হাদি : আধিপত্যবাদবিরোধী নির্ভীক কণ্ঠস্বর

একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়, তাকওয়া (আল্লাহভীতি), তাওয়াক্কুল (আল্লাহ নির্ভরতা) ও ইখলাস (আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা)- শহীদ ওসমান হাদি সম্ভবত এর সব গুণই অর্জন করতে পেরেছিলেন। যে কারণে তিনি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে তরুণ প্রজন্মের আইকনে পরিণত হন।

মীর লুৎফুল কবীর সা’দী

শহীদ শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিশেষ করে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অনন্য প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে যে নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে তার অন্যতম কারিগর ছিলেন ওসমান হাদি। তিনি ছিলেন প্রকৃত মুসলিম, দেশপ্রেমিক এবং ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে বাইরের হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে ভারতের আগ্রাসনের কবল থেকে মুক্ত হতেই হবে। এই লক্ষ্যেই তিনি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গঠন করেন, যা রাজপথে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ওসমান হাদি মনে করতেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের

আগে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন। তিনি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপরীতে বাংলাদেশের নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তা জাগিয়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন, গড়েছিলেন ‘ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার’, ভারতীয় আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা ও গবেষণাকেন্দ্র। তিনি বলতেন, ‘আমাদের প্রয়োজন প্রতিবেশী, কোনো প্রভু নয়।’ তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তার কবিতার সঙ্কলন ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’ (সীমান্ত শরিফ ছদ্মনামে) তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেমের স্ফুরণ ঘটিয়েছিল।

ওসমান হাদি আবেগ দিয়ে নয়, বরং যুক্তি দিয়ে আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করতেন। তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যাতে সংসদীয় রাজনীতিতে ইনসাফ, ন্যায় ও সততার কণ্ঠস্বর জাতীয় সংসদে পৌঁছে দেয়া যায়। তিনি ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের ‘একতরফা’ পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করতেন এবং বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্কের দাবি জানাতেন।

গত ১২ ডিসেম্বর তার হত্যাকাণ্ডকে অনেক ছাত্রনেতা ও সমর্থক ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করার অপচেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে ‘হেজিমনি বা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অমর সৈনিক’ হিসেবে অভিহিত করেন।

একজন মানুষের নাম থেকে একটি নৈতিক, আধ্যাত্মিক চেতনার জন্ম নেয়। ইতিহাসে কিছু নাম থাকে যা শুধু কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে না; বরং একটি নৈতিক অবস্থান, একটি আধ্যাত্মিক দায়িত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। ওসমান হাদি তেমনই এক নাম। হাদি কোনো একক দেহের পরিচয় নয়, তিনি হলেন সেই মানুষ যে অন্যায় দেখে নীরব থাকে না, জুলুমের সাথে আপস করে না। যে শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে সব ভয় অতিক্রম করে। কুরআন বলে, ‘যারা আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেয় এবং তাঁকেই ভয় করে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না।’ (সূরা আল-আহজাব-৩৩ : ৩৯)

তার কণ্ঠে ছিল বজ্রধ্বনি; কিন্তু সে বজ্র অহঙ্কারের ছিল না, ছিল ঈমানের নিশ্চিততা। তার চোখে যে আগুন তা ঘৃণার নয়, তা ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্য করার আগুন; কুরআন যাকে বলে ‘ফুরকান’ অর্থাৎ সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করে দেখার ক্ষমতা। ‘হে মুমিনরা, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তিনি তোমাদের জন্য ফুরকান সৃষ্টি করে দেবেন।’ (সূরা আল-আনফাল-৮ : ২৯)

ওসমান হাদির বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে নয়; বরং অন্যায়ের শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে। তার প্রতিবাদ ছিল ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য। রাসূল সা: যেমন বলেছেন, ‘জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলাই সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ।’ (সুনান আবু দাউদ, তিরমিজি)

এই হাদিস যেন ওসমান হাদির জীবনের ভাষ্য। হাদির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার দ্বিধাহীন স্পষ্টতা। তাকওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক রূপ ছিল তার মধ্যে। তিনি জানতেন সত্যকে যদি কৌশলের নামে লুকানো হয়, তবে তখন তা আর সত্য থাকে না। তথাকথিত বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের মুখোশ খুলে দিতে তার কলম ও কণ্ঠস্বর কাঁপেনি, কারণ তিনি বুঝতেন, ‘সত্যের ওপর সত্যকে চাপা দেয়া জুলুমেরই আরেক রূপ।’

কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ, ‘সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-শুনে সত্য গোপন করো না।’ (সূরা আল-বাকারাহ-২ : ৪২) এই স্পষ্টতা ছিল তার ইবাদত। কারণ সত্য বলা কেবল রাজনৈতিক অবস্থান নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক দায়িত্ব। যে মৃত্যুকে ভয় পায় না, অত্যাচার তাকে ভয় পায়। একটি প্রজন্ম তার কথায় জেগে উঠেছে, কারণ সে প্রজন্ম দেখেছে একজন মানুষ আছেন, যিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। আর কুরআনের ঘোষণা স্পষ্ট, ‘বলুন, যে মৃত্যুর হাত থেকে তোমরা পালাতে চাও, সে মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে।’ (সূরা আল-জুমুআহ-৬২ : ৮)

হাদি এই সত্য বুঝতেন বলেই তার কণ্ঠ কাঁপেনি; বরং ফ্যাসিবাদী মসনদ টলে উঠেছিল। কারণ অত্যাচারী জানে, যে মানুষ আখেরাতকে সামনে রেখে কথা বলে, তাকে দমিয়ে রাখা যায় না। তার তাকবির ধ্বনি নিছক স্লোগান ছিল না। ‘আল্লাহু আকবার’ তার কাছে ছিল ক্ষমতার সর্বোচ্চ মালিক মানুষ নয়, রাষ্ট্র নয়, কোনো আদর্শিক এলিটও নয়- ক্ষমতার উৎস একমাত্র আল্লাহ, শুধু আল্লাহ। এই ঘোষণাই ছিল আধিপত্যবাদী চিন্তা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় আঘাত।

সবচেয়ে গভীর সত্যটি এখানে ছিল যে, এই বজ্রকণ্ঠ মানুষটি ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের সাধারণ। ফজরের আজান থেকে রাতের শেষপ্রহর পর্যন্ত দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের আবাস ছিল তার কর্মক্ষেত্র। কুরআন যাকে বলে, ‘তারা খাদ্য দান করে আল্লাহর ভালোবাসায় অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে।’ (সূরা আল-ইনসান-৭৬ : ৮)

ঘরের মেঝেয় বসে বঁটিতে বাঁধাকপি কাটার দৃশ্য তাই কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়; বরং এটিই তার দর্শন। বিপ্লব মানে বিলাস নয়, বিপ্লব মানে মানুষের কাতারে নেমে আসা। হাদি আন্তরিকভাবে মনে-প্রাণে ধর্মপ্রাণ ছিলেন; কিন্তু সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ ছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন ইসলাম সঙ্কীর্ণ নয়, প্রশস্ত, ইসলামেই রয়েছে প্রকৃত ইনসাফের বিস্তার। ‘হে মুমিনরা, তোমরা ইনসাফের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়াও যদিও তা তোমাদের নিজের বিরুদ্ধেই যায়।’ (সূরা আন-নিসা-৪ : ১৩৫) এই ইনসাফই ছিল তার ইবাদত, তার রাজনীতি, তার মানবতা। আজ তিনি নেই; কিন্তু কুরআনের ভাষায়, ‘তোমরা আল্লাহর পথে নিহতদের মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত।’ (সূরা আল-বাকারাহ-২ : ১৫৪)

শহীদ ওসমান হাদির ভাষায়, ‘আমি যখন ইনসাফের লড়াই করি তখন তো সেখানে পরাজয়ের কিছু নেই। বেঁচে থাকলে গাজী হবো আর মারা গেলে শহীদ।’ তিনি বলতেন, ‘সবাই যখন মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পায় আমি তখন হাসতে হাসতে আল্লাহর কাছে সন্তুষ্টি নিয়ে পৌঁছাতে চাই। যে আমি ন্যূনতম ওই জীবনটা লিড করতে পারলাম, যে আমি ইনসাফের হাসি নিয়ে আমার আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চাই।’

আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, মানুষের ও ইনসাফের পক্ষে কথা বলা ওসমান হাদির সাথে আমার প্রথম দেখা হয় গত ২৪ অক্টোবর ২০২৫ জুমাবার ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশন ম্যানেজমেন্টে (নায়েম) ‘ইয়ং এডুকেটরস লিডারশিপ সামিট-২০২৫’-এ। যা আয়োজন করেছিল শিক্ষা অধিকার সংসদ। সে দিন প্রথম সারিতে ওসমান হাদি আমার পাশেই বসেছিলেন। এই প্রথম তার সাথে আমার সাক্ষাৎ। তাই অনেক আগ্রহ নিয়েই কথা বলছিলাম ‘ফেইথ, ফ্যামিলি অ্যান্ড ফিউচার অব দ্য সোসাইটি’ আমাদের ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ও ন্যাশনাল সেমিনার নিয়ে। এই বিষয়টির প্রতি ওসমান হাদির যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও অনুষ্ঠান চলাকালীন আর কথা হলো না। ওসমান হাদির মোবাইল ফোন নম্বর সেভ করা আছে। তার সাথে আবার কথা হবে, দেখা হবে এরকমই তো আশা করছিলাম গভীরভাবে। কিন্তু মাত্র দু’মাস না হতেই ঘাতকের গুলিতে শাহাদত বরণ করে স্বীয় রবের কাছে চলে গেলেন ওসমান হাদি।

মাত্র ৩২ বছরের কী এক অসাধারণ, অসামান্য জীবন! মাত্র সোয়া এক বছরের রাজনৈতিক জীবন! কোনো সরকারি পদ নেই, এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলও নেই; কিন্তু রয়েছে দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ব, ভালোবাসা। তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যায় জানাযায় লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি, হৃদয় নিংড়ানো গভীর ক্রন্দন, যা ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে শহীদ ওসমান হাদিকে। তার খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হবে, এটিই দেশবাসীর একান্ত কাম্য।

একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়, তাকওয়া (আল্লাহভীতি), তাওয়াক্কুল (আল্লাহ নির্ভরতা) ও ইখলাস (আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা)- শহীদ ওসমান হাদি সম্ভবত এর সব গুণই অর্জন করতে পেরেছিলেন। যে কারণে তিনি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে তরুণ প্রজন্মের আইকনে পরিণত হন। দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় মমত্ববোধ, আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরতা তাকে অনুসরণীয় মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। তাকে যথাযথভাবে অনুসরণ কোনো মসৃণ পথ নয়; তবে এ পথেই রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে নিশ্চিত সফলতা।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও গবেষক