কবি আমাকে অনেক কিছু বলেছিলেন

বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়েকজন শিক্ষক গাড়ির স্টিয়ারিং থেকে হাত তুলে হেসে সালামের জবাব দিতেন, তাদের একজন আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

পড়তাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতাম আলাওল হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়েকজন শিক্ষক গাড়ির স্টিয়ারিং থেকে হাত তুলে হেসে সালামের জবাব দিতেন, তাদের একজন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। স্বল্পপ্রজ কবিদের একজন ছিলেন তিনি। বাকিদের মধ্যে ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলা বিভাগের ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ। আবু হেনা মোস্তফা কামালের সাথে আমার পরিচয় বেশি ছিল না। কিন্তু তিনি কেন জানি না, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসার পরে আমাকে অনেক কিছু বলেছিলেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ১৯৭৬ সালে গ্রীষ্মকালীন অবকাশের সময় চলে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর পর তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আমার সাথে দেখা হয়।

আমাদের বিভাগ ছিল পাশাপাশি; ইংরেজি ও বাংলা। আমি স্বভাবসুলভ কায়দায় সালাম দিলাম, তিনি জবাব দিলেন এবং অনেক কথা বললেন। লোকে সাধারণত স্বল্প পরিচিত কাউকে এত কথা বলেন না। আবু হেনা মোস্তফা কামাল সে দিন মন খুলে কথা বলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। সে দিন তিনি নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছিলেন। তিনি স্বল্পপ্রজ ছিলেন, এটি বলেছি। তার সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘আপন যৌবন বৈরী’, অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে, ‘যেহেতু জন্মান্ধ’ ও ‘আক্রান্ত গজল’। আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আপন যৌবন বৈরী’ এই একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেই তিনি নাম করেছিলেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংবাদপত্রের ভূমিকার উপর ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৮৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্বল্পস্থায়ী জীবন হলেও তিনি অনেক কবিতা লিখতে পারতেন; কিন্তু লিখেননি। তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন পত্রিকার কলামের ওপর। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নিয়মিত কলাম লিখতেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসার সময় প্রফেসর আবদুল আউয়াল ও প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরায়শী সেখান থেকে চলে আসেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ১৯৫২ সালে এসএসসিতে দ্বাদশ স্থান অধিকার করেছিলেন, ১৯৫৮ সালে এমএতে প্রথম বিভাগে প্রথম শ্রেণী স্থান অধিকার করেন। প্রফেসর আবদুল আউয়াল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। মোহাম্মদ শাহ কোরায়শী সেখানকার ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের অধ্যাপক নিয়োজিত হন। তিনি জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের জামাতা এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় তার বাড়ি। আবু হেনা মোস্তফা কামালের জ্ঞানবত্তার উপরে গভীর আস্থা ছিল কারো কারো। একদিন আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলের পেছন দিয়ে হাঁটছিলাম। সেখানে বৃষ্টিতে ভেজা একজন বালককে দেখতে পেলাম। আবু হেনা মোস্তফা কামাল সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন- এ কথা আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতে শুনেছি। ওই ছেলেটা ছিল সুজিত মোস্তফার ছোট ভাই। সুজিত মোস্তফা বর্তমানে নজরুল সঙ্গীতশিল্পী। আবু হেনা মোস্তফা কামাল সঙ্গীত প্রতিযোগিতা পরিচালনা করতেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালে ছিলেন। এ কারণে তার স্বাধীনতার পরে দুর্ভোগ ঘটেছিল। তিনি কবি জিয়া হায়দার ও গল্পকার রশীদ হায়দারের মামা ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন একজন সাংবাদিকের বোন সাবেরী মোস্তফাকে।

কথাশিল্পী রশীদ হায়দার পাবনার লোক ছিলেন। তিনি আঞ্চলিক ভাষায় ‘যেমন সেমন’ বলেছিলেন। এটিকে আবু হেনা মোস্তফা কামাল শুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘যেমন তেমন’। আবু হেনা মোস্তফা কামালের মৃত্যুর পরে রশীদ হায়দার একটি লেখায় এ কথা বলেছিলেন। গীতিকার মরহুম মাসুদ করিমের লেখা একটি গান আছে, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ/রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি, তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ। আমার এ দু’হাত শুধু রিক্ত, আমার এ দু’হাত শুধু সিক্ত/বুকভরা নীরবতা নিয়ে অকারণ, আমার এ দুয়ার হলো বন্ধ।’ গানটি অনেকে আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা বলে মনে করেন। ঠিক তেমনি, ‘সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই, জানি না তো কেমন করে কী দিয়ে সাজাই’- গানটি বেগম জেবুননেসা জামালের (সঙ্গীতশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগমের বড় বোন) লেখা হলেও আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা বলে প্রচার করা হয়। আসলে তার লেখা গান হচ্ছে মরহুম আনোয়ার উদ্দিন খানের গীত ‘সেই চম্পা নদীর তীরে/দেখা হবে আবার যদি/ফাগুন আসে গো ফিরে।’

তিনি একজন রেডিও আলোচক ও সংবাদপত্রের কলামিস্ট ছিলেন। রেডিওতে তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন- ‘আমি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছি। আর একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাকি আছে- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ইনশাআল্লাহ, আমি ওখানেও শিক্ষকতা করব।’ এর আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন মাত্র ৫৩ বছর বয়সে। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং নিজেই গাড়ি চালিয়ে যান হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য। এ বিষয়ে তিনি ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় লিখেছিলেন আগেই। উল্লেখ্য, তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন।