পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর ওপর ইসরাইলকে স্বীকৃতিদানের চাপ তৈরি করা হয়। এর মধ্যে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরাইলের আগ্রাসী সঙ্ঘাত আরম্ভ হয়। এর একপর্যায়ে ইরানের প্রতিরোধ শক্তিগুলোকে দুর্বল করে চূড়ান্ত আঘাত করা হয় ইরানের ওপর। নেতানিয়াহু এ যুদ্ধ শুরু করার আগেই ঘোষণা করেছেন, তাদের পরবর্তী টার্গেট হবে পাকিস্তান। তুরস্ককে নিশানা করার বিষয়টিও আড়ালে থাকেনি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর। তিনি এক দিকে একের পর এক যুদ্ধ বাধিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চান। অন্য দিকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ইসরাইলের আধিপত্যবন্দী করে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করতে চান।

আরব দেশগুলো কী করবে

আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের এই উচ্চাভিলাষের বিষয়টি জানে না তা নয়। তবে ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে খুব বেশি নেই। এ ক্ষেত্রে ইরানই ছিল প্রথম কাতারে। ইরান যে আঘাতের মুখে রয়েছে, একটি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা সামলানো সম্ভব হবে যদি ইসরাইলকে পরাজয়ের আশঙ্কার মধ্যে ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের বিকল্প নেই।

ইরান ইতোমধ্যে পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়ার মতো শক্তিমান মুসলিম দেশগুলোর সামরিক জোট গঠনের ডাক দিয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সব মুসলিম দেশেরই এর অংশ হওয়ার বিকল্প নেই। বিশ্ব আধিপত্যবাদের সামনে ইরান সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের একটি। একে পদানত করতে পারলে এরপর আসবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন বা দুর্বল হলে বাংলাদেশের মতো বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে থাকা মুসলিম দেশের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।

সঙ্কট শুধু মুসলিম দেশগুলোরই কেবল নয়; এটি বিশ্বব্যবস্থারও সঙ্কট। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর জাতিসঙ্ঘ ও এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে চাঁদা দেয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে চলতে না দেয়ার ব্যাপারে কোনো এক পরিকল্পনা রয়েছে বলে মনে হয়। গত এক দশকে যেভাবে শক্তির জোরে দেশ দখল চলতে দেয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে বিকল্প ঐক্য বিশেষভাবে দরকার হয়ে পড়েছে। এই বিকল্প তৈরির ক্ষেত্রে শুধু মুসলিম ঐক্যই নয়, সেই সাথে যারা একটি ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থা কামনা করেন তাদের সবার ভূমিকা নেয়া দরকার। ব্রিকস ও মধ্যশক্তির দেশগুলো এক্ষেত্রে বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে পারে।

[email protected]